sliderফিচারশিরোনাম

নেত্রকোনা পাহারী আদিবাসী ও হাওরের জীবন সংগ্রাম

মো.নজরুল ইসলাম,মানিকগঞ্জ: পাহার-হাওর-ঝরনা ও অপরুপ প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্যরে জেলা নেত্রকোনা। আমরা জেলার আটপাড়া উপজেলার রামেশ্বরপুর গ্রামে বেসরকারি উন্নয়ন গবেষণা সংস্থা বারসিক রিসোর্স সেন্টার থেকে জেলার বিভিন্ন স্থানে সারাদিন পাহার-হাওর জলাভূমি মানুষের জীবন সংগ্রাম জানতে চাই। সে লক্ষ্যেই গত ২৭ সেপ্টেম্বর-০১ অক্টোবর ২০২৪ অভিজ্ঞতা বিনিময়ে মানিকগঞ্জ থেকে নেত্রকোনা রিসোর্স
সেন্টারে এসেছিলাম। আমাদের টিমে সফরসঙ্গী হিসেবে ঢাকা থেকে বারসিক পরিচালক সৈয়দ আলী বিশ্বাস ও গাড়ি চালক সুদীপ্ত মানকিন। মানিকগঞ্জ থেকে প্রকল্প কর্মকর্তা মো.নজরুল ইসলাম, প্রকল্প সহায়ক আছিয়া আক্তার, রিনা সিকদার ও ফিরোজা সরকার ছিলেন। এছাড়াও অভিজ্ঞতা সহায়ক হিসেবে এনত্রকোনা থেকে বারসিক আঞ্চলিক সমন্বয়কারী অহিদুর রহমান, কর্মসূচি কর্মকর্তা মো.আলমগীর হোসেন, হ্যাপি রায়, খাদিজা আক্তার লিটা,রোকসানা রুমী ও রনি খান,ননী গোপাল ডালু, মো. সুমন মিয়া,রুবিনা আক্তার, গুঞ্জন রেমা ও আল্পনা ঘাগরাসহ কমিউনিটির সংগঠকরা সরেজমিনে উপস্থিত ছিলেন। এছাড়াও অফিসে সময়মত আপ্যায়নের জন্য মিসেস কমলা বেগম,মো.নয়ন মিয়া ও আব্দুর রবদের প্রতি কৃতজ্ঞতা অশেষ।

জেন্ডার ন্যায় বিচার ও নারীবান্ধব বহুত্ববাদী সমাজ বিনির্মানে কমিউনিটি পর্যায়ে অভিজ্ঞতা বিনিময়। আমরা প্রথম দিন মানিকগঞ্জ থেকে আসার পথে ভালুকায় যাত্রা বিরতি করলাম। ময়মনসিংহ চরপাড়া মোরে একটি নামি হোটেলে দুপুরে খাবার খেলাম। পথে নেত্রকোনা পৌরসভা মোরে চা আড্ডা দিয়ে অফিসে পৌঁছালাম। তারপর সামান্য বিশ্রাম নিয়ে রাতের খাবার ও সৈয়দ আলী বিশ্বাস ভাই এর অভিজ্ঞতাময় গল্পের মধ্যেই প্রায় রাত কেটে গেলো।
পরদিন সকালে অফিসেই কমলা আপার লাকরির রান্না ডিম- খিচুড়ি খেয়ে কমিউনিটির দিকে রওনা দিলাম। প্রথমেই নেত্রকোনা শহরের পাশে রাজেন্দ্রপুর গ্রামে কৃষক নেতৃত্বে আইপিএম ক্লাবে আসলাম। সংগঠনের সভাপতি কৃষক বন্ধু বাদশা ভাই প্রয়াত হয়েছেন জেনে খুব কষ্ট পেলাম। আরেক কৃষক বন্ধু মো.বাচ্চু মিয়ার খোজ খবর জানলাম। তারপর কেঁচো কম্পোস্ট করে মনোয়ারা আক্তারদের স্বাবলম্বী হওয়ার গল্প শুনলাম। তারপর বৃষ্টির তাড়া খেয়ে নেত্রকোনা সদর উপজেলা পরিষদ মিলনায়তনে বারসিক, সবুজ সংহতি ও সম্মিলিত যুব সংহতি আয়োজিত বহুত্ববাদী সমাজ বিনির্মানে নেত্রকোনা তারুণ্যের ভাবনা ও সংস্কার প্রস্তাবনা কর্মসূচিতে মানিকগঞ্জের পক্ষ থেকে আলোচনায় অংশগ্রহণ করে বিদায় নিলাম। তারপর শহরেই হোটেল দুপুরের খাবার খেয়ে রওনা হই মদনপুরে।

