sliderশিরোনামশ্রমিক

পোষ্য কোটা পূর্ণমাত্রায় সংরক্ষণে মহাপরিচালককে রেলওয়ে পোষ্য সোসাইটির আবেদন

রেলওয়ের নিয়োগে পোষ্য কোটার ঐতিহাসিক ও আইনগত গুরুত্ব বিবেচনায় বিদ্যমান ৪০% পোষ্য কোটা পূর্ণমাত্রায় সংরক্ষণে রেলওয়ের মহাপরিচালককে আবেদন জানিয়েছে বাংলাদেশ রেলওয়ে পোষ্য সোসাইটি।

১৩ এপ্রিল (রোববার) সকালে বাংলাদেশ রেলওয়ে পোষ্য সোসাইটির কেন্দ্রীয় সভাপতি মো. মনিরুজ্জামান মনিরের নেতৃত্বাধীন ৫ সদস্যের একটি প্রতিনিধি দল রেল ভবনে রেলওয়ের মহাপরিচালক আফজাল হোসেনের সাথে সাক্ষাৎ করে এই আবেদনপত্র দাখিল করেন।

আবেদনপত্রে বাংলাদেশ রেলওয়ে পোষ্য সোসাইটির পক্ষ থেকে বলা হয়, বাংলাদেশ রেলওয়ে দেশের অন্যতম প্রাচীন ও গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্রায়ত্ত বিশেষায়িত কারিগরি সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান। প্রজন্মের পর প্রজন্ম বাংলাদেশ রেলওয়ের কর্মচারীরা তাঁদের  মেধা, শ্রম, এবং জীবন উৎসর্গ করে রেলওয়ের উন্নয়ন, সুরক্ষা ও পরিচালনা কার্যক্রম অব্যাহত রেখেছেন এবং গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে আসছে। শত বছর ধরে রেলওয়ের কর্মচারীরা সীমাহীন ত্যাগ এবং নিষ্ঠার সাথে দায়িত্ব পালন করছেন। বাংলাদেশ রেলওয়ের পোষ্যরা বিশেষায়িত এই কারিগরি প্রতিষ্ঠানের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। রেলওয়ে কর্মচারীদের আত্মত্যাগ ও ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতায় তাদের সন্তানদের চাকরিতে নিয়োগে নির্দিষ্ট করে রেলওয়ের পোষ্যদের জন্য বিদ্যমান ৪০% নিয়োগ কোটা প্রতিষ্ঠিত হয়, যা শুধু ন্যায্যই নয় বরং নৈতিকতা ভাবেও যথার্থ এবং রেলওয়ের কর্মচারী নিয়োগ বিধিমালা ও সংবিধানের আলোকে বৈধ ও যৌক্তিক।

কিন্তু বর্তমানে রেলওয়ে পোষ্য কোটা বাতিল করার উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে বলে বাংলাদেশ রেলওয়ে পোষ্য সোসাইটির দৃষ্টিগোচর হয়েছে, যা রেলওয়ে শ্রমিক কর্মচারী ও পোষ্যদের মাঝে চরম হতাশা, ক্ষোভ ও নিরাপত্তাহীনতা তৈরি করছে।

রেলওয়ে পোষ্য কোটা বাতিল বা সংকোচন করার আগে এর ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট, আইনগত ভিত্তি ও সামাজিক মূল্যায়ন গভীরভাবে বিবেচনা করা উচিত। শতাব্দীকাল ধরে গড়ে ওঠা একটি মানবিক, সামাজিক ও প্রাতিষ্ঠানিক দায়িত্ববোধের প্রতিফলন। এটি তাদের আত্মত্যাগ ও সেবার আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি। পোষ্য কোটা কেবলমাত্র চাকরির সুযোগ নয়- এটি একটি প্রজন্মের প্রতি প্রতিষ্ঠানের ন্যায্য প্রতিশ্রুতি।

