এইচ.কে রফিক উদ্দিন,উখিয়া : আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে গত ৫ মার্চ কক্সবাজারের উখিয়ার বালুখালী ১১ নম্বর রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। এটি সম্পূর্ণ পরিকল্পিত ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বলে জানিয়েছে তদন্ত কমিটি। তবে কোথায়, কে আগুন লাগিয়েছে তার প্রমাণ না পেলেও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর চিরুনি অভিযান ও গোয়েন্দা তৎপরতা বাড়ানোসহ ১০টি সুপারিশ করেছে তারা। প্রথমত আগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় মামলা দায়েরের জন্যও সুপারিশ করেছে তদন্ত কমিটি।
রোববার (১২ মার্চ) বিকেল সাড়ে ৪টার দিকে জেলা প্রশাসনের সম্মেলন কক্ষে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এ বিষয়ে কথা বলেন তদন্ত কমিটির প্রধান ও জেলা প্রশাসনের অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট (এডিএম) মো. আবু সুফিয়ান। এর আগে জেলা প্রশাসক মুহম্মদ শাহীন ইমরানের নিকট তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়া হয়। এ সময় কমিটির অন্যান্য সদস্যবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন।
সংবাদ সম্মেলনে মো. আবু সুফিয়ান বলেন, আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে কিছু সন্ত্রাসী গোষ্ঠী আগুন লাগায়। দুপুর ২টা ৩০ মিনিটে আগুনের সূত্রপাত হয়, যা নিয়ন্ত্রণে আনতে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত সময় লাগে। বালুখালীর ১১নং ক্যাম্পের ১৭নং ব্লক থেকে আগুনের সূত্রপাত হয়। ঘটনায় ২ হাজার ২০০ এর মতো শেল্টার পুড়েছে। ১৫ হাজারের বেশি মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত, প্রায় ২ হাজার স্থাপনার ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। রোহিঙ্গাদের এফসিএন কার্ড পুড়ে যায়। তবে নিহতের খবর পাওয়া যায় নি।
জেলা প্রশাসনের গঠিত ৭ সদস্যের তদন্ত কমিটি ৬ মার্চ থেকে কাজ শুরু করে। কমিটিতে ছিলেন ক্যাম্প ইনচার্জ, এনএসআই উপ-পরিচালক, উপজেলা নির্বাহী অফিসার, এপিবিএন এর অতিরিক্ত পুলিশ সুপার, জেলা পুলিশের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার ও ফায়ার উপসহকারী পরিচালক।
৩ দিনে মোট ৭৫ জনের সাক্ষাৎকার নেয় তদন্ত কমিটি। সেখানে সরকারি -বিসরকারি এনজিও প্রতিনিধি, স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, হোস্ট কমিউনিটি, লার্নিং সেন্টারের ইন্সট্রাক্টরদের বক্তব্য গ্রহণ করা হয়। পত্রিকার রিপোর্ট ও জনশ্রুতিও বিবেচনায় আনা হয়। ৪ পৃষ্ঠার তদন্ত প্রতিবেদনে নানা প্রমাণপত্র হিসেবে ৭৪ পৃষ্ঠা সংযুক্ত করা হয়েছে।
তদন্ত কমিটির করা সুপারিশগুলো হলো:
১. অগ্নিকাণ্ডের ঘটনাটি পরিকল্পিত ও উদ্দেশ্য প্রণোদিত নাশকতা বিবেচনায় একটি মামলা করা যেতে পারে এবং নিয়মিতভাবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর চিরুনি অভিযান পরিচালনা ও গোয়েন্দা তৎপরতা বৃদ্ধি করতে হবে।
