sliderমতামত

কুসুম কুসুম ভালোবাসা এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিচার

১. আমি তখন সিলেট এমসি কলেজে এইচএসসির ছাত্র। গণিত বিভাগের প্রধান ছিলেন বিকেডি স্যার। বিকেডি আসলে উনার নামের সংক্ষিপ্ত রূপ। এই নামেই তিনি সকলের কাছে পরিচিত ছিলেন। আমি ওনার পুরো নাম জানতাম না। এখনো জানি না। স্যার অনেক আগে অবসরে চলে গেছেন। বেঁচে আছেন কিনা জানি না।
ছোটখাটো গড়নের বিকেডি স্যার খুবই গম্ভীর প্রকৃতির মানুষ ছিলেন।
শরীরে বয়সের একটি প্রভাব পড়েছিল। হাঁটতেন কিছুটা কুঁজো হয়ে। কিন্তু গলার স্বর ছিল খুব পরিষ্কার এবং উঁচু। আর তার চরিত্রটা ছিল তার চেয়েও উঁচু।
স্যার পড়াচ্ছেন আমাদের এইচএসসি দ্বিতীয় বর্ষের সাবজেক্ট গতিবিদ্যা। একদিন বিকেলে ক্লাস এসেছেন। এমসি কলেজের গণিত বিভাগের বড় গ্যালারিতে ক্লাস হচ্ছে। প্রায় শ’খানেক ছাত্রছাত্রী ক্লাসে। বিকেলের ক্লাসে অনেকেরই অসুবিধে হতো। বিশেষ করে যারা সন্ধ্যার দিকে বিভিন্ন শিক্ষকের কাছে প্রাইভেট পড়তে যেত তারা চাইতো না শেষ বিকেলের কোন ক্লাস করতে। আর ক্লাসের সেই ছেলেগুলোই একদিন একটা সমস্যার সৃষ্টি করে ফেললো।
স্যার ব্ল্যাকবোর্ডের দিকে মুখ ফিরিয়ে অংকের বিভিন্ন অংশ লিখছেন এবং বুঝাচ্ছেন। গ্যালারির পেছনদিকে বসা কয়েকজন ছাত্র পা দিয়ে কাঠের ফ্লোরে শব্দ করতে লাগলো। বড় গ্যালারি। বুঝা মুশকিল কে করছে। বিব্রতকর অবস্থা। স্যার এবার আমাদের দিকে মুখ ফেরালেন। চেহারায় রাগের প্রতিবিম্ব। কিন্তু কাউকে ধরতে পারলেন না।
‘আমি কি জানতে পারি তোমরা কারা শব্দ করছো? অসুবিধে হলে চলে যাও। আমার ক্লাস না করলেও চলবে’।- বিরক্তির সাথে বললেন।আবার ব্ল্যাকবোর্ডের দিকে মনোযোগ দিলেন।
ক্লাসের সেই অস্থির ছেলেগুলো স্যারকে শান্তিতে থাকতে দিলো না। কিছুক্ষণ পর আবার পা দিয়ে খুটখুট শব্দ করা শুরু করলো।
স্যার আবার আমাদের দিকে তাকালেন। এবার ওনার গলার স্বর চড়ে গেল।
‘আমি বলছি আমার ক্লাস ভালো না লাগলে দরজা দিয়ে তোমরা বেরিয়ে যাও। আমি কিছু মনে করবো না। আমাকে বিরক্ত করার অধিকার তোমাদের নেই। আমি ব্ল্যাকবোর্ডের দিকে তাকিয়ে আছি। যার যার ইচ্ছে বেরিয়ে যাও। আমি দেখছি না’।
সেই ছেলেগুলো কিন্তু বেরিয়ে গেলো না। তার কারণ হচ্ছে যে স্যার ইতিমধ্যে রোল নম্বর কল করে ফেলেছেন। ওরা যদি বেরিয়ে যায় তাহলে আবার তিনি রোল কল করে ওদের ধরে ফেলবেন। সেই ভয়ে তারা বসে থাকলো। কিন্তু তাদের দুষ্টুমি বসে থাকলো না।
তৃতীয়বার পেছন থেকে শব্দ আসতে লাগলো। আমরাও বিরক্ত হচ্ছি। কিন্তু ভয়ে কিছু বলতে পারছি না। আবার ক্লাসে মনোযোগও দিতে পারছি না।
বিকেডি স্যার এবার অগ্নিমূর্তি ধারণ করলেন।আমাদের দিকে তাকিয়ে বললেন-
‘আমি জানিনা তোমরা কারা এই ব্যাঘাত সৃষ্টি করছো। তোমাদেরকে আমি বলেছিলাম ক্লাস থেকে বেরিয়ে যেতে। তোমরা বেরিয়ে যাও নি। প্রকারান্তরে আমাকে ক্রমাগত ডিস্টার্ব করে যাচ্ছো। এর একটি কারণ আছে’।
পুরো ক্লাসে তখন নীরবতা নেমে এসেছে।