রেলওয়ে পোষ্য কোটার সংক্ষিপ্ত ইতিহাস ও আইনগত প্রেক্ষাপট:-
১. রেলওয়ে পোষ্য কোটার শেকড় খুঁজলে দেখা যায়, রেলওয়ের তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির চাকরি অত্যান্ত কষ্টকর এবং ঝুকিপূর্ণ চাকরি হিসাবে বিবেচিত। কর্মরতদের পরিবার, বিশেষ করে সন্তানদের ভবিষ্যৎ সুরক্ষায় ব্রিটিশ আমল থেকেই রেল কর্মচারীদের সন্তানদের চাকরিতে অগ্রাধিকার দেওয়ার ধারা চালু ছিল, যা পাকিস্তান ও পরবর্তীতে স্বাধীন বাংলাদেশে এই কোটা অব্যাহত থাকে।
২. বিভিন্ন সময়ে ও ১৯৮৫ থেকে সর্বশেষ সংশোধনী বাংলাদেশ রেলওয়ে কর্মচারী নিয়োগ বিধিমালা ২০২০ অনুযায়ী রেলওয়ে নিয়োগে ৪০% পোষ্য কোটা স্পষ্টভাবে পুনঃনির্ধারণ করণের মাধ্যমে সংরক্ষিত করা হয়েছে। এটি প্রাতিষ্ঠানিক নীতির আওতায় বৈধ ও স্বীকৃত একটি ব্যবস্থা, যার ভিত্তিতে রেলওেয়ের অবসরপ্রাপ্ত, মৃত বা কর্মরত কর্মচারীদের সন্তানদের জন্য নিয়োগে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়।
৩. বাংলাদেশ সংবিধানের ২৯(৩) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, রাষ্ট্র বিশেষ গোষ্ঠীর জন্য ন্যায্য সুবিধা সংরক্ষণ করতে পারে— রেলওয়ে পোষ্য কোটা সেই নীতির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ ও পরিপূরক। কারণ এটি একটি নিদিষ্ট জনগোষ্ঠীর (রেলওয়ের কর্মচারীদের পরিবার) ন্যায্য অধিকার রক্ষায় ভূমিকা রাখে।
৪. রেলওয়ে পোষ্য কোটা মানবিক, সামাজিক ও প্রাতিষ্ঠানিক দৃষ্টিকোণ থেকে প্রতিষ্ঠানের প্রতি কর্মচারীদের আস্থার ভিত্তি গড়ে তোলে। পোষ্য কোটা শুধু প্রশাসনিক সুবিধা নয়, বরং এটি একটি স্বীকৃত সামাজিক অধিকার, যা বহু বছর থেকে প্রজন্মান্তরে রেলওয়ে পরিবারে বিশ্বাস আস্থা ও নিরাপত্তা সৃষ্টি করেছে।

কেন পোষ্য কোটার প্রয়োজনীয়তা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ:
১. সামাজিক ন্যায্যতা ও উত্তরাধিকার সংরক্ষণ: রেলওয়ের কর্মীরা আজীবন সীমিত সুযোগ-সুবিধায় কঠোর পরিশ্রম করেছেন। তাঁদের সন্তানদের জন্য একটি ন্যূনতম চাকরির সুযোগ রাখা সামাজিক ন্যায্যতা নিশ্চিত করে।
২. রেলওয়ের সংস্কৃতি ও দক্ষতা রক্ষা: পোষ্যরা ছোটবেলা থেকেই রেলওয়ের পরিবেশে বেড়ে উঠে থাকায়, তাঁরা এর কার্যক্রম, শৃঙ্খলা ও ঝুঁকিপূর্ণ পরিবেশ সম্পর্কে বাস্তব অভিজ্ঞতাসম্পন্ন। ফলে, পোষ্যদের নিয়োগে প্রতিষ্ঠান দক্ষ, বিশ্বস্ত ও দায়িত্বশীল কর্মী পায়।
৩. মানসিক ও মানবিক দিক: দীর্ঘ সময়ের রেল কর্মজীবনের পর একজন অবসরপ্রাপ্ত কর্মচারী আশা করেন তাঁর সন্তান অন্তত একটি সম্মানজনক স্থানে কাজ করবে। এই প্রত্যাশা মুছে দিলে তা কেবল পরিবারে নয়, গোটা রেল পরিবারে মানসিক ভাঙন তৈরি করবে।
৪. অবদান ও আত্মত্যাগের স্বীকৃতি: দুর্ঘটনা, ঝুঁকি ও চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়ে যাঁরা রেলওয়ের চাকরি করেছেন, তাঁদের অবদানের ন্যূনতম স্বীকৃতি হল এই কোটা ব্যবস্থা। এটি বাতিল করা মানে তাঁদের আত্মত্যাগকে অস্বীকার করা।
৫. প্রতিষ্ঠানের প্রতি আস্থা বজায় রাখা: পোষ্য কোটা অব্যাহত রাখলে কর্মরত কর্মচারীদের মধ্যেও একটি আস্থা ও প্রেরণা বজায় থাকে যে, তাঁদের পরিবার রেলওয়ের ছায়াতলে সুরক্ষিত থাকবে।

