
ভারত ও বাংলাদেশের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের মধ্যে সবচেয়ে বেশিদিন ধরে অস্বস্তির কারণ হয়ে থেকেছে যে বিষয়টি, সেটি নিঃসন্দেহে ফারাক্কা বাঁধ। ভারতে এটির পোশাকি নাম ‘ফারাক্কা ব্যারাজ প্রজেক্ট‘ এবং বহু আলোচনা ও বিতর্ক পেরিয়ে চলতি বছরের এই মে মাসে প্রকল্পটি পঞ্চাশ বছর পূর্ণ করছে।
বিগত অর্ধশতাব্দী ধরে ফারাক্কা নিয়ে বাংলাদেশের প্রধান অভিযোগ ছিল এই ফারাক্কার ফলেই প্রমত্তা পদ্মা শুকিয়ে গেছে। অন্যদিকে ভারত বরাবর যুক্তি দিয়ে এসেছে যে কলকাতা বন্দরকে রক্ষা করার জন্য ফারাক্কা ছাড়া কোনো উপায় ছিল না!
ফারাক্কা চালু হওয়ার দু‘দশকেরও বেশি সময় পর ১৯৯৬তে ভারত ও বাংলাদেশ যে ঐতিহাসিক গঙ্গা পানি চুক্তি স্বাক্ষর করে, তাতে অবশ্য ভাগীরথী ও পদ্মায় গঙ্গার পানি ভাগাভাগি নিয়ে একটা ফর্মুলায় দুই দেশ একমত হতে পেরেছিল।
৩০ বছর মেয়াদি সেই চুক্তির কার্যকালও প্রায় শেষের পথে, চুক্তির নবায়ন নিয়ে আলোচনাও শুরু হয়েছে। তবে ফারাক্কা নিয়ে বিতর্ক, বিরোধ বা দোষারোপের পালা কখনোই থামেনি।
ফারাক্কার জন্যই পদ্মার দু‘কূলে মানুষের জীবন-জীবিকা আজ বিপন্ন বলে যেমন বাংলাদেশের অভিযোগ – তেমনি ভারতেও ফারাক্কার সমালোচনা কম নয়।
যেমন মাত্র কয়েক বছর আগেই ফারাক্কা ব্যারাজ ভেঙে দেয়ারও দাবি তুলেছিল বিহার সরকার। রাজ্যটির অভিযোগ, প্রতি বছর ফারাক্কার কারণেই তাদের বন্যায় ভুবতে হয়। ফারাক্কার উজানে ও ভাঁটিতে গঙ্গার ভাঙনও ওই এলাকার মানুষের জন্য খুব বড় সমস্যা।
তাছাড়া অনেক বিশেষজ্ঞই মানেন যে কলকাতা বন্দরকেও সেভাবে বাঁচাতে পারেনি ফারাক্কা – যে কারণে উপকূলের কাছে তৈরি করতে হয়েছিল আর একটি স্যাটেলাইট বন্দর হলদিয়া।
তাহলে আজ ৫০ বছর পরে এসে ফারাক্কার ভবিষ্যৎ নিয়ে ভারত ঠিক কী ভাবছে? পাশাপাশি ফারাক্কা প্রকল্পটাতেই বা তখন ঠিক কী করা হয়েছিল এবং সেগুলো কী ধরনের বিতর্ক সৃষ্টি করেছে?
ফারাক্কা ব্যারাজ প্রোজেক্ট (এফবিপি)-এর সার্ধশর্তবর্ষপূর্তিতে সরেজমিনে ফারাক্কা ও আশেপাশের এলাকায় এবং কলকাতা বন্দরে গিয়ে ঠিক এই বিষয়গুলোতেই নজর দেয়া হয়েছে। এই প্রতিবেদনে থাকছে তারই সারাংশ।
ফারাক্কা প্রকল্পটা আসলে ঠিক কী?
এক কথায় বলতে গেলে, ফারাক্কা হলো গঙ্গায় বাঁধ দিয়ে ও কৃত্রিম খাল কেটে পদ্মার দিক থেকে পানির প্রবাহ ভাগীরথীর দিকে সরিয়ে আনা – যাতে কলকাতা বন্দরকে বাঁচিয়ে রাখা যায়!