নেত্রকোনা সদর কাইলাটি ইউনিয়নের ডেবচিকা গ্রামের অগ্রযাত্রা কিশোরী ক্লাবে শেফালী আক্তারদের নারীর ক্ষমতায়নে সফলতার গল্প জানলাম। তারপর হযরত শাহ সুলতান কমর উদ্দিন রুমী (র.) মাজারে পাগল আব্দুল খালেকদের কস্টের জীবন সংগ্রামের গল্প শুনে পাশেই মগরা নদীর প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের একাংশ দর্শন করে বিদায় নিলাম। পরদিন সকালে বারসিক রামেশ্বরপুর, নেত্রকোনা রিসোর্স সেন্টার থেকে কলমাকান্দা চন্দ্রডিঙ্গায় পাহার ঝরনার মিলনস্থল দেখতে রওনা দিলাম। কিন্তু বৈরী আবহাওয়া ও পাহারী ঢলে যেতে পারলাম না। রুট পরিবর্তন করে ভারতীয় সীমানায় লেঙ্ধসঢ়;গুরায় সাত শহীদের মাজার ও পাহাড় দর্শন করলাম। গাড়ো আদিবাসী তারানগরে মিকরাকা নারী সংগঠনের সভাপতি সাবিনা রংদি ও মতি ঘাগরা বাড়িতে অভিজ্ঞতা সংলাপ হলো। সংগঠনের সাধারন সম্পাদক পারভিন নুকরে ও মুন্না রংদির বাড়িতে ভিন্ন ধরনের অভিজ্ঞতাসহ চু ও খাড়ি রান্নাসহ বৈচিত্রময় খাবার খেয়ে তারানগর কৃষক নিয়ন্ত্রিত বীজ ব্যাংকসহ চারপাশ দেখতে দেখতে বিদায় নিলাম। আসার পথে রাতে উপমহাদেশের প্রখ্যাত জ্ঞান তাপস মার্কসবাদী তাত্ত্বিক যতীন সরকার স্যারের সান্নিধ্য নিয়ে বিদায় নিলাম।

পরদিন সকালে বারসিক নেত্রকোনা রিসোর্স সেন্টার মিলনায়তনে সদর আটপাড়া, কলমাকান্দা ও মদন উপজেলায় কর্মরত সহকর্মী ও বারসিক মানিকগঞ্জ টিমের সাথে অভিজ্ঞতা সংলাপ বিনিময় করি। তারপর বিকেলে মদন উপজেলার উচিতপুর হাওরে সরকারি পর্যটন রিসোর্টে যাত্রা বিরতি দিয়ে ট্রলার যোগে বিশাল হাওরের কিঞ্চিৎ অংশ পরিদর্শন করলাম। হাওরে বাবুল মাঝি এবং মাছ ও হাস পালনে রনজিত ধরদের জীবন সংগ্রামে প্রাণীত হলাম।