রেলওয়ের সার্বক্ষণিক ডিউটির বাস্তবতা, পোষ্যদের মানসিক প্রস্তুতি এবং বহিরাগত নিয়োগপ্রাপ্তদের চাকরি ত্যাগের প্রবণতা:
বাংলাদেশ রেলওয়ে একটি উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ, সময়-নিয়ন্ত্রিত এবং জরুরি সেবামূলক প্রতিষ্ঠান। এর কর্মীদের দায়িত্ব কেবল অফিস সময়ে সীমাবদ্ধ নয় বরং প্রকৃতপক্ষে সার্বক্ষণিক (২৪ ঘণ্টা) ডিউটি নিশ্চিত করতে হয়। এই বাস্তবতা রেলওয়ের কর্মপরিকল্পনা, অপারেশন ও নিরাপত্তার জন্য অপরিহার্য।

এমন একটি কর্মপরিবেশে যাদের পরিবার রেলওয়েতে কাজের সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত ছিল—অর্থাৎ রেলওয়ে পোষ্যরা—তারা পরিবার থেকেই এই ধরনের দায়িত্ব, চাপ ও কাজের ধরন সম্পর্কে বাস্তবিক ধারণা নিয়ে বড় হন। ফলে, পোষ্যরা রেলওয়ের চাকরিকে শুধু একটি চাকরি নয়, বরং একটি জীবনধারা ও দায়িত্ব হিসেবে বিবেচনা করেন।

অন্যদিকে, বহিরাগত নিয়োগপ্রাপ্ত ব্যক্তিরা রেলওয়ের জটিল ও সার্বক্ষণিক শিডিউলভিত্তিক কাজের বাস্তবতা সম্পর্কে অবগত না থাকায় অনেকেই কয়েক মাসের মধ্যেই চাকরি ছেড়ে দেন। এতে নিয়োগ প্রক্রিয়ায় সময়, অর্থ ও প্রশাসনিক কাঠামোর ক্ষতি হয়।

মূল সমস্যা:
১. রেলওয়ে চাকরির প্রকৃতি:
ডিউটি সময় অনির্ধারিত, রাত-দিন, ছুটির দিনেও কাজ চালু থাকে।  অপারেশনাল অফিসারদের সময় নির্ধারিত নয়।
২. পোষ্যদের মানসিক প্রস্তুতি:
তারা শৈশব থেকে পরিবারে রেলওয়ের শৃঙ্খলা, জীবনযাত্রা ও ঝুঁকিপূর্ণ কাজের মধ্যে বড় হয়ে ওঠে—যা কর্মদক্ষতায় ও দায়িত্ববোধে প্রতিফলিত হয়।
৩. বহিরাগতদের প্রস্তুতির অভাব:
অধিকাংশ বহিরাগত প্রার্থী রেলওয়ের চাকরিকে অন্যান্য ৯টা-৫টার সরকারি চাকরির মতো ভাবেন। ফলে বাস্তব পরিস্থিতি বুঝে তারা চাকরি ত্যাগ করে থাকেন।
৪. বারবার নিয়োগ প্রক্রিয়া ও কর্মক্ষেত্রে স্থবিরতা:
রেলওয়ের বিভিন্ন পদে বারবার নিয়োগ দিতে হচ্ছে, যা সিস্টেমকে ব্যাহত করে এবং দক্ষ জনশক্তির ঘাটতি তৈরি করে।
৫. প্রকৃত যোগ্যতাসম্পন্ন প্রার্থীরা বঞ্চিত হচ্ছে:
রেলওয়ের তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির নিয়োগ সার্কুলারে স্পষ্টভাবে এসএসসি ও এইচএসসি পাশ শিক্ষাগত যোগ্যতা নির্ধারণ করা হলেও, অনেক ডিগ্রি, অনার্স ও মাস্টার্স পাশ প্রার্থী এসব পদে আবেদন করে এবং মেধাতালিকায় নির্বাচিত হন। এতে প্রকৃত যোগ্যতা সম্পন্ন  (এসএসসি ও এইচএসসি) প্রার্থীরা অন্যায্য প্রতিযোগিতার মুখে পড়ে সুযোগ থেকে বঞ্চিত হন।