স্বাধীন ভারতে ১৯৬১ সালে অবশেষে সেই প্রকল্পের কাজ শুরু হয়, আর ১৯৭৫ সালে এসে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী জাতির উদ্দেশে উৎসর্গ করেন ফারাক্কা ব্যারাজ।
ফারাক্কার কাজ যখন শুরু হয়, তখন গঙ্গার ভাঁটিতে ছিল ‘শত্রু দেশ‘ পূর্ব পাকিস্তান। কিন্তু রাতারাতি সেখানে একটি ‘বন্ধু দেশ‘ চলে আসার ফলে ফারাক্কায় একতরফাভাবে গঙ্গা থেকে পানি প্রত্যাহার ভারতের জন্য বিড়ম্বনার কারণ হয়ে উঠেছিল।
যদিও অবশেষে ১৯৭৫-এর গোড়ায় এসে ইন্দিরা গান্ধী শেখ মুজিবের সাথে একটা বোঝাপড়ায় আসতে সক্ষম হন – ঠিক হয় এপ্রিল-মে মাসে প্রতি দশদিন অন্তর গঙ্গা থেকে পরীক্ষামূলকভাবে নির্দিষ্ট পরিমাণ পানি সরানো হবে। সেই ‘পরীক্ষা‘ অবশ্য পরেও আরও বহু বছর ধরে চলতে থাকে।
সে বছরের মে মাসেই আনুষ্ঠানিকভাবে ফারাক্কার উদ্বোধন করেন দেশের সেচমন্ত্রী জগজীবন রাম, পরবর্তী পঞ্চাশ বছরে যা কয়েক কোটি কিউসেক বাড়তি পানি কলকাতায় এনে ফেলেছে!
ভূতাত্ত্বিক ও নদী গবেষক ড: পার্থসারথি চক্রবর্তী বলছিলেন, ‘কলকাতা বন্দরে ১৯৬০ সাল পর্যন্ত আমাদের নাব্যতা (নেভিগেবিলিটি) ছিল, ২৬ ফুট ড্রাফট ছিল। তাতে ২৯১ দিন এই বন্দরে জাহাজ ঢুকত, মানে ওই ২৬ ফুট ড্রাফটের জাহাজ ঢুকত। ১৯৬০ সালের পর থেকে মারাত্মক অবস্থা হয়।‘
‘এখন এই ফারাক্কা অঞ্চল কেন? ফারাক্কা অঞ্চলকে ব্যারাজ করার জন্য বাছা হলো, তার কারণ সেখানে ১০০ বছরের মধ্যে নদী নড়াচড়া করেনি, তার ব্যাঙ্কের মধ্যেই ছিল। ওই ব্যারাজটা ওইখানে করলে পানি ব্যারাজটার ঠিকমতো স্টেবিলিটি থাকবে।‘
তিনি আরও জানাচ্ছেন, ফারাক্কায় এমন ব্যবস্থা নেয়া হয়েছিল, যাতে কলকাতায় সম্পূর্ণ ‘সিল্ট-ফ্রি‘ বা পলিমুক্ত পানি সরবরাহ করা যায়।
‘তার জন্য ওখানে ‘ছাঁকনি‘ দেয়া আছে, যে কারণে ফারাক্কার পানি কলকাতায় পানীয় পানি হিসেবেও সাপ্লাই দেয়া হয়‘, বলছিলেন চক্রবর্তী। ফলে ১০০০ মাইলেরও বেশি পথ পেরিয়ে উত্তর ভারতের ‘লাইফলাইন‘ গঙ্গা ফারাক্কাতে এসে ব্যারাজের বাধায় বাঁধা পড়েছে। আর সেখানে মোট ১০৯টি লকগেটেই নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে নদীর পানির প্রবাহ।
আর ফারাক্কাতে নদীর ডান দিক থেকে কাটা হয়েছে ৩৮.৩ কিলোমিটার লম্বা ভাগীরথী ফিডার ক্যানাল, যা জঙ্গীপুরের কাছে ভাগীরথীতে গিয়ে মিশেছে। পরে সেই নদী হুগলী নামে পরিচিতি পেয়েছে।
এককালের ছোট্ট গ্রাম ফারাক্কাকে কেন্দ্র করে তৈরি হয়েছে একটি আধুনিক উপনগরী, পশ্চিমবঙ্গের উত্তর ও দক্ষিণপ্রান্তের মধ্যে রেল ও সড়ক যোগাযোগও স্থাপন করেছে ব্যারাজের ওপর দিয়ে তৈরি ট্রেনলাইন ও রাস্তা।