উল্লেখ্য যে-এক সময় নেত্রকোনা জেলার কলমাকান্দা উপজেলার সীমান্তবর্তী লেংগুড়া ইউনিয়নের আদিবাসীরা নিজেদের জুম বলে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করতো। একসময় জুমই আদিবাসীদের প্রাণ ছিল। এই উপজেলার লেংগুড়া ইউনিয়নের আদিবাসীদের মধ্যে ধনীর তুলনায় গরীব পরিবারের সংখ্যা বেশি। জুম চাষের উপর ভিত্তি করে
পাহাড়িদের জীবন ব্যবস্থা পরিচালিত হত এক সময়। পাহাড়ের এই দূর্গম এলাকায় শিক্ষার আলো দেখেনি অনেক আদিবাসী পরিবার। কিছু সংখ্যক পেলেও চাকরি জুটছে না এই আদিবাসীদের কপালে। যার কারণে নিজ ভূমিতে সকাল বেলা হতে সন্ধ্যা পর্যন্ত পাহাড়ে জুম কাঁটা, জুম কাঁটার পর আগুন দেওয়া আর চাষাবাদ করার
মাধ্যমে প্রকাশ ঘটতো আদিবাসীরা কিভাবে কষ্ট করে জীবন যাপন করে। জুমে যখন নতুন ফসল উঠত তখন চাষীরা বিক্রয় করার জন্য বাজারে নিয়ে যেতো কিন্তু তখনও ন্যায্য দাম পেতো না, মাথার ঘাম ফেলানো সে আদিবাসী জুম চাষীরা। তাছাড়া সেটলার, বনবিভাগ ও নিরাপত্তা বাহিনী কর্তৃক ভূমি অধিগ্রহনের ফলে জুমের
সংখ্যা দিনে দিনে কমে যাচ্ছে, এ ইউনিয়নের সমতলভূমির সংখ্যা খুবই কম বলে আদিবাসীদের জীবিকা নির্বাহের একমাত্র পথ হলো মেঘালয় থেকে নেমে আসা নুড়ি পাথর ও বালু উত্তোলনের ওপর। অন্যদিকে এগুলো সমতল ভূমি ও সেটলাররা জোরপূর্বক বেদখল করে নিয়ে যাচ্ছে। তবে সেটলাররা চুক্তির আগে যে
আদিবাসীদের ভূমি জোরপূর্বক বেদখল করেছে তার চেয়েও দ্বিগুণ চুক্তির পরে বেদখল করে নিয়ে গেছে। এখনও উন্নয়নের নামে চলছে ভূমি আগ্রাসন অথচ ১৯৯৭ সালের পাহাড়ী চুক্তির প্রধান শর্ত ছিলো হারানো ভূমি ফেরত দেয়া কিন্তু চুক্তির দীর্ঘ প্রায় ২ যুগ হলেও আজো চুক্তির সেই শর্ত বাস্তবায়িত হয়নি। তাছাড়া
আজ অবধি আদিবাসীদের রাজনৈতিক অস্বীকৃতি তথা পরিচয় সংকটের সঙ্গে অনেকটা দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিকের মতো ‘নিজভূমে পরবাসী’ হিসেবে জীবন-যাপন করতে হচ্ছে। আদিবাসীদের রাজনৈতিক পরিচয় সংকট ঐতিহাসিক ভাবে আজো নাগরিকত্বের প্রশ্নে আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীকে উপেক্ষিতকরণ প্রক্রিয়া অব্যাহত রয়েছে। এমতাবস্থায় আদিবাসীরা দিশেহারা হয়ে পড়ে আছে।

একদিকে আদিবাসী অন্য দিকে ভূমি হারিয়ে আদিবাসীরা যাযাবরের ন্যায় জীবন যাপন করে যাচ্ছে। লেঙ্ধসঢ়;গুড়া ফুলবাড়ি বাংলাদেশ ভারত মেঘালয় সীমান্ত ১১৭২ নং পিলার সংলগ্ন সাত শহীদের মাজারে ঘুরতে গিয়ে গনেশ্বরী নদীতে মেঘালয় থেকে নেমে আসা বালু ও নুড়ি পাথর কুঁড়ানোর দৃশ্য চোখে পড়ে। হাটুজলে নেমে
নিমতি রংদি,সকিনা ¤্রংদের মতো দারিদ্র আদিবাসীরা বালু থেকে চেলে চেলে নুড়ি পাথর উত্তোলন করছে। সারাদিন যেটুকু বালু পাথর উত্তোলন করে,তা বিক্রি করে এবং সামান্য সমতলে গবাদিপশু পালন করে কোনক্রমে সংসার চালিয়ে যাচ্ছে।