‘তোমাদেরকে আমরা যখন এইচএসসিতে এডমিশন টেস্টের মাধ্যমে ভর্তি করি তখন একটা ভুল করেছি। আর সেই ভুলটা হলো আমরা তোমাদের রক্ত পরীক্ষা করতে পারিনি। রক্ত পরীক্ষা করার সুযোগও ছিল না। যদি রক্ত পরীক্ষা করার সুযোগ থাকতো তাহলে তোমরা এই কলেজে ভর্তি হতে পারতে না। তোমাদের রক্ত বলে দিত, তোমাদের পারিবারিক এবং সামাজিক অবস্থা। খারাপ পরিবারের কোন ছেলে মেয়েকে আমরা এখানে ভর্তি করতাম না। আমাদের দুর্ভাগ্য যে, তোমাদের রক্ত পরীক্ষা করতে পারিনি। আর আজ সেই খেসারত দিচ্ছি’।
স্যার কথা বলে যাচ্ছেন। পুরো ক্লাসে পিনপতন নীরবতা। সবাই মূর্তির মত হয়ে গেছে। কোন সাড়াশব্দ নেই। যারা এতক্ষন পা দিয়ে শব্দ করছিল তারাও মাথা নুইয়ে বসে আছে। আমি স্যারের দিকে তাকালাম। স্যারের চোখ দুটো তখন পানিতে টলমল করছে। কপালের শিরাগুলো ফুলে উঠেছে। স্যার তখন ঘামতে শুরু করেছেন। বাকি ক্লাসে আর কোন শব্দ হয় নি।
পরবর্তীতে বিকেডি বা অন্য কোন স্যারের কাছে কাউকে আর শব্দ করতে দেখিনি। বিকেডি স্যারের ব্যক্তিত্বের কাছে আমাদের ছিল নিঃশর্ত আত্মসমর্পণ।
স্যার অনেকটা বাধ্য হয়ে গাছের শেকড় ধরে টান দিয়েছিলেন। কেউ আর নিজের পরিবারের অসম্মান দেখতে চায়নি।
বিকেডি স্যারের ব্যক্তিত্বের সামনে দাঁড়িয়ে কেউ তার সাথে আর বেয়াদবি করার সাহস পায়নি। স্যারের সেই নৈতিক শক্তি ছিল। আর সেই শক্তির বলেই ক্লাসের মধ্যে তিনি এ ধরনের একটি চ্যালেঞ্জ এবং সাহসী কথা ছুঁড়ে দিয়েছিলেন। স্যারের সাথে তর্ক করার সাহস কারো হয়নি। স্যার নিশ্চয়ই নিজকে জানতেন। সেই জানার কারণেই এতোটা সাহস নিয়ে ক্লাসের মধ্যে তিনি হুংকার দিয়েছিলেন। নিশ্চয়ই তার একটি শক্তি ছিল। সেই শক্তির একটি উৎস ছিল। আমি সেই উৎসের খবর জানি না। তবে তার নৈতিক শক্তির প্রভাব সেদিন দেখেছিলাম।
২. ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তিনজন শিক্ষক এখন খবরের শিরোনাম হয়ে আছেন। এর ভেতর একজনের নাম বারবার সামনে আসছে। হতে পারে উনি মিডিয়া ব্যক্তিত্ব সেই কারণে। হতে পারে তিনি একজন মহিলা সেই কারণে। অথবা হতে পারে তিনি এতোদিন যে নীতি আদর্শের বুলি আওড়িয়ে এসেছেন তার সাথে তার পেশাগত জীবনের প্রবল বৈপরীত্য বিদ্যমান। কাজেই লোকজন কথা বলবে। তাদের মুখ বন্ধ করা যাবে না। উনি বলছেন যে উচ্চ আদালতে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে তিনি আপিল করবেন। ধরা যাক তিনি আপিল করলেন এবং সেই মামলায় হেরে গেলেন। তখন তিনি কি বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারি অধ্যাপকের পদ আঁকড়ে থাকবেন? শাস্তি প্রাপ্ত বাকি দুই শিক্ষকের তেমন একটা নড়াচড়া পাওয়া যাচ্ছে না। কাউকে এখনো বলতে শুনিনি যে চূড়ান্ত আদালতে আমি/আমরা দোষী সাব্যস্ত হলে শিক্ষকতা পেশা থেকে সরে যাব। এ ধরনের ঘোষণা দেবার জন্য আর্থিক বা নৈতিকতার যে উচ্চমার্গে থাকতে হয় উনারা হয়তো সেখানে নেই।
