sliderঅর্থনৈতিক সংবাদশিরোনাম

বাজারে চিনির সরবরাহ আর দাম নিয়ে কেন জটিলতা

‘দাম এত বেড়েছে যে চিনি খাওয়া বন্ধই করে দেবো ঠিক করেছি। এমনিই চিনির দাম বাড়ায় গত কয়েকমাসে চিনি ব্যবহার করা অনেক কমিয়ে দিয়েছি,’ কিছুটা ক্ষোভের সাথেই আমাকে বললেন ঢাকার মহাখালীতে সপ্তাহের বাজার করতে আসা শাহিদা আক্তার।

শাহিদা বলেন, বছর খানেক ধরেই ‘দাম বাড়লে ব্যবহার কমানোর’ নীতি অনুসরণ করছেন তিনি। অর্থাৎ যখন যেই পণ্যের দাম বাড়ে, সেই পণ্যের ব্যবহার কমিয়ে দেন তিনি।

শাহিদা আক্তার আক্ষেপ করে বলেন,‘গত এক বছর ধরে গোশত খাওয়া প্রায় বন্ধই করে দিয়েছি। সয়াবিন তেলের দাম যখন বাড়ল তখন তেল কম ব্যবহার করারও অভ্যাস করেছি। এ দেশে এভাবে অ্যাডজাস্ট না করলে তো সংসার নিয়ে টিকে থাকা সম্ভব না।’

বাংলাদেশে চিনির দাম নিয়ে গত কিছুদিন ধরে বাজারে বেশ শোরগোলই তৈরি হয়েছে বলা যায়। ঈদের পর দুই সপ্তাহের কম সময়ের মধ্যে বাজারে নির্ধারিত দামের চেয়ে প্রতি কেজিতে ১৫ থেকে ২০ টাকা বেশি দামে চিনি বিক্রি হচ্ছে। রমজান মাসে এপ্রিলের প্রথম দিকে সরকার খোলা চিনির দাম নির্ধারণ করে দেয়ে কেজি প্রতি ১০৪ টাকায়। কিন্তু সরকার দাম নির্ধারণ করে দিলেও ওইসময় বাজারে চিনি নির্ধারিত দামের চেয়ে বেশি দামেই বিক্রি হচ্ছিল বলে জানা যায়।

ঈদের আগে খোলা চিনির দাম সর্বোচ্চ ১২৫ টাকা হলেও এখন ১৪০ থেকে ১৪৫ টাকার নিচে খোলা চিনি পাওয়াই যাচ্ছে না। আর খুচরা বাজারে প্যাকেটজাত চিনি দোকানে পাওয়াই যাচ্ছে না।

মহাখালী কাঁচাবাজারের কয়েকটি দোকান ঘুরে দেখা গেল তারা ১৪০ টাকার নিচে খোলা চিনি বিক্রি করছেন না। কয়েকজনের সাথে কথা বলে জানলাম তাদের কাছে প্যাকেটজাত চিনি নেই।

একজন দোকানদার দাবি করলেন ঈদের আগে থেকেই প্যাকেটজোত চিনির সরবরাহ নেই। আর খোলা চিনি ঈদের আগেও ৫০ কেজির বস্তা ৬ হাজার টাকায় কিনেছেন তারা। তবে এখন ওই বস্তা কিনতে হচ্ছে ৬ হাজার ৩০০ থেকে ৯ হাজার ৫০০ টাকায়।

চিনি নিয়ে কেন তৈরি হল সঙ্কট
বাংলাদেশের চিনি আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানগুলোর সংগঠন বাংলাদেশ সুগার রিফাইনার্স অ্যাসোসিয়েশন বুধবার বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের কাছে চিঠি দিয়ে জানতে চায় বিশ্ব বাজারে এক মাসের মধ্যে চিনির দাম বেড়ে যাওয়ায় এই বর্ধিত দামে তারা চিনি আমদানি করবে কিনা।

চিঠিতে উল্লেখ করা হয়, আন্তর্জাতিক বাজারের দামে চিনি আমদানি করলে চিনির আমদানি মূল্যই সরকার নির্ধারিত বাজার মূল্যের চেয়ে অনেক বেশি হয়। এরকম বাস্তবতায় এই দামে তারা চিনি আমদানি করবে কিনা, সেই সিদ্ধান্ত জানতে চেয়ে চিঠি দেয়া হয় বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে।

অথচ মাস ছয়েক আগেও বাজারে ৮৫ থেকে ৯০ টাকা কেজিতে পাওয়া গেছে খোলা চিনি। প্যাকেটজাত চিনির দাম ছিল কেজিতে ১০০ টাকার নিচে। সেখান থেকে ছয় মাসের মধ্যে চিনি নিয়ে এমন সঙ্কট তৈরি হলো কেন?

