sliderমতামতশিরোনাম

নবীপ্রেমের এক অনন্য উপাখ্যান কাজী নজরুল ইসলাম

বড়ুয়া অসীম বিকাশ : কাজী নজরুল ইসলাম, যাঁর কলমে ছিল দ্রোহের আগুন আর হৃদয়ে ছিল প্রেম ও ভক্তির ফল্গুধারা, তিনি বাংলা সাহিত্যের এক দুর্লভ সম্পদ।

“বিদ্রোহী কবি” হিসেবে তাঁর পরিচয় যতটা সুপ্রতিষ্ঠিত, তার চেয়েও গভীর ও বিস্তৃত হলো তাঁর নবীপ্রেম। নজরুলের এই প্রেম শুধু একটি বিশ্বাস বা ধর্মের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না, বরং তা ছিল এক সার্বজনীন মানবিক আবেদন, যা সকল ভেদাভেদের ঊর্ধ্বে উঠে মানবতার জয়গান গেয়েছিল।
আপনার কথায়, “মোহাম্মদের নাম জপেছিলি বুলবুলি তুই আগে” গানটি কেবল একটি সুর নয়, এটি কবির আত্মনিবেদনের এক জীবন্ত দলিল। এই গানে বুলবুলি, গোলাপ, চাঁদ ও ভ্রমরকে যেভাবে নবী প্রেমের প্রতীক হিসেবে উপস্থাপন করা হয়েছে, তা নজরুলের অসাধারণ কল্পনাশক্তি এবং আধ্যাত্মিক গভীরতার পরিচায়ক। তাঁর বিশ্বাস ছিল, প্রিয় নবী (সা.) শুধুমাত্র মানবজাতির জন্যই নয়, বরং সমগ্র সৃষ্টিজগতের জন্য আল্লাহর পক্ষ থেকে এক অপার রহমত।

নজরুলের নবীপ্রেমের উৎস ও তার অনন্যতা
নজরুলের ইসলামি গানের ধারা বাংলা সাহিত্যে এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছে। তিনি ইসলামি সংগীতকে এমন এক শৈল্পিক রূপে উপস্থাপন করেছেন, যা এর আগে আর কোনো বাঙালি কবি করেননি। তাঁর নবীপ্রেমের মূল কারণগুলো গভীর বিশ্লেষণ দাবি করে:
১. আধ্যাত্মিক আত্মনিমগ্নতা: নজরুল ছিলেন এক আধ্যাত্মিক সাধক। তাঁর কাছে আল্লাহর রাসূল (সা.) ছিলেন সকল সৃষ্টিজগতের আদর্শ এবং অনুপ্রেরণার কেন্দ্র। তিনি রাসূল (সা.)-এর জীবন, কর্ম ও চরিত্রকে গভীরভাবে উপলব্ধি করেছিলেন। তাই তাঁর কবিতায় আমরা দেখতে পাই, নবী (সা.)-কে তিনি শুধু একজন ধর্মপ্রচারক হিসেবে নয়, বরং “সৃষ্টির দম” বা প্রাণ হিসেবে দেখেছেন। তিনি লিখেছেন, “মক্কা ও মদিনায় আজ শোকের অবধি নাই… গেল গেল বুঝি সৃষ্টির দম টুটে!” এই পংক্তিটি প্রমাণ করে যে, তিনি নবীকে সমগ্র বিশ্বের প্রাণ হিসেবে অনুভব করতেন।
২. অসাম্প্রদায়িক মানবতাবাদ: নজরুল ইসলামে গভীরভাবে বিশ্বাসী হওয়া সত্ত্বেও, তাঁর লেখনীতে কোনো ধরনের গোঁড়ামি বা সাম্প্রদায়িকতা ছিল না। তিনি ‘শ্যামা সংগীত’ এবং ‘ইসলামি গান’ একই কলমে লিখেছেন। এটি সম্ভব হয়েছিল কারণ তিনি সকল ধর্মের মূল নির্যাস—মানবতাকে—অনুভব করতে পেরেছিলেন। তিনি তাঁর সৃষ্টিকর্মে সকল ধর্মের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা দেখিয়েছেন, যা তাঁকে এক অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছে। এই প্রসঙ্গে প্রখ্যাত নজরুল গবেষক রফিকুল ইসলাম বলেছেন, “নজরুল তাঁর ইসলামি গানে ধর্মের সংকীর্ণতা ভেঙে দিয়েছেন, যেখানে সকল মানুষের মহামিলনের সুর বেজেছে।”
৩. কল্পনার বিশালতা: নজরুলের নবী প্রেমের উপমাগুলো এতটাই সমৃদ্ধ যে, তা পাঠক বা শ্রোতাকে মুগ্ধতায় আবিষ্ট করে। “সাহারাতে ফুটল রে ফুল/ রঙিন গুলে লালা” বা “তোরা দেখে যা আমিনা মায়ের কোলে/ মধু পূর্ণিমারই সেথা চাঁদ দোলে”র মতো পংক্তিগুলোতে তিনি আরবের মরুভূমিকে প্রেমের উপমায় রাঙিয়ে তুলেছেন। তাঁর কল্পনায় নবী (সা.)-এর আগমন ছিল এক রঙিন ফুলের সুবাসের মতো, যা সমস্ত বিশ্বকে মাতোয়ারা করে দিয়েছে।