২. দশ লক্ষ্যাধিক এফডিএনএনদের জন্য স্বতন্ত্র এক বা একাধিক ফায়ারব্রিগেড ইউনিট এফডিএমএন ক্যাম্প এলাকার কেন্দ্রে স্থাপন করা যেতে পারে; কারণ, আগুনের ঘটনা অনেকটা নিয়মিত।
৩. শেল্টারের ত্রেপল ও বাঁশ ব্যবহারের পরিবর্তে বিকল্প শেল্টার উপকরণ ব্যবহারের বিষয়টি বিশেষভাবে বিবেচনা করা প্রয়োজন যা অপেক্ষাকৃত কম দাহ্য পদার্থের তৈরি।
৪. রোহিঙ্গা ক্যাম্পের প্রতিটি ব্লকে প্রশস্ত রাস্তা নির্মাণের ব্যবস্থা করতে হবে। এতে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী ও ফায়ার সার্ভিসে গাড়ি সহজে চলাচল করতে পারবে।
৫. ক্যাম্পের অভ্যন্তরে যত্রতত্র মার্কেট করা থেকে বিরত থাকতে হবে এবং বড় রাস্তার ধার ব্যতীত অন্যকোন স্থানে দাহ্য পদার্থের আউটলেট করা থেকে বিরত রাখা।
৬. প্রতিটি ব্লকের কেন্দ্রে বা রাস্তার পাশে কংক্রিটের পানির চৌবাচ্চা বা জলাধার নির্মাণ করা এবং বর্তমানে ব্যবহৃত ওয়াটার নেটওয়াক সমূহে হাইড্রেন্ট পয়েন্ট রাখা।
৭. শেল্টার সমূহ অধিক ঘনবসতিপূর্ণ ও অনেক স্থান যানবাহন চলাচলের ক্ষেত্রে অগম্য বিবেচনায় ক্যাম্প সমূহের প্রবেশমূখে ক্যাম্পের একসেস রোড উল্লেখপূর্বক মানচিত্র স্থাপন করা যেতে পারে।
৮. ক্যাম্পে কোথাও আগুন লাগলে রোহিঙ্গারা যেন আগুন নেভাতে স্বতস্ফূর্তভাবে অংশগ্রহণ করতে পারে সে জন্য তাদেরকে নিয়মিত ফায়ার ফাইটিং প্রশিক্ষণ প্রদান করা।
৯. এফডিএমএন ক্যাম্পের ব্লকগুলিতে বিভিন্ন পয়েন্টে ওয়ারলেস টাওয়ার স্থাপন করে সেখানে একইসঙ্গে ৩৬০ ডিগ্রি সিসিটিভি ক্যামেরা স্থাপন করে নজরদারি বাড়ানো যেতে পারে।
১০. এক ক্যাম্পে অপরাধ করে অন্য ক্যাম্পে যাতে পালিয়ে যেতে না পারে সে লক্ষ্যে প্রতিটি ক্যাম্পে পৃথকভাবে কার্যকর নিরাপত্তা বেষ্টনী নির্মাণ করা যেতে পারে।
১১. আগুন এর সূত্রপাত এর সঙ্গে সঙ্গে শেল্টারসমূহ হতে গ্যাস সিলিন্ডার সরিয়ে নেওয়ার বিষয়ে ব্যবস্থা গ্রহণ করা। এছাড়া, স্বাস্থ্য সেবা কেন্দ্রে অক্সিজেন সিলিন্ডার ও এসি সমূহ অগ্নিকাণ্ডের সূত্রপাত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নেওয়ার ব্যবস্থা গ্রহণ করা।
১২. শেল্টার নির্মানের গাইডলাইন অনুযায়ী ক্যাম্প ১১ তে শেল্টার নির্মান করা হয়নি অর্থাৎ এক শেল্টারের থেকে অন্য শেল্টারের ন্যূনতম দুরুত্ব ৬ ফুট থেকে ১০ ফুট রাখার নিয়ম থাকলেও তা মানা হয়নি। ভবিষ্যতে মধ্যমেয়াদী শেল্টার নির্মানের ক্ষেত্রে এই নিয়মসহ শেল্টার নির্মাণের গাইডলাইন ভালোভাবে অনুসরণ করে শেল্টার নির্মাণ করার ব্যবস্থা গ্রহণ করা।
উল্লেখ্য, ২০২১ সালের ২২ মার্চ একই ক্যাম্পে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে ১১ জনের মৃত্যু হয়। রোহিঙ্গা ক্যম্পসমূহে বারবার কেন অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটছে, ভাবিয়ে তুলছে সবাইকে। এসব ঘটনায় বাহিরের কোন শক্তি কাজ করছে কিনা? খতিয়ে দেখার দাবি স্থানীয়দের।