ক্যানালের পানিতে প্রচুর মাছ ধরা পড়ে, এমনকি ইলিশও! ভারতে হলদিয়া থেকে এলাহাবাদ পর্যন্ত বিস্তৃত ‘১ নম্বর জাতীয় পানিপথে‘রও অতি গুরুত্বপূর্ণ অংশ এই ক্যানাল।
আশির দশকে ফারাক্কাতে এনটিপিসি-র যে তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র গড়ে তোলা হয়, তারাও ব্যবহার করে এই ক্যানালের পানি। ভাঁটির দিকে মুর্শিদাবাদের সাগরদীঘিতে পশ্চিমবঙ্গ সরকারও একটি তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপন করেছে, তারাও এই পানির ওপর নির্ভরশীল।
সব মিলিয়ে ফারাক্কা শুধুমাত্র একটি বাঁধ ও খালই নয়, এই প্রকল্পকে ঘিরে গত পঞ্চাশ বছরে একটা বিরাট ক্যানভাসই আঁকা হয়ে গেছে বলা চলে – যাকে বিশেষজ্ঞরা ‘ফারাক্কা ইকোসিস্টেম‘ নামে বর্ণনা করে থাকেন।
ফারাক্কা নিয়ে ভারতেও এতো বিতর্ক কেন?
ফারাক্কার প্রায় জন্মলগ্ন থেকেই এই প্রকল্পের কার্যকারিতা নিয়ে ভারতেও অনেক বিশেষজ্ঞ সন্দিহান ছিলেন। তবে কলকাতা বন্দরকে বাঁচানোর যুক্তিটা এতটাই প্রবল ছিল যে সেই সব আপত্তি টেঁকেনি।
পশ্চিমবঙ্গ সরকারের সেচ বিভাগের শীর্ষস্থানীয় প্রকৌশলী কপিল ভট্টাচার্য তো ফারাক্কার বিরোধিতা করে সরকারি চাকরিও ছেড়ে দিয়েছিলেন।
ফারাক্কা প্রকল্প কেন বিপজ্জনক, তার পক্ষে যুক্তি দিয়ে তিনি অনেক লেখালেখিও করেছেন। পরবর্তী জীবনে কপিল ভট্টাচার্য অ্যাক্টিভিস্টে পরিণত হন, যুক্ত ছিলেন মানবাধিকার সংগঠন এপিডিআরের সঙ্গেও।
১৯৮৯ সালে ভট্টাচার্যের মৃত্যুর ২৭ বছর পর ২০১৬ সালে বিহারের রাজ্য সরকার ফারাক্কা বাঁধ ‘তুলে দেয়ার জন্য‘ কেন্দ্রের কাছে আনুষ্ঠানিক দাবি জানায়।
তখন বিহারের মুখ্যমন্ত্রী নীতীশ কুমার প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সাথে দেখা করে যুক্তি দিয়েছিলেন, ফারাক্কার জন্যই তার রাজ্য প্রতি বছর বন্যায় ভেসে যাচ্ছে। অতএব বাঁধটাই তুলে দেয়া হোক!
নীতীশ কুমার তখন প্রকাশ্যেই সাংবাদিকদের বলেছিলেন, ‘গঙ্গায় খুব বেশি পলি পড়ছে বলেই এই পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। আর যখন থেকে ফারাক্কা বাঁধ তৈরি হয়েছে তখন থেকেই এই অবস্থা। নইলে আগে নদীর প্রবাহের সাথে অনেকটা পলি বঙ্গোপসাগরে চলে যেত, সমুদ্রে গিয়ে মিশতো।‘
১০-১২ বছর ধরে ফারাক্কার ‘প্যাটার্ন‘ স্টাডি করেই এ মন্তব্য করছেন, তখন এ কথাও জানিয়েছিলেন তিনি।
নীতীশ কুমার আজো বিহারের মুখ্যমন্ত্রী, তবে যেকোনো কারণেই হোক ফারাক্কা বিরোধিতার সুর তিনি অনেক স্তিমিত করে ফেলেছেন। এই মুহুর্তে তিনি ক্ষমতাসীন বিজেপির রাজনৈতিক সঙ্গীও।
তবে ফারাক্কার উজানে ঝাড়খন্ড-বিহারের সীমান্ত এলাকায় গিয়েও দেখেছি, সেখানে আমজনতারও এই বাঁধকে নিয়ে বিস্তর অভিযোগ – বর্ষাতে যেমন, তেমনি শুকনা মৌসুমেও!
