sliderবিবিধশিরোনাম

রোহিঙ্গাদের অসহায়ত্বের সুযোগ নিচ্ছে মানবপাচারকারীরা

১১ দিনে চেকপোস্টে ৮৫৫ জনকে আটক
তরুণীর গলায় বেসরকারি একটি সাহায্য সংস্থার পরিচয়পত্রের ফিতা ঝুলানো। স্বাভাবিকভাবে বুঝা কঠিন সে পাচার কাজে লিপ্ত। তার পাশে বসা রোহিঙ্গা কন্যা শিশু শেহেনা বিবি (৮)। সিএনজি চালিত অটোরিক্সায় করে কথিত ওই এনজিও কর্মী উখিয়ার হাকিমপাড়া রোহিঙ্গা ক্যাম্পের এ ব্লক থেকে শিশুটিকে নিয়ে যাচ্ছিল কক্সবাজার শহরের দিকে। শিশুটিকে ভাইঝি পরিচয় দিয়ে কয়েকটি চেকপোস্ট সে পার হতে পারলেও ধরা পড়ে উখিয়া কলেজ সংলগ্ন সড়কে স্থাপিত সেনাবহিনীর চেকপোস্টে।
গতকাল মঙ্গলবার সন্ধ্যা ৬টার দিকে যথারীতি চেকপোস্টে এসে থামে অটোরিকসাটি। সেনা সদস্যদের প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে সন্দেহ হলে অটোরিকসা থেকে তাদের নামিয়ে চেকপোস্ট সেন্টারে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে ব্যাপক জিজ্ঞাসাবাদে জানা যায় রোহিঙ্গা শিশুটিকে পাচারের উদ্দেশ্যেই নিয়ে যাচ্ছিল ওই তরুণীটি। তরুণীর নাম আসমা ইয়াসমিন (২০)। তার বাবার নাম আকতার আহমদ। উখিয়ার রাজাপালং ইউনিয়নের উত্তর পুকুরিয়ায় তার বাড়ি। চেকপোস্টে তার গলায় ঝুলানো পরিচয়পত্রটি ছিল বেসরকারি সংস্থা ‘মুক্তির’।
ভাইজি পরিচয় দেয়ায় সেনা সদস্যরা পৃথকভাবে তরুণীর কাছে তার ভাইয়ের নাম এবং পরে শিশুটির কাছে তার বাবার নাম জেনে নিলে পাওয়া যায় তথ্যের অমিল। ধরা পড়ে যায় তরুণী। নিশ্চিত পাচারের হাত থেকে বেঁচে যায় রোহিঙ্গা শিশুটি। এভাবে কৌশলে সড়ক, নৌ রুট এবং অরণ্য পথে উখিয়া টেকনাফ থেকে এখন দিনে রাতে পাচার হয়ে যাচ্ছে রোহিঙ্গা নারী ও শিশু। পরে শিশুটিকে পাঠিয়ে দেয়া হয় উখিয়ার হাকিমপাড়া রোহিঙ্গা ক্যাম্পের এ ব্লকে। শিশুটি বাবার নাম করিম উল্লাহ এবং তিনি মিয়ানমারে এখনও নিখোঁজ রয়েছেন। শিশুটি ক্যাম্পে তার মা সানজিদার সাথে থাকে। ফুসলিয়ে তাকে নিয়ে যাচ্ছিল মুক্তির কর্মী পরিচয় দেয়া তরুণীটি।
হাকিমপাড়া এ ব্লকের মাঝি হামিদ জানান, মেয়ে শিশুটি তার ক্যাম্পের এবং তাকে ‘মুক্তির’ কথিত ওই কর্মী বেড়ানার কথা বলে তার বাসায় নিয়ে যাচ্ছিল। সেনা সদস্যদের জিজ্ঞাসাবাদে তরুণী আসমা ইয়াসমিন প্রথম দিকে নানা মিথ্যার আশ্রয় নিলেও পরে সে স্বীকার করে যে শিশুটিকে চাচার করার জন্যই নিয়ে যাচ্ছিল। সে জানায়, মুক্তি নামের এনজিওতে সে গত ১৯ নভেম্বর থেকে সেবিকা পদে কাজ করছে।
তবে এবিষয়ে ‘মুক্তি’ কক্সবাজার এর নির্বাহী কর্মকর্তা বিমল দে জানান, উখিয়া টেকনাফের রোহিঙ্গা এলাকায় আসমা ইয়াসমিন নামে তাদের কোনো কর্মী নেই। কেউ ভাইঝি, কেউ বোন আবার কেউ স্ত্রী পরিচয় দিয়ে এভাবে নিয়ে যাচ্ছে রোহিঙ্গাদের।
