ভারতের প্রধান বিরোধী দল কংগ্রেস ‘শুধু মুসলিমদের পার্টি’ কি না, এই প্রশ্নে তারা প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি-সহ বিজেপি নেতৃত্বের তীব্র আক্রমণের মুখে পড়েছে।
সম্প্রতি কংগ্রেস প্রেসিডেন্ট রাহুল গান্ধী ভারতের শীর্ষস্থানীয় কয়েকজন মুসলিম বুদ্ধিজীবীর সঙ্গে বৈঠকে বসেছিলেন, সেখান থেকেই এই বিতর্কের সূত্রপাত – যার জবাব দিতে কংগ্রেসকে এখন বেশ অস্বস্তিতেই পড়তে হচ্ছে।
পর্যবেক্ষকরা বলছেন, ভারতে আগামী সাধারণ নির্বাচনের আগে ধর্মীয় মেরুকরণের লক্ষ্যেই যে বিজেপি এই রাস্তা বেছে নিয়েছে তাতে কোনও সন্দেহ নেই – কিন্তু কংগ্রেসের বিভ্রান্তিকর মুসলিম-নীতিও যে এই অবস্থার জন্য অনেকটা দায়ী সেটাও তারা অস্বীকার করছেন না।
আসলে ভারতে ক্ষমতাসীন বিজেপি হিন্দুত্ববাদী দল হিসেবে পরিচিত হলেও পঞ্চান্ন বছর ভারত শাসন করা কংগ্রেসকে মুসলিমদের দল বলা যাবে কি না, তা নিয়ে এ দেশে বিতর্ক আছে বিস্তর।
সম্প্রতি রাহুল গান্ধী একদল মুসলিম বুদ্ধিজীবীর সঙ্গে বৈঠক করার পর ইনকিলাব নামে একটি উর্দু দৈনিক রিপোর্ট করেছিল, তিনি সেই বৈঠকে কংগ্রেসকে মুসলিমদের দল হিসেবে দাবি করেছেন। আর তারপরই সেই বিতর্কে নতুন করে ইন্ধন পড়েছে।
স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি আজমগড়ের জনসভায় গিয়ে বলেছেন, “কংগ্রেস প্রেসিডেন্ট না কি নিজেদের মুসলিমদের দল বলেছেন। একসময় তো তাদের নেতা মনমোহন সিং এমনও বলেছিলেন এদেশের প্রাকৃতিক সম্পদের ওপর সবার আগে অধিকার না কি মুসলিমদের।”
“ভাল কথা, কিন্তু আমার হল যারা তিন তালাক বিলেরও বিরোধিতা করে – সেই কংগ্রেস কি শুধু মুসলিম পুরুষদেরই দল, মুসলিম মহিলাদের নয়?”
এর আগে প্রতিরক্ষামন্ত্রী নির্মলা সীতারামন আরও এক ধাপ এগিয়ে মন্তব্য করেছেন, “কংগ্রেস যে ধর্মীয় বিভাজনের বিপজ্জনক খেলায় নেমেছে তাতে দেশ আবার সাতচল্লিশের দেশভাগের আগে যেমন বিদ্বেষের পরিবেশ ছিল সেদিকে এগিয়ে যেতে পারে।”
এই মারাত্মক অভিযোগের জবাবে কংগ্রেস শুধু এটুকুই বলতে পারছে, তারা একটা ‘রেইনবো পার্টি’ – যারা দেশের সব বর্ণ-ধর্ম-ভাষা-সংস্কৃতি ও বৈচিত্র্যর প্রতিনিধিত্ব করে।
কিন্তু দলীয় মুখপাত্র রণদীপ সুরজেওয়ালার কন্ঠে স্পষ্টতই থাকছে একটা রক্ষণাত্মক সুর।
দিল্লির সিনিয়ার সাংবাদিক স্মিতা গুপ্তা মনে করেন, এই পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে অনেকদিন ধরে – আর বিজেপি আজ তার ফায়দা নিতে চাইছে।
তিনি বলছেন, “গত কয়েক মাস বা বছরে এমন ধারণা তৈরি হয়েছে যে কংগ্রেস মুসলিমদের উপেক্ষা করছে – কারণ তারা মুসলিমদের পার্টি এই তকমাটাকে ভয় পাচ্ছে।”
“এখন মুসলিমদের জন্য কী করা যায়, কংগ্রেসের ইশতেহারে তাদের জন্য কী রাখা যায় এটা নিয়ে আলোচনা করতেই রাহুল গান্ধী মুসলিম বুদ্ধিজীবীদের আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন – কিন্তু বিজেপি এই সুযোগটা নিয়ে কংগ্রেসকে আক্রমণে ঝাঁপিয়ে পড়েছে।”
“দেশের অর্থনীতির হাল ভাল নয়, বিজেপির অবস্থানও আগের তুলনায় অনেক দুর্বল – ফলে তারা এখন যেটা করতে পারে ঠিক সেটাই করছে, এটাকে ধর্মীয় মেরুকরণে কাজে লাগাচ্ছে।”
কিন্তু মুসলিম বুদ্ধিজীবীদের সঙ্গে বৈঠকে রাহুল গান্ধী কি সত্যিই বলেছিলেন তারা মুসলিমদের দল?