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড: সুমনা বন্দ্যোপাধ্যায় ফারাক্কা অঞ্চলে বাঁধের প্রভাব নিয়ে ফিল্ড স্টাডি ও গবেষণা করেছেন – এ ব্যাপারে তারও মিশ্র অভিজ্ঞতা।
‘ফারাক্কায় নদীর বুকেও চর পড়েছে, মাঝনদীতে বক দাঁড়িয়ে আছে এটাও যেমন দেখেছি – তেমনি গঙ্গার বিধ্বংসী ভাঙনে পাড়ের মানুষের জীবন ছারখার হয়ে যেতেও দেখেছি‘, বলছিলেন তিনি।
সুমনা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথায়, ‘এই নদীর যে প্যাটার্নের চেঞ্জটা, ইটসেল্ফ নদীটার মধ্যে, তার দুই পারে সবটারই ওপরে একটা ইমপ্যাক্ট ফেলেছে ফারাক্কা ব্যারাজ। ডেফিনিটলি। তার পজিটিভগুলো আমরা পেয়েছি, নেগেটিভগুলোও আমরা দেখতে পাচ্ছি।‘
ফারাক্কাতে তার শেষ ফিল্ড স্টাডিতে স্থানীয় গ্রামবাসীরা ফারাক্কা বাঁধকে তুলনা করেছিলেন একটা সাপের মাথা চেপে ধরার সঙ্গে!
‘এমনিভাবে দেখাল যে একটা সাপ রয়েছে তার মুখটা আপনি চেপে ধরলেন – মানে মাথাটা, তাহলে সে তো দেখবেন ছটফট করছে বেরোনোর জন্য।‘
‘অ্যাজ ইফ ব্যারাজটা যেন একটা সাপের মুখটা চেপে ধরার মতো জিনিস এবং নদী তখন, নদীর কোর্সটা তো পাল্টাচ্ছে। সে আর একভাবে যেতে পারছে না, সে যেহেতু রেস্ট্রিক্টেড, বাউন্ডেড … তাই সে আরো বেশি করে … প্যাটার্নটা, কার্ভসগুলো আরো বেশি হচ্ছে, ছটফট করার মতো … ওরা সুন্দর একটা এক্সপ্ল্যানেশন দিয়েছিল‘, জানাচ্ছেন তিনি।
ফারাক্কার নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি আবার জানাচ্ছেন, নদীর ভাঙন ঠেকাতে না পারলে ফারাক্কা অচিরেই তাদের জন্য চরম সর্বনাশ ডেকে আনবে!
ফারাক্কা আসনের এমএলএ (বিধায়ক) মনিরুল ইসলাম বলছিলেন, ‘ফারাক্কার জন্য আমাদের যোগাযোগ ব্যবস্থাটা অবশ্যই ভাল হয়েছে। উত্তরবঙ্গের সাথে দক্ষিণবঙ্গের মেলবন্ধন এটা তৈরি করেছে ঠিক। কিন্তু আমাদের আপিল কি গঙ্গার ড্রেজিং-টা করে দিলে আমরা কিন্তু বিপদমুক্ত হব আর কী!‘
‘এই ড্রেজিং না করলে আগামী পঞ্চাশ বছর বলছেন কেন, অল্প কিছুদিনের মধ্যেই আমরা নদীর গর্ভে চলে যাব। তো আমাদের কাছে ব্যারাজ একরকম অভিশাপের কারণ হয়েও দাঁড়িয়ে গেছে আর কী!‘
তিনি আরো বলছিলেন, ‘মুর্শিদাবাদের মোরগ্রাম থেকে নিয়ে আপনার মালদা পর্যন্ত আমাদের এই ভৌগোলিক অবস্থানটা দেখবেন – আমরা একটা সরু রাস্তার ওপর বাস করছি। ওদিকে ঝাড়খন্ড, এদিকে নদী, বাংলাদেশ – এইটুকুনটা!‘
‘তাই আমাদের হাজার হাজার একর যে নদীর গর্ভে গিয়েছে, মাঝনদীটাকে যদি ড্রেজিং করে পাথর দিয়ে বেঁধে দেয় আর কী, তাহলে অনেক লোক ওখানে চাষবাস করে, বাড়িঘর করে থাকতে পারবে‘, কেন্দ্রের কাছে দাবি জানান তিনি।
তবে ফারাক্কা নিয়ে এরকম অনেক বিতর্ক থাকলেও বাঁধ তুলে দেয়ার প্রস্তাব নিয়ে কাজ বিশেষ এগোয়নি!