রোহিঙ্গারা এখন খুবই অসহায় এবং একারণে সহজেই যেকোনো লোভনীয় প্রতিশ্রুতিতে রাজি হচ্ছে তারা। তাদের এই অসহায়ত্বের সুযোগে নিচ্ছে শক্তিশালী মানবপাচারকারী সিন্ডিকেট।
উখিয়া চেকপোস্ট সুত্রে জানা যায়, সেনাবাহিনী রোহিঙ্গা ক্যাম্পের ত্রাণ ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব নেয়ার পর উখিয়া টেকনাফ সড়কে বেশ কয়েকটি চেকপোস্ট স্থাপন করেছে। এর মধ্যে উখিয়া কলেজের কাছে স্থাপিত চেকপোস্টটি ২৪ ঘণ্টা চালু থাকে। সেনা সদস্যরা দিনরাত কঠোর নজরদারির মাধ্যমে রোহিঙ্গাদের কক্সবাজারের দিকে নিয়ে যাওয়ার অপচেষ্টা প্রতিরোধ করে যাচ্ছেন।
তবে পাচারকারীরা নানা কৌশলে রোহিঙ্গা নারী ও শিশুদের পাচার করছে। বর্তমানে সড়কে কড়াকড়ি থাকায় তারা পাচারের জন্য নৌরুট ও গহীন অরণ্য পথও ব্যবহার করছে। চেকপোস্টে সেনা সদস্যরা হিমশিম খাচ্ছে রোহিঙ্গাদের পাচার ঠেকাতে। প্রতিদিন নানা কৌশল এবং পরিচয় দিয়ে রোহিঙ্গাদের কক্সবাজার শহরের দিকে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা হচ্ছে। কক্সবাজারের ঈদগাহ এলাকার কালু মিয়ার পুত্র আবদুর রশিদ দুই রোহিঙ্গা নারীকে স্ত্রী এবং শালিকা পরিচয় দিয়ে নিয়ে যাওয়ার সময় উখিয়া কলেজ চেকপোস্টে সেনাবাহিনীর হাতে ধরা পড়ে। পরে আবদুর রশিদকে পুলিশে দিয়ে দুই রোহিঙ্গা নারীকে তাদের ক্যাম্পে ফেরত পাঠানো হয়।
চেকপোস্ট সুত্র মতে, গত ২ ডিসেম্বর থেকে ১২ ডিসেম্বর পর্যন্ত ৮৫৫ জন রোহিঙ্গাকে চেকপোস্টে আটক করে ক্যাম্পে ফেরত পাঠিয়েছেন সেনা সদস্যরা। দালালের মাধ্যমে এসব রোহিঙ্গা অনিশ্চিত গন্তব্যের দিকে যাচ্ছিল। এছাড়া কয়েকজন দালালকে পুলিশে সোপর্দ করা হয়।
প্রাপ্ত তথ্য মতে, উখিয়ার কুতুপালং ও টেকনাফের নয়াপাড়া রেজিস্টার্ড রোহিঙ্গা ক্যাম্পকে কেন্দ্র করে অনেক আগেই গড়ে উঠেছে কয়েকটি শক্তিশালী সিন্ডিকেট। এই সিন্ডিকেট এর সদস্য সংখ্যা প্রায় ৩৫ জন। এদের সবাই পুরনো রোহিঙ্গা। এই সিন্ডিকেটের সাথে যোগাযোগ রয়েছে আন্তর্জাতিক মানবপাচারকারী চক্রের সাথে। ২৫ আগস্টের আগেও পাচার হয়েছে কিন্তু নতুন করে লাখ লাখ রোহিঙ্গার আগমনের ফলে এখন পাচার হচ্ছে ব্যাপক হারে। বিশেষ করে রোহিঙ্গারা অসহায় হওয়ায় সুযোগ নিচ্ছে ওই চক্রটি।