ইনকিলাব পত্রিকায় যার প্রতিবেদন নিয়ে এত হইচই, সেই সাংবাদিক মহম্মদ মুমতাজ বিবিসিকে জানাচ্ছেন রাহুল গান্ধী আসলে বলতে চেয়েছিলেন কংগ্রেস তাদের নেহরু জমানার মুসলিম নীতিতেই ফিরে আসবে।
তিনি বলছেন, “সেখানে আলোচনা হয় নেহরু-গান্ধী-আজাদই কিন্তু দেশভাগের সময় ভারতের মুসলিমদের বলেছিলেন আপনারা দেশ ছেড়ে যাবেন না, আপনাদের অধিকার এ দেশে পুরোপুরি সুরক্ষিত থাকবে। পরে কংগ্রেস সেই নীতি থেকে সরে আসাতেই কিন্তু তাদের পতনের শুরু, উত্তরপ্রদেশ-বিহারের মতো রাজ্যে তারা হারিয়ে যেতে বসেছে।”
“বৈঠকে রাহুল শুধু এটুকুই বলেছিলেন আমার ও আমার মায়ের অঙ্গীকার থাকবে মুসলিমরা যাতে সুবিচার পান, তাদের অধিকার পান – আগে কংগ্রেসের ভুলত্রুটি হয়ে থাকলে সেটাও শুধরে নেওয়া হবে।”
স্মিতা গুপ্তাও বলছিলেন অতীতের বহু বিতর্কিত পদক্ষেপই আসলে কংগ্রেসকে আজ এই আক্রমণের মুখে ঠেলে দিয়েছে।
তার কথায়, “আশির দশকে বাবরি মসজিদের তালা খোলা কিংবা রামমন্দিরের শিলান্যাস যে কংগ্রেস আমলেই তা ভুললে চলবে না। সেই সঙ্গে শাহবানো মামলার রায় উল্টে দেওয়াও তাদেরই কাজ।”
“সে সময়ই বিজেপি নেতা আডভানি তাদের সিউডো সেকুলার বা ছদ্ম-ধর্মনিরপেক্ষ বলে গালিগালাজ করা শুরু করেন, আর কংগ্রেসের মধ্যেও একটা বিভ্রান্তি তৈরি হয় তারা কাদের প্রতিনিধিত্ব করছে। এখন যেগুলো বলা হচ্ছে সেগুলো অবশ্যই প্রাক-নির্বাচনী চাল, কিন্তু আমি বলব কংগ্রেস এখানে সরাসরি গিয়ে বিজেপির পাতা ফাঁদে পা দিয়েছে।”
গুজরাট ও কর্নাটকে ভোটের আগে একরে পর এক হিন্দু মন্দির দর্শনে গিয়ে রাহুল গান্ধীকে শুনতে হয়েছিল তিনি নরম হিন্দুত্ব-কে উসকানি দিচ্ছেন।
কিন্তু এখন আবার মুসলিম তোষণের অভিযোগ সামলাতে তার দলের ভেতরেও যে বিভ্রান্তি আছে সেই ইঙ্গিতও পরিষ্কার। বিবিসি ।