ফারাক্কা বাঁধ ‘ডিকমিশন‘ করতে নীতিশ কুমার প্রস্তাব দেয়ার পর দেশের পানিসম্পদ মন্ত্রণালয় একটি বিশেষজ্ঞ কমিটিও গঠন করেছিল – যাতে কেন্দ্রের তরফে পাঁচজন আর বিহার সরকারের তরফে পাঁচজন সদস্য ছিলেন।
সেই কমিটিতে বিহারের অন্যতম প্রতিনিধি হিসেবে ছিলেন দেশের সুপরিচিত নদী বিশেষজ্ঞ ও গবেষক হিমাংশু ঠক্কর।
ঠক্কর বিবিসিকে বলছিলেন, ‘আমাদের দায়িত্ব ছিল ফারাক্কা বিহারের ওপর ঠিক কী প্রভাব ফেলেছে, তা নিরূপণ করা।‘
‘কিন্তু ফারাক্কা হওয়ার আগে ও পরে নদীতে ড্রেইনেজ কনজেসশন কী, বন্যার তীব্রতা ও কত ঘন ঘন বন্যা হয়েছে, নদীর ধারণক্ষমতা কত, সে সব ব্যাপারে সেন্ট্রাল ওয়াটার কমিশন আমাদের কোনো তথ্য-উপাত্তই দেয়নি। ফলে আমরাও কোনো সিদ্ধান্তে আসতে পারিনি।‘
তবে ফারাক্কার ‘বিরূপ প্রভাব‘ যে গোটা এলাকায় পড়েছে তাতে ঠক্করের কোনো সন্দেহ নেই, নীতিশ কুমারের প্রস্তাবেও যথেষ্ঠ যুক্তি ছিল বলে তিনি মনে করেন।
আগামী পঞ্চাশ বছরে ফারাক্কার ভবিষ্যৎ কী?
ফারাক্কা থেকে টানা ফিডার ক্যানালে শুষ্ক মৌসুমে কতটা পানি টানা যাবে, আর মূল নদী দিয়ে পদ্মায় কতটা পানি ছাড়া হবে – ১৯৯৬ সালে স্বাক্ষরিত গঙ্গা চুক্তির মূল কথা সেটাই।
এখনকার চুক্তি বলছে, প্রতি বছরের ১ জানুয়ারি থেকে ৩১ মে – এই শুকনা মৌসুমের সময়টায় প্রথম দশদিন ক্যানাল আর পরের দশদিন করে পদ্মা অন্তত ৩৫০০০ কিউসেক পরিমাণ পানি পাবেই (‘অ্যাশিওর্ড অ্যামাউন্ট‘ বা প্রতিশ্রুত পরিমাণ)।
এই পানির প্রবাহ ঠিকঠাক যাচ্ছে কিনা, তা দেখার জন্য ব্যারাজ থেকে কয়েক শ’ মিটার দূরে ভাঁটির দিকে মনিটরিং স্টেশন-ও আছে, যেখানে ভারত ও বাংলাদেশের প্রকৌশলীরা একসঙ্গে সার্বক্ষণিক অবস্থান করেন।
ঠিক একই ধরনের যৌথ মনিটরিং স্টেশন আছে বাংলাদেশের দিকে পদ্মার ওপরে হার্ডিঞ্জ ব্রিজের কাছেও।
এখন আগামী বছর (২০২৬) কোন শর্তে সেই গঙ্গা চুক্তির নবায়ন হয় – বা আদৌ হয় কিনা – যথারীতি তার ওপরও অনেকটা নির্ভর করছে ফারাক্কার ভবিষ্যৎ।