তাদের প্রথম টার্গেট অবিবাহিত রোহিঙ্গা যুবতি এবং শিশু। পাচারকারিরা বাংলাদেশের বিভিন্নস্থানে চাকরি ছাড়াও বিদেশে চাকরির প্রলোভনের ফাঁদে ফেলে পাচার করছে টার্গেটকৃত রোহিঙ্গাদের। পাচারকারি চক্র সুযোগবুঝে সড়ক, নৌ ও পাহাড় ঘেরা পথে নিয়ে যাচ্ছে তাদের। কখনো আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে ধরা পড়ে ক্যাম্পে ফিরলেও অন্য পথে চলে যাচ্ছে গন্তব্যে। কখনো মোটা অংকের টাকার বিনিময়ে পার হচ্ছে পুলিশি চেকপোস্ট।
উখিয়া থানা পুলিশের পরিদর্শক (ওসি) আবুল খায়ের রোহিঙ্গা পাচার সম্পর্কে বলেন, নানা পরিচয় দিয়ে দালালেরা রোহিঙ্গাদের অন্যত্র নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে। কিন্তু চেকপোস্টে পুলিশের কঠোর তল্লাশির ফলে তাদের চেষ্টা ব্যর্থ হচ্ছে। সড়ক পথে পাচার ঠেকানোর জন্য পুলিশের পক্ষ থেকে স্থাপিত ৩টি চেকপোস্ট ২৪ ঘন্টা কাজ করছে। চেকপোস্টগুলো হচ্ছে কুতুপালাং, মরিচ্যাবাজার ও মেরিণ ড্রাইভের সোনারপাড়া পয়েন্টে। এসব চেকপোস্টে প্রতিদিন অনেককে আটক করে ক্যাম্পে ফেরত পাঠানো হচ্ছে। এছাড়া সেনাবাহিনী পরিচালিত চেকপোস্টগুলো থেকেও অনেক দালালকে আটক করে পুলিশের হাতে দেয়া হচ্ছে।
তিনি জানান, ২৮ সেপ্টেম্বর থেকে দুই সহস্রাধিক রোহিঙ্গাকে চেকপোস্টে আটক করে ক্যাম্পে ফেরত পাঠানো হয়েছে। এ সময়ে ১১৪ জন দালালকে অবৈধভাবে রোহিঙ্গাদের নিয়ে যাওয়ার কারণে বিভিন্ন মেয়াদে সাজা দেয়া হয়েছে।
কক্সবাজার জেলা পুলিশের এক শীর্ষ কর্মকর্তা পরিচয় প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, পুলিশ রোহিঙ্গাদের পাচার ঠেকাতে সব পয়েন্টে তৎপর রয়েছে। কিন্তু পুলিশ তার দায়িত্বের বিরাট একটি অংশ ব্যয় করছে কক্সবাজারে আগত দেশি বিদেশী ভিআইপি প্রটোকাল নিয়ে। নতুন করে রোহিঙ্গা আসার ফলে কক্সবাজারে গত কয়েক মাসে রেকর্ড সংখ্যক ভিআইপি এসেছেন এবং স্বাভাবিকভাবে পুলিশ তাদের নিরাপত্তার কাজটিই বেশি অগ্রাধিকার দিয়েছে। এ সময়ে রোহিঙ্গারা কেউ কেউ পাচারের শিকার হওয়া অসম্ভব কিছু নয়।
পাচার রোধে কর্মরত বেসরকারি সংস্থা পাল্স এর সমন্বয়কারি সাইফুল ইসলাম চৌধুরী কলিম জানান, রোহিঙ্গা আশ্রিত এলাকায় এখন অনেক রোহিঙ্গা ‘পাল্স’ কর্মীদের কাছে পরিবারের সদস্যদের খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না বলে অভিযোগ করছেন। বিষয়টি উদ্বেগজনক। রোহিঙ্গাদের অসহায়ত্বের সুযোগে নানা অপরাধ এখন সহজেই সংঘটিত হচ্ছে।
আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থা আইওএম এর ন্যাশনাল কমিউনিকেশন কর্মকর্তা শিরিণ আকতার জানান, ঠিক কতজন পাচার হয়েছেন তার কোন ডাটা তাদের কাছে নেই। তাছাড়া পাচারের কবল থেকে কেউ উদ্ধার হলে তাদের দেখভাল করে আইওএম।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published.

Back to top button