৩. বিকেডি স্যারের ঘটনা আবার স্মরণ করছি। নীতি-নৈতিকতার একটি শক্ত অবস্থানে থাকার কারণে পুরো ক্লাসকে তিনি মূর্তি বানিয়ে দিয়েছিলেন। স্যারের মুখের উপর কেউ কিছু বলতে সাহস পায়নি। এখন আমি এ দৃশ্যটি অন্যভাবে কল্পনা করার চেষ্টা করছি।
৪. ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা তস্করবৃত্তিতে যে তিনজন শিক্ষক অভিযুক্ত হয়ে এক গ্রেড ডিমোশন হয়ে অথবা নির্দিষ্ট একটি সময়ের জন্য প্রমোশন বন্ধ থাকার শাস্তি পেয়ে শিক্ষক হিসেবে বহাল তবিয়তে ক্যাম্পাসে আছেন, তাঁরা ছাত্র-ছাত্রীদের সামনে দাঁড়াবেন কীভাবে? ছাত্র-ছাত্রীদের কীভাবে বলবেন যে তোমরা গবেষণা কর্মে চৌর্যবৃত্তির সাহায্য নিও না। বিকেডি স্যারের ক্লাসে তাঁর কথার পর যারা মূর্তির মতো হয়ে গিয়েছিল তারা নিশ্চয়ই এখানে মূর্তির মতো বসে থাকবে না। যদি কিছু ‘দুষ্টু’ ছাত্র-ছাত্রী পাল্টা প্রশ্ন করে, ‘ আপনি নিজেই তো তস্কর। আমাদের আবার জ্ঞান দিতে এসেছেন কেন? আপনি যা করেছেন আমরা তাই করবো। আপনি করলে যদি সেটা মৃদু অপরাধ হয় আমরা করলেও তা মৃদু অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে।’
৫. গবেষণা কর্মে চৌর্যবৃত্তির প্রমাণ হাতে থাকা সত্বেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ কেন এই তিনজন শিক্ষকের বিরুদ্ধে ‘মৃদু শাস্তিমুলক ব্যবস্থা’ গ্রহণ করলেন তা জানার জন্য বেশ কয়েকজনের সাথে কথা বলেছি। সরকারি কর্মকর্তা থেকে শুরু করে ব্যারিস্টার- যে কয়েক জনের সাথে কথা বলেছি তাদের বক্তব্য হলো ‘ বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের এ ‘শাস্তিমুলক’ ব্যবস্থা গ্রহণ অনেকটা কুসুম কুসুম ভালোবাসার মতো। না ঠান্ডা, না গরম। ইংরেজিতে যাকে বলে lukewarrm! কোন ব্যবস্থা না নিয়ে থাকতে পারছেন না আবার কঠিন কোনো ব্যবস্থা নিতে পারছেন না। কেন কঠিন ব্যবস্থা নিতে পারছেন না বা নিতে চাইবেন না তার কারণ সম্পর্কে নিশ্চয়ই পাঠকবর্গ অবগত আছেন।
৬. এই কুসুম কুসুম ভালোবাসা বা শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিয়ে বর্তমানে ফ্রান্স প্রবাসী চিকিৎসক, জনপ্রিয় ব্লগার এবং লেখক পিনাকী ভট্টাচার্য একটি চমৎকার মন্তব্য করেছেন। উনার সেই চমৎকার মন্তব্য দিয়ে আমি আমার এ লেখার ইতি টানবো। তিনি মন্তব্য করেছেন এভাবে ‘ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তো এই শাস্তি দিয়ে আমাদের ঝামেলায় ফেলে দিলো।এই উদাহরণ অনুসরণ করে ধরেন ব্যাংকের টাকা চুরির জন্য এমডিকে ডিএমডি বানিয়ে দেয়া যেতে পারে, হেড ক্যাশিয়ারকে অ্যাসিস্ট্যান্ট ক্যাশিয়ার বানিয়ে দেয়া যেতে পারে, কমিশনারকে অ্যাসিস্ট্যান্ট কমিশনার বানিয়ে দেয়া যেতে পারে।কিন্তু বাংলাদেশের সংবিধানে তো অ্যাসিস্ট্যান্ট এমপি এসিস্ট্যান্ট পিএম এসব শব্দ নেই…. ভোট… কী হবে? এই প্রশ্ন পদ্মা সেতুর কাছে রেখে গেলাম। হে পদ্মা সেতু, তোমার কাছে বিচার দিলাম’। সূএ:মানবজমিন

ডা: আলী জাহান,কনসালটেন্ট সাইকিয়াট্রিস্ট,যুক্তরাজ্য

Related Articles

Leave a Reply

Back to top button