ফারাক্কা উপনগরী লাগোয়া পলাশিগ্রামের বাসিন্দা তপন মিশ্র বলছিলেন, ‘অনেক কিছু থেকে সুবিধা হয়েছে। যেমন কৃষকরা পানি পাচ্ছে, জেলেরা মাছ ধরে দুটো খেতে পাচ্ছে।‘
‘এই বাঁধ হওয়াতে এখানে শহর তৈরি হয়েছে মোটামুটি ছোটমোট একটা, কেউ বিজনেস করে খাচ্ছে, কেউ চাকরি করে খাচ্ছে … দূর দূর ঝাড়খন্ড-ফাড়খন্ড কোথায় বন্যা হচ্ছে ওটা তো ধরলে চলবে না! ভালো হয়েছে, খারাপ হয়নি!‘
ফারাক্কা ব্রিজ হওয়ায় স্থানীয় মৎস্যজীবী খগেন প্রামাণিকের আবার খুব সুবিধা হয়েছে দূরদূরান্তে মাছের চালান পাঠাতে।
তিনি পাশ থেকে যোগ করেন, ‘এই গঙ্গায় যে ব্রিজটা হওয়া, ব্রিজটা হওয়াতে কি উত্তরবঙ্গের সাথে দারুণ যোগাযোগ হয়ে গেছে – এইটা মেইন মেরুদন্ড হয়ে গেছে উত্তরবঙ্গের জন্য!‘
‘আগে এখানে সকালে নৌকাতে চাপলে দুপুর, বৈকালে গিয়ে পৌঁছাত ওপারে – সেই জিনিসটা এখন আর নেই!‘
ফারাক্কার ‘হিউম্যান জিওগ্রাফি‘ নিয়ে কাজ করেছেন যে গবেষকরা, তারা অবশ্য নিশ্চিত নন সাধারণ লোকের ভাবনা প্রকল্পে কতটা গুরুত্ব পেয়েছে।
সুমনা বন্দ্যোপাধ্যায় যেমন বলছিলেন, ‘আমার রেজিলিয়েন্স বিল্ডিংয়ের মধ্যে যদি আমি মানুষের মতামত, তাদের চোখে দেখা বা তাদের এক্সপেরিয়েন্স – কিভাবে তারা দেখছে নদীটাকে, সেটা যদি আমরা না ধরতে পারি, তাহলে কিন্তু একটা গ্যাপ রয়ে গেল।‘
‘আর যেটা আপনি বলছেন যে পঞ্চাশ বছর পরে কী হবে, এই গ্যাপটা আগাগোড়া রয়েই গেছে। আমরা কখনো দেখছি না এই রেজিলিয়েন্স বিল্ডিংয়ের মধ্যে মানুষকে ইনভলভ করা হচ্ছে বা কমিউনিটিগুলোকে ইনভলভ করা হচ্ছে।‘
তিনি আরো মনে করেন, ফারাক্কাকে ঘিরে যে প্রযুক্তিগত সমাধানগুলো ভাবা হয়েছে – কত বছর তার মেয়াদ, বা তার পরে কী হবে – এগুলো নিয়ে একটা অস্পষ্টতা আছেই, আর সেখানে স্বাভাবিকভাবেই মানুষের সাথে প্রোজেক্টের একটা দূরত্ব তৈরি হয়েছে। কারণ এটা একটা শক্তিশালী নদী, সেটাও তো আমাদের মেনে নিতে হবে যে তার একটা ন্যাচারাল প্রসেস বা স্বাভাবিক গতি ও ছন্দ আছে! সেটা গ্রামের মানুষ যেভাবে বুঝছে আমরা বুঝছি না‘।
আবার এই প্রেক্ষাপটেই কোনো কোনো পর্যবেক্ষক মনে করেন, বাঁধটা বর্তমান আকারে আর না রাখলেও চলে!
