
বোয়ালমারী (ফরিদপুর) প্রতিনিধি : ইউনিয়ন পরিষদ, উপজেলা প্রশাসন, জেলা প্রশাসন চেষ্টা করেও প্রভাবশালীদের নিকট থেকে দখলমুক্ত করতে পারেনি চিতারবাজার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের দখল হয়ে যাওয়া জমি। এ কারণে জনমনে প্রশ্ন উঠেছে প্রায় দশ কোটি টাকা মূল্যের এই সম্পত্তি আর কি দখলমুক্ত হবে না ? স্কুল কি ফিরে পাবে সম্পত্তি, শিক্ষার্থীরা কি ফিরে পাবে তাদের খেলার মাঠ ?
জানা যায়, ১৯৬৮ সালে স্থাপিত ফরিদপুরের বোয়ালমারী উপজেলার দাদপুর ইউনিয়নে অবস্থিত চিতারবাজার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের এক একর (একশ শতাংশ) জমি বছরের পর বছর স্থানীয় প্রভাবশালীরা দখল করে খাচ্ছে। জমির অভাবে শিক্ষার্থীদের জন্য খেলার মাঠ তৈরি করতে পারছে না বিদ্যালয়। আর খেলার মাঠ না থাকায় খেলাধুলাসহ অনেক আবশ্যকীয় বিনোদন থেকে বঞ্চিত হচ্ছে কোমলমতি শিক্ষার্থীরা। স্থানীয় বাজার বণিক সমিতির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকসহ বেশ কয়েকজন অবৈধভাবে বিদ্যালয়ের সিংহভাগ জায়গাই জবরদখল করে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
এ ব্যাপারে বিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সচিব, জেলা প্রশাসক, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা বরাবর আবেদন করেও ফল পাওয়া যাচ্ছেনা। অবৈধ দখলদারদের উচ্ছেদ করে বিদ্যালয়ের সম্পত্তি দখলমুক্ত করে ছাত্র-ছাত্রীদের খেলাধুলা করার জন্য সুযোগ সৃষ্টি জন্য আবেদন করা হলেও গত ৫ বছরে কোনো সুরাহা হয়নি। উল্টো বিদ্যালয়ের জায়গা উদ্ধার করতে গিয়ে অবৈধ দখলদারদের রোষানলে পড়তে হয়েছে প্রধান শিক্ষককে।
উপজেলার বাজিতপুর ও মোবারকদিয়া মৌজার ২, ৩৩৮ ও ৬২০ নং বি এস খতিয়ানের ০১, ০২, ৩১, ৩২, ৩৫ ও ৪২৫ দাগে চিতারবাজার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের নিজস্ব জমির পরিমাণ এক একর ২৫ শতাংশ। কিন্তু বিদ্যালয়ের দখলে থাকা জমির পরিমাণ মাত্র ২৫ শতাংশ। বিদ্যালয়ের অধিকাংশ জমি বাজারের মধ্যে অবস্থিত। অবৈধ দখলদাররা বিদ্যালয়ের সম্পত্তিকে নিজস্ব মালিকানা হিসেবে দাবি করে বিভিন্ন সময়ে অবৈধ স্থাপনা তৈরি করে ব্যবসা-বাণিজ্য করে যাচ্ছে। বিদ্যালয়ের জমি অবৈধভাবে যারা দখল করে রেখেছেন, তাদের মধ্যে রয়েছেন বিদ্যালয়ের পরিচালনা পর্ষদের সাবেক সভাপতি হীরামন পারভীনের স্বামী শাকিল মোল্যা। তিনি চিতারবাজার বণিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক। বণিক সমিতির সভাপতি ব্যবসায়ী জামাল উদ্দিনও এক শতাংশ জায়গা অবৈধভাবে দখল করে রেখেছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। এছাড়া আবুল খায়ের, মো. আলমগীরসহ বেশ কয়েকজন ব্যবসায়ী বিদ্যালয়ের জমি দখল করে দোকান ঘর তৈরি করে ব্যবসা বানিজ্য করে যাচ্ছে।
২০২০ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি বিদ্যালয়ের তৎকালীন সভাপতি সাজ্জাদুর রহমান জমি উদ্ধারের জন্য জেলা প্রশাসক বরাবর আবেদন করেন। ওই বছরের ২৫ নভেম্বর তৎকালীন প্রধান শিক্ষক রত্না রাণী দে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা বরাবর আবেদন করেন। আবেদনের প্রেক্ষিতে তৎকালীন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা বিদ্যালয়ের জমি পরিমাপ করে ১০২ শতাংশ জমির দখল বিদ্যালয়কে বুঝিয়ে দেন। জমি পরিমাপের সময় বিদ্যালয়ের পাশের কোনো জমির মালিকই