এদিকে হাওর বেষ্টিত নেত্রকোনার মদন, মোহনগঞ্জ ও খালিয়াজুরী উপজেলায় শুকনো মৌসুমে এক রূপ আর বর্ষায় তার ভিন্ন রূপ। আষাঢ়-শ্রাবণ দুই মাস বর্ষাকাল। বর্ষা আসতে না আসতেই হাওড়ের চতুর্দিক কানায় কানায় ভরে যায় অথৈই জলরাশিতে। আর এই মনোমুগ্ধকর দৃশ্য দেখতে প্রতিদিনই হাওরে দর্শনার্থীর ভীড়
চোখে পড়ার মত। তবে তাদের নিরাপত্তার পাশাপাশি পর্যটন এলাকার জন্য ইতোমধ্যে কিচু জায়গা চিহ্নিত করেছে সরকার। স্থানীয় প্রশাসনের সহায়তায় কিছু রিসোর্টও তৈরী হয়েছে। সমুদ্র নয়, সমুদ্রের মতোই বিশাল জলরাশি। মাঠ-ঘাট সব পানিতে একাকার। তার ওপর ছোট ছোট দ্বীপের মতো একেকটি গ্রাম। বর্ষা মৌসুমে এমন দৃশ্যপটের দেখা মিলে নেত্রকোনার মদন উপজেলার হাওর জনপদে।

নেত্রকোনার মদন উপজেলার উচিতপুর ট্রলার ঘাট এখন মিনি সমুদ্র সৈকতে পরিণত হয়েছে। ছোট বড় সকলেই পানিতে নেমে সাতার কেঁটে তাদের আনন্দ উপভোগ করছে। দেখতে মনে হয় যেন মানুষের মিলন মেলা। এছাড়াও উচিতপুর ট্রলার ঘাট থেকে ট্রলারযোগে কিছুদুর গেলেই বালই ব্রীজ। বর্ষাকালে ব্রীজের চারদিকে পানি। দর্শানার্থীরা ট্রলারযোগে ব্রীজে গিয়ে নির্মল বাতাস অনুভব করে। ছোট বড় নারী পুরুষ অনেকেই ব্রীজের উপর উঠে মুঠোফোন বা ক্যামেরায় ছবি তুলে তাদের স্মৃতি ধরে রাখে। যেন এক বিচিত্র অনুভূতি। বর্ষায় এখানে সামান্য বাতাস এলেই জলরাশি থেকে ভেসে বেড়ায় ঢেউয়ের ছলাৎ ছলাৎ শব্দ।

সূর্যাস্তের মূহুর্তটিতে পরিস্কার আকাশ ঘেরা সূর্যের আলোয় স্বচ্ছ সমুদ্রসম জল ধারণ করে সোনালী আভা। রাতের জ্যোৎস্নায় চিক চিক করে বিস্তীর্ণ এ জলরাশি। জৈষ্ঠ থেকে আশ্বিন পর্যন্ত এ হাওরাঞ্চলটকে অনেকটাই সমুদ্রের মতো দেখা যায় বলে এখানে রয়েছে বিচিত্র এক আকর্ষণ। অভিজ্ঞতার আলোকে আমরা
সরকারের কাছে প্রধান প্রধান দাবিগুলোর মধ্যে চাই যে জাল যার জলা তার এই নীতিতে প্রকৃত জেলেধের অধিকারে হস্তক্ষেপ করা যাবে না এবং বঞ্চিতদের অধিকার ফিরিয়ে দিতে হবে। মৎসসহ প্রাকৃতিক সম্পদ সংগ্রহ,সংরক্ষণ ও বানিজ্যের সিন্ডিকেট ভাঙতে হবে। পর্যটন সৌন্দর্য্য মানচিত্র করে প্রয়োজনীয়
স্থাপনা ও সংস্কার করতে হবে। পর্যটনে দেশী বিদেশী সকল নাগরিকের মৌলিক অধিকারসহ নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button