হিমাংশু ঠক্কর বলছিলেন, ‘আমেরিকা, ইউরোপ ও সারা দুনিয়াজুড়ে অজস্র বাঁধের ডিকমিশনিং হচ্ছে। শুধু আমেরিকাতেই গত ৩০ বছরে ২০০০রও বেশি ড্যাম ডিকমিশন করা হয়েছে, ইউরোপেও হয়েছে শত শত। তবে এটাও ঠিক যে গঙ্গার মতো বিশাল একটা নদীতে কোনো ড্যাম ডিকমিশন করার পূর্ব অভিজ্ঞতা তেমন নেই। তবে তার পরেও কাজটা খুবই সম্ভব। আর নানাভাবেই এই ডিকমিশনিং করা যায়।‘
এখানে তিনি প্রস্তাব দিচ্ছেন ‘অপারেশনাল ডিকমিশনিং‘-এর, অর্থাৎ ব্যারাজের ওপরে ট্রান্সপোর্ট লিঙ্কটা রেখে গেটগুলো সব খুলে রাখার বা তুলে দেয়ার, যাতে রেল ও সড়ক সংযোগ রেখেও নদীকে স্বাভাবিকভাবে বইতে দেয়া যায়।
‘পাশাপাশি ক্যানালটা এখন যে সুবিধাগুলো দিচ্ছে, সেটা কিভাবে বজায় রাখা যায় তাও দেখতে হবে। এতে কী হবে, ড্যামের মূল কাঠামোটা অক্ষত রেখেও ফারাক্কার অপারেশনাল ডিকমিশনিং করা যাবে।’
ফারাক্কার ক্ষেত্রে ঠিক কী করা হবে আর কখন, সেই সিদ্ধান্ত নেয়ার দায়িত্ব ভারতের পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের – কিন্তু সেই লক্ষ্যে নির্দিষ্ট ভাবনাচিন্তা শুরু হয়েছে বলে এখনো কোনো প্রমাণ নেই।
ফারাক্কা ব্যারাজ কর্তৃপক্ষ দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করেন, এই প্রকল্পের উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ নিয়ে সংশয়ের কোনো কারণই নেই।
ফারাক্কা ব্যারাজ প্রকল্পের মহাপরিচালক আর ডি দেশপান্ডে বলছিলেন, ‘দেখুন, এটা তো শুধু একটা ডাইভারশান বা পানি টানার প্রকল্প। এখানে তেমন স্টোরেজ বা জলাধার কিছু নেই।‘
‘স্টোরেজ প্রকল্পগুলোর আয়ু হয়তো ১০০ বছর হয়। কারণ পলি পড়ে তার ধারণক্ষমতা পূর্ণ হয়ে যায়। ফারাক্কায় সে সমস্যা নেই, ফলে এটা অনায়াসে ১০০ বছরেরও বেশি টিঁকতে পারে।‘
তবে তিনি স্বীকার করেন ফিডার ক্যানালের বেড (খাত) আর দু‘পারের ক্ষয় ও ভাঙন একটা বড় সমস্যা, যেটা হয়তো ‘ক্রস রেগুলেটরে‘র মতো কিছু বসিয়ে আগামী কয়েক বছরের মধ্যেই মোকাবিলা করতে হবে।
‘কিন্তু ফারাক্কা বাঁচবেই, বাঁচাতেই হবে। কারণ কলকাতা শহর, কলকাতা বন্দর আর গত পঞ্চাশ বছরে নদীকে ঘিরে যে ইকোসিস্টেম তৈরি হয়ে গেছে তাকে রক্ষা করতে হলে ফারাক্কাই একমাত্র ভরসা‘, খুব আত্মবিশ্বাসী ভঙ্গীতে বলেন প্রকল্পের প্রধান।
ফলে ফারাক্কা নিয়ে আগামী দিনে কী করা উচিত, সে সম্বন্ধে ভারতেও নানা ধরনের মতামত আছে।
ফারাক্কার ভবিষ্যত ঠিক কোন পথে, তা এখনও কারও জানা নেই, কিন্তু এটা বলা যায়, ফারাক্কাকে নিয়ে বিতর্ক বোধহয় পরের ৫০ বছর ধরেও চলবে!
-বিবিসি