নজরুল এবং অন্যান্য লেখক: একটি তুলনামূলক আলোচনা
নবী প্রেমের প্রকাশে নজরুলের মতো এতোটা আবেগ ও গভীরতা খুব কম লেখকের লেখনীতেই দেখা যায়। অনেক লেখকের লেখায় নবীপ্রেম একটি ধর্মীয় অনুভূতির প্রকাশ মাত্র, কিন্তু নজরুলের কাছে এটি ছিল এক ব্যক্তিগত ও আত্মিক সম্পর্ক। যেমন, পবিত্র কোরআনে বর্ণিত হয়েছে, আল্লাহ বলেন: “তিনি আপন রাসূলকে হেদায়েত ও সত্য দ্বিন সহকারে প্রেরণ করেছেন, যেন এ দ্বিনকে অন্যান্য দ্বিনের ওপর জয়যুক্ত করেন।” (সূরা তাওবা: ৩৩)। এই কোরআনের বাণীকে নজরুল তাঁর কাব্যে ভিন্ন মাত্রায় প্রকাশ করেছেন।

অন্যান্য মুসলিম লেখকের লেখায় নবী প্রেমের যে চিত্র পাওয়া যায়, তা সাধারণত হাদিস বা কোরআনের উপর ভিত্তি করে রচিত। যেমন, সাহাবিদের নবী প্রেমের দৃষ্টান্ত তুলে ধরতে গিয়ে বহু লেখক বর্ণনা করেছেন হযরত আনাস (রা.) এবং হযরত আবু হুরায়রা (রা.)-এর হাদিস, যেখানে রাসূল (সা.) বলেন, “তোমাদের কেউ ততক্ষণ পর্যন্ত পরিপূর্ণ ঈমানদার হতে পারবে না, যতক্ষণ আমি তার নিকট নিজ নিজ পিতা-মাতা, সন্তান ও সকল মানুষ হতে প্রিয় না হই।” এসব হাদিসভিত্তিক লেখার সাথে নজরুলের গানের পার্থক্য হলো, নজরুল এই প্রেমের আধ্যাত্মিক ও শৈল্পিক দিকটিকে নতুনভাবে উন্মোচন করেছেন। তিনি শুধু আদর্শের কথা বলেননি, বরং হৃদয়ের আবেগ ও অনুভূতিকে সুরে ও ছন্দে প্রকাশ করেছেন।

আমাদের সমাজে নজরুলের প্রাসঙ্গিকতা
বর্তমান যুগে যেখানে ধর্মীয় বিভেদ ও সাম্প্রদায়িকতা মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে, সেখানে কাজী নজরুল ইসলামের সাহিত্য আরও বেশি প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে। তাঁর “মানুষ” কবিতা এবং অসংখ্য গানে যে মানবধর্মের দর্শন ফুটে উঠেছে, তা আমাদের চরম সংকটের দিনে পথ দেখাতে পারে। নজরুল আমাদের শিখিয়েছেন, ধর্মের ঊর্ধ্বে মানবতা এবং প্রেমের অবস্থান।

নজরুলের মতো একজন কবির উপস্থিতি বর্তমান সময়ে অত্যন্ত জরুরি, যিনি তাঁর লেখনীর মাধ্যমে মানবতাকে প্রাধান্য দিয়ে প্রেম ও সম্প্রীতির বার্তা ছড়িয়ে দিতে পারেন। আমাদের সকলের উচিত নজরুলের এই অসাম্প্রদায়িক চেতনাকে ধারণ করা এবং তাঁর মতো করেই মানবজাতির প্রতি ভালোবাসার হাত বাড়িয়ে দেওয়া।

লেখক: সাংবাদিক,প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট ও ভাইস-চেয়ারম্যান (কোরিয়া বাংলা-প্রেসক্লাব)

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button