বাংলাদেশ রেলওয়ে পোষ্য সোসাইটির দাবি:

১. রেলওয়ে পোষ্য কোটার বহাল রাখতে:
পোষ্যদের জন্য নিয়োগ প্রক্রিয়ায় পূর্বের ৪০% কোটা বহাল রেখে দক্ষ ও মানসিকভাবে প্রস্তুত কর্মী সরবরাহ নিশ্চিত করা হোক।

২. অবসরপ্রাপ্ত কর্মচারীদের সন্তানদের অগ্রাধিকার:
রেলওয়ের অভিজ্ঞতা-সম্পন্ন পরিবার থেকে আগত প্রার্থীদের অগ্রাধিকার দিয়ে পেশাগত দায়বদ্ধতা বজায় রাখা সম্ভব হবে।

রেলওয়ে একটি নিবেদিত, ধৈর্য ও মনোযোগনির্ভর কাজের ক্ষেত্র। যারা এই বাস্তবতায় অভ্যস্ত—যেমন রেলওয়ে পোষ্যরা—তাদের নিয়োগে সুযোগ দেওয়া হলে প্রতিষ্ঠানটি লাভবান হবে। অন্যদিকে, দায়িত্ব সম্পর্কে অনাবগত বহিরাগতদের নিয়োগে প্রতিষ্ঠান বারবার লোকসানে পড়ছে। তাই এই বাস্তবতা বিবেচনায় এনে রেলওয়ে পোষ্যদের জন্য কোটা বহাল রাখার বিষয়টি সময়োপযোগী ও যৌক্তিক বলে বিবেচিত হওয়া উচিত।

বাংলাদেশ রেলওয়ে পোষ্যদের জন্য বিদ্যমান ৪০% নিয়োগ কোটা বিলুপ্ত বা সংকোচন না করে পূর্বের মতো পূর্ণমাত্রায় সংরক্ষিত বা বহাল রাখা হোক এবং এ সংত্রুান্ত কোনো বিধিমালা সংশোধন বা পরিবর্তনের পূর্বে বাংলাদেশ রেলওয়ে পোষ্য সোসাইটিসহ সংশ্লিষ্ট পক্ষের সাথে আলোচনা করে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হোক। পোষ্যদের ন্যায্য অধিকার নিশ্চিত করতে রেলপথ মন্ত্রণালয় ও বাংলাদেশ রেলওয়ে পোষ্য সোসাইটিসহ রেলওয়ের সকল ট্রেড ইউনিয়নের মধ্যে সমন্বয় জোরদার করতে হবে।

রেলওয়ে পোষ্য কোটা শুধু একটি নিয়োগ সুবিধা নয়— এটি একটি প্রজন্মের সম্মান, আত্মত্যাগের স্বীকৃতি এবং প্রতিষ্ঠানিক শৃঙ্খলার প্রতীক। এই বিষয়টি সর্বোচ্চ গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করে রেলওয়ে পোষ্যদের ৪০% নিয়োগ কোটার প্রাপ্য সুযোগ সংরক্ষিত রেখে রেলওয়ে কর্মচারী ও পোষ্যদের একটি ইতিবাচক বার্তা পৌঁছে দিতে রেলওয়ে মহাপরিচালক প্রয়োজনীয় নির্দেশনা প্রদানের ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন বলে রেলওয়ে পোষ্য সোসাইটির পক্ষ থেকে আবেদনে প্রত্যাশা করা হয়।

প্রেস বিজ্ঞপ্তি

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button