আপত্তি জানাননি। কিন্তু অবৈধ দখলদাররা পরে তাদের দখল ছাড়তে অস্বীকৃতি জানায়। প্রধান শিক্ষক রত্না রাণী দে পুনরায় ২০২৩ সালের ১০ এপ্রিল প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক বরাবর জমি উদ্ধারের আবেদন করেন। এরপর জমি তো উদ্ধার হয়ইনি উল্টো প্রধান শিক্ষক রত্না রাণী দেকে বদলি হতে হয়েছে। বর্তমান ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক মো. দেলোয়ার হোসেন চেষ্টা করে গেলেও কাজের কাজ কিছুই হচ্ছেনা। তিনি বলেন, বিভিন্ন মানুষের বেদখলে থাকা বিদ্যালয়ের জায়গা উদ্ধারে কোনো অগ্রগতি নেই। উপরন্তু কিছু টিনের ঘর এখন পাকা হয়েছে, পোক্ত হয়েছে। বর্তমান বণিক সমিতির সভাপতি জামাল উদ্দিনের দখলে প্রায় এক শতাংশ জমি রয়েছে। সাধারন সম্পাদক শাকিল মোল্যা ও ভাইয়েদের দখলে ৫-১০ শতাংশ জমি রয়েছে। অন্যান্য প্রভাবশালীরাও জমি দখল করে রয়েছে।
এ ব্যাপারে চিতারবাজার বণিক সমিতির সভাপতি জামাল উদ্দিন বলেন, বিদ্যালয়ের কোন সম্পত্তি আমি দখল করিনি। আমার ব্যক্তিগত সম্পতিতে আমি ঘর করেছি। বিদ্যালয়ের জমি আছে বাজারের ভিতর, বিদ্যালয়ের সামনে।
সাধারণ সম্পাদক শাকিল মোল্যাও বিদ্যালয়ের জমি দখলের বিষয়টি অস্বীকার করে বলেন, অনেক আগে আমি জমি একজনের নিকট থেকে ক্রয় করেছিলাম। সেটি দলিলের সম্পত্তি কি না জানতে চাইলে বলেন, দালিলিক নয় খাস হতে পারে তবে স্কুলের নয়। আবার বলেন হাফ শতাংশের মতো থাকতে পারে। ভাইদের দখলে থাকতে পারে, তবে সেগুলো স্থায়ী না। টং ঘর। যখন তখন তুলে দেওয়া যায়। বিভিন্নজন দোকান ঘর তুলে ব্যবসা করছে। তিনি উল্টো অভিযোগ করেন, সাবেক চেয়ারম্যান সামসুল হক বিশ্বাসের ছেলেরা ১১৪ দাগে জমি বিক্রি করে স্কুলের দাগ থেকে দখল দিয়েছে। সভাপতি সম্পাদক উভয় আমন্ত্রণ জানান, জমি মেপে দেখার জন্য।
দাদপুর ইউনিয়ন বিএনপির সাধারণ সম্পাদক হামিদুল হক বকুল জানান, আমার বাবা সামসুল হক বিশ্বাস পুরো এক একর ২৫ শতাংশ জমি বিদ্যালয়কে দান করেছিলেন। কিন্তু সেই জমির অধিকাংশই এখন শতাধিক ব্যক্তির জবরদখলে, যা দুর্ভাগ্যজনক। আমরা চাই বিদ্যালয়ের এক একরের মতো জায়গা বিভিন্ন জন দখল করে রেখেছেন, তা প্রশাসন উদ্ধার করুক। শাকিল মোল্যার অভিযোগ মিথ্যা বলে জানান তিনি।
বিদ্যালয়ের অ্যাডহক কমিটির সভাপতি এবং দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা নাসিমা আক্তার জানান, এর মধ্যে একদিন ওই এলাকায় গিয়ে দিনব্যাপী সরকারি আমিন নিয়ে বিদ্যালয়ের জমি মেপেছি। যারা দখল করে আছেন তাদের বলেছি, আপনাদের সবার উঠে যেতে হবে। দখল হওয়া জমি উদ্ধার না করতে পারলেও পুনরায় দখল ঠেকাতে পেরেছি। উদ্ধারের চেষ্টা অব্যাহত আছে। চেষ্টা করে যাচ্ছি। বিদ্যালয়ের জায়গা উদ্ধারের জন্য যেসব দপ্তরে কাগজপত্র দেওয়ার দরকার সব জায়গায় দিয়েছি।
এ ব্যাপারে দাদপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মোশারফ হোসেন বলেন, বিদ্যালয়ের জায়গা উদ্ধারে আমার আন্তরিকতা আছে, কিন্তু পেরে উঠছি না। উপজেলা মাসিক সমন্বয় সভায়ও বিষয়টি তুলেছি, কিন্তু কোন অগ্রগতি হয়নি।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা তানভীর হাসান চৌধুরী বলেন, সহকারি কমিশনার (ভূমি) কিছুদিন আগে জায়গাগুলো দেখে এসেছেন। এগুলো নিয়ে একটু ঝামেলা আছে। প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তার সঙ্গে বসে এটা কিভাবে সমাধান করা যায় সেটা বের করতে হবে।