খুচরা ব্যবসায়ীরা বলছেন, চিনির সরবরাহকারীরা তাদের চিনি দিচ্ছেন না। তারা বলছেন, কারণ হিসেবে আমদানিকারক ও মিল মালিকরা বলছে যে মিলে যথেষ্ট পরিমাণ চিনি নেই।

রোজার সময় চিনির দাম নিয়ন্ত্রণে রাখতে ফেব্রুয়ারি মাসে চিনি আমদানিতে শুল্ক কমানোর সিদ্ধান্ত দিয়েছিল সরকার। তারপরই বাজারে খোলা চিনির দাম কেজিতে ৩ টাকা কমে ১০৪ টাকা হয় এবং প্যাকেটজাত চিনির দাম কমে দাঁড়ায় ১০৯ টাকায়। এপ্রিল মাস থেকে এই শুল্ক সুবিধা প্রত্যাহার করার পর থেকে চিনির দাম বেড়েছে।

তবে শুল্ক সুবিধা প্রত্যাহার করার ফলে চিনির দাম কেজিতে সর্বোচ্চ পাঁচ টাকা বাড়তে পারে বলে মনে করেন বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সচিব মোহাম্মদ শফিকুজ্জামান।

‘ভ্যাট সুবিধা প্রত্যাহারের জন্য দাম কিছুটা বাড়তে পারে। তবে মূলত দাম বেড়েছে আন্তর্জাতিক বাজারে চিনির দাম অস্বাভাবিক হারে বাড়ার কারণে।’

আন্তর্জাতিক বাজারে চিনির দাম কয়েক সপ্তাহের মধ্যে টন প্রতি প্রায় ১৫০ ডলার বেড়েছে বলে জানা যাচ্ছে।

ইন্টারন্যাশনাল সুগার অর্গানাইজেশনের তথ্য অনুযায়ী, গত পাঁচ মাসে চিনির দাম ২০ শতাংশেরও বেশি বেড়েছে।

এই বিষয়ে চিনি আমদানিকারকদের সাথে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের বৈঠক হয়েছে এবং আগামী সপ্তাহের মধ্যেই চিনির দাম নির্ধারণ করা হবে বলে জানান শফিকুজ্জামান।

এ বিষয়ে চিনি আমদানিকারকদের কারো বক্তব্য পাওয়া সম্ভব হয়নি। তবে বাজারে চিনির সরবরাহে কোনো কমতি নেই। দেশের শীর্ষ চিনি আমদানিকারকদের এমন ব্যাখ্যা গত কয়েকদিনে প্রকাশিত হয়েছে কয়েকটি গণমাধ্যমে।

বাজার বিশেষজ্ঞরা কী বলছেন?
পণ্যের বাজারে চাহিদা-যোগান ও সরবরাহের হেরফেরের এরকম সময়ে সরকারের বাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোর নিষ্ক্রিয়তা বাজারে অসামঞ্জস্য দীর্ঘায়িত করে বলে মন্তব্য করেন অর্থনীতিবিদ খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম।

`এরকম সময়ে, যখন স্বাভাবিক সরবরাহ কিছুটা ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তখন বড় আমদানিকারকরা বাজারের ওপর প্রভাবটা বাড়িয়ে দেয়।’

‘এরকম সময়ে সরকারের যেই সংস্থাগুলোর তাদের ওপর নজরদারি চালানোর কথা, তারা দুর্বল বা অসহায় ভূমিকা পালন করেন বলে এর আগে দেখেছি আমরা।’

তবে আমদানিকারকরা কম পরিমাণ আমদানি করার কারণেও বাজারে চিনির সরবরাহে ঘাটতি তৈরি হতে পারে বলে মনে করেন এই অর্থনীতিবিদ।

অর্থনীতিবিদ গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন,‘এই মুহূর্তে যেহেতু ডলারের একটি টানাপোড়েন আছে, তাই আমদানিকারকরা প্রয়োজনীয় পরিমাণ এলসি খুলতে পারছেন না বলে স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে আমদানি কম হচ্ছে বলে আমার ধারণা।’

এই কারণে বাজারে চিনির সরবরাহ কিছুটা কম থাকতে পারে এবং এমন পরিস্থিতিতে বাজারে কিছুটা ঘাটতি থাকা স্বাভাবিক বলেও মনে করেন তিনি।

এছাড়া শুল্ক কমানোর সুবিধা পুনর্বহাল করা নিয়ে আলোচনার অংশ হিসেবেও বাজারে চিনির সরবরাহ কমিয়ে দেয়া হতে পারে বলে ধারণা করেন মোয়াজ্জেম।

সূত্র : বিবিসি

Related Articles

Leave a Reply

Back to top button