
আহমেদ জহুর : আহমদ ছফা জ্ঞানী ছিলেন। তাঁর চিন্তার বহুমাত্রিকতা বাংলা সাহিত্যকে করেছে বৈচিত্র্যময়। জাতীয় অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাক, সলিমুল্লাহ খানসহ অনেকের মতে, মীর মশাররফ হোসেন ও কাজী নজরুল ইসলামের পর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বাঙালি মুসলমান লেখক ছিলেন আহমদ ছফা। তাঁর লেখায় বাংলাদেশি জাতিসত্তার পরিচয় নির্ধারণ প্রাধান্য পেয়েছে।
আহমদ ছফার সাথে আমার অনেক স্মৃতি আছে। তাঁর অনন্য সান্নিধ্য আমাকে যুগিয়েছে সাহসের অনুপ্রেরণা। সমৃদ্ধ করেছে আমার মননশীলতাকে। সেসব কথা স্মৃতিচারণে লিপিবদ্ধ করবো। আজ প্রথিতযশা লেখক ও চিন্তাবিদ আহমদ ছফার ৭৯তম জন্মবার্ষিকী। ১৯৪৩ সালের ৩০ জুন জন্মগ্রহণ করেন। তাঁকে জানাই হৃদয়ের শ্রদ্ধাঞ্জলি!
সাহিত্য-সত্তা….
বাংলাদেশের স্বাধীনতার অব্যবহিত পরে রচিত বুদ্ধিবৃত্তির নতুন বিন্যাস (১৯৭২) প্রবন্ধগ্রন্থে আহমদ ছফা বাংলাদেশের বুদ্ধিবৃত্তিক জগতের মানচিত্র অঙ্কন এবং বাংলাদেশি বুদ্ধিজীবীদের সুবিধাবাদিতার নগ্নরূপ উন্মোচন করেন। তিনি বুদ্ধিজীবীদের সত্যিকার দায়িত্বের স্বরূপ ও দিক-নির্দেশনা দেন। বুদ্ধিজীবীদের ব্যর্থতায় বাংলাদেশের কী দুর্দশা হতে পারে সে সম্পর্কেও ভবিষ্যৎবাণী করেন।
আহমদ ছফা তাঁর ‘বাঙালি মুসলমানের মন’ (১৯৭৬) প্রবন্ধে বাঙালি মুসলমানদের আত্মপরিচয়ের হাজার বছরের বিবর্তন বিশ্লেষণপূর্বক তাদের পশ্চাদ্গামিতার কারণ অনুসন্ধান করেছেন। ড. আনিসুজ্জামান ও সলিমুল্লাহ খানসহ আরো অনেকে ছফার বাঙালি মুসলমানের মন (১৯৮১) গ্রন্থকে বাংলা ভাষায় রচিত গত শতাব্দীর ‘সেরা দশ চিন্তার বইয়ের’ একটি বলে মনে করেন।
ছফার রচিত প্রতিটি উপন্যাসই ভাষিক সৌকর্য, বিষয়বস্তু ও রচনাশৈলীর অভিনবত্বে অনন্য। মানসিক, সাংস্কৃতিক ও আর্থসামাজিক সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম অনুষঙ্গসহ ছফার চরিত্র সৃষ্টির তথা কাহিনীকথনের পারঙ্গমতা অসামান্য। আবুল ফজল ও আরো অনেকের মতে, ছফার ওঙ্কার (১৯৭৫) বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের সর্বোত্তম সাহিত্যিক বহিঃপ্রকাশ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক রাজনীতির প্রেক্ষিতে রচিত গাভী বিত্তান্ত (১৯৯৫) বাংলা সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ ব্যঙ্গাত্মক উপন্যাসগুলোর একটি। পুষ্প বৃক্ষ ও বিহঙ্গ পুরাণ-এ (১৯৯৬) ছফা ঢাকা শহরের প্রেক্ষিতে ফুল, পাখি, বৃক্ষ তথা বৃহৎ প্রকৃতির সাথে মানুষের সম্পর্কের এক নিজস্ব বয়ান হাজির করেন তিনি।
আহমদ ছফা ও তাঁর রচনাকর্ম অনেক লেখক, শিল্পী, চলচ্চিত্রকার ও বুদ্ধিজীবীকে অনুপ্রাণিত করেছে; তাঁদের মাঝে অন্যতম এসএম সুলতান, হুমায়ূন আহমেদ, ফরহাদ মজহার, তারেক মাসুদ, সলিমুল্লাহ খান। জীবিতকালে আহমদ ছফা তাঁর প্রথাবিরোধিতা, স্পষ্টবাদিতা, স্বকীয় দৃষ্টিভঙ্গীর জন্য লেখক ও বুদ্ধিজীবী মহলে আলোচিত ও বিতর্কিত ছিলেন। জীবদ্দশায় অনেকে তাঁকে বিদ্রোহী, বোহেমিয়ান, উদ্ধ্যত, প্রচলিত ব্যবস্থার প্রতি শ্রদ্ধাহীন ও বিতর্কপ্রবণ বলে অভিহিত করেছেন।
উল্লেখযোগ্য রচনাবলি….
বুদ্ধিবৃত্তির নতুন বিন্যাস (১৯৭২), বাঙালি মুসলমানের মন (১৯৮১), ওঙ্কার (১৯৭৫), একজন আলী কেনানের উত্থান-পতন (১৯৮৮), অলাতচক্র (১৯৯৩), গাভী বিত্তান্ত (১৯৯৫), অর্ধেক নারী অর্ধেক ঈশ্বরী (১৯৯৬), পুষ্প বৃক্ষ এবং বিহঙ্গ পুরাণ (১৯৯৬), ফাউস্ট (১৯৮৬), যদ্যপি আমার গুরু (১৯৯৮), তসলিমা নাসরিন এবং অন্যান্য প্রসঙ্গ প্রভৃতি
পুরস্কার প্রত্যাখ্যান….
আহমদ ছফা ১৯৭৫ সালে লেখক শিবির পুরস্কার ও ১৯৯৩ সালে বাংলা একাডেমীর সা’দত আলী আখন্দ পুরস্কার প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। ২০০২ সালে বাংলাদেশ সরকার তাঁকে সাহিত্যে মরণোত্তর একুশে পদক প্রদান করে।
মৃত্যুবরণ….
২০০১ সালের ২৮ জুলাই ঢাকায় অসুস্থ অবস্থায় হাসপাতালে নেয়ার পথে আহমদ ছফার মৃত্যু হয়। পরদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মসজিদে জানাজা শেষে মিরপুর বুদ্ধিজীবী গোরস্থানে তাঁকে দাফন করা হয়।
© আহমেদ জহুর, কবি, সাংবাদিক ও প্রাবন্ধিক