ভারতীয় বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ ঔপন্যাসিক ভিএস নাইপল লিখেছিলেন, ভারতীয় একেকটি পরিবার যেন একেকটি গোত্র যা তার সদস্যদের নিরাপত্তা দেয়, পরিচিতি দেয় এবং “সমাজে অপ্রাসঙ্গিক, বাতিল হয়ে পড়া থেকে রক্ষা করে।“
সেই পরিবার কাঠামোতে তেমন কোনো পরিবর্তন হয়নি। অন্তত সাম্প্রতিক গবেষণা তা চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে।
অনেক পর্যবেক্ষক এবং গবেষক ভাবতেন অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, নগরায়ণ, শিক্ষার বিস্তার, সাংস্কৃতিক পরিবর্তনের পরিণতিতে ভারতের যৌথ পরিবার ধীরে হলেও ভেঙ্গে পড়তে বাধ্য।
কিন্তু ভারতীয় পরিবার কাঠামোর ওপর দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের প্রভাব নিয়ে সাম্প্রতিক এক গবেষণা বলছে, বাস্তবে ভারতের অর্থনৈতিক উন্নয়ন এবং নগরায়ণ পরিবার কাঠামোতে তেমন কোনো পরিবর্তন আনতে পারেনি।
গবেষণাটি করেছেন মার্কিন জনতত্ববিদ এবং কর্নেল বিশ্বদ্যিালয়ের গবেষক ড. এটিয়েন ব্রেটন।
মি ব্রেটন বলছেন, যা ধারণা করা হয়েছিল বাস্তবে ভারতের তা হয়নি। ভারতে এক দম্পতি বা এক সদস্যের পরিবারের সংখ্যা বেড়েছে খুব সামান্যই।
একই সাথে দেখা যাচ্ছে যে বিংশ শতাব্দীর শুরুতে ভারতে পরিবারের গড় আকার যা ছিল এখনও তা তেমন বদলায়নি। বিয়ে একটি অবধারিত ঘটনা, বিবাহ বিচ্ছেদের হার খুবই কম, এবং বিয়ে না করা বা সন্তান না হওয়ায় এক বা দুই সদস্যের পরিবারের সংখ্যা নিতান্তই নগণ্য।
বরঞ্চ যৌথ পরিবার এখনও ভারতে খুবই শক্তিশালী, এবং সেদেশের জনসংখ্যার যে বাস্তবতা তার পরিপ্রেক্ষিতে যৌথ পরিবারই এখনও মানুষের রক্ষাকবচ।
বয়স্ক বাবা-মায়েরা অনেক সময় নাতি-নাতনিদের দেখভাল করার জন্য সন্তানদের সাথে থাকেন
“পরিবার কাঠামোর পরিবর্তনকে ভারত শক্তভাবে চ্যালেঞ্জ করে চলেছে,“ বিবিসিকে বলেন ড. ব্রেটন। তার সাম্প্রতিক গবেষণায় তিনি বোঝার চেষ্টা করেছেন কেন এখনও কেন বিশাল সংখ্যায় বাবা-মায়েরা বিবাহিত ছেলের সাথে থাকেন।
ভারতে বিবাহিত নারীরা যৌথ পরিবার ভেঙ্গে আলাদা হয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে খুবই কম ভূমিকা রাখে, যদিও অনেক সময় তাদের স্বামীদের সিদ্ধান্ত গ্রহণে তাদের কিছু প্রভাব হয়ত থাকে।
বাবার মৃত্যুর আগেই ছেলে পরিবার থেকে বেরিয়ে গিয়ে আলাদা বসবাস করছে, এমন উদাহরণ এখনও ভারতের সমাজে বিরল। যদিও বা কেউ কেউ তা করে, তারপরও বাবা বা মায়ের কেউ একজন মারা গেলে বাকি একজনের দায়িত্ব ঐ ছেলের ঘাড়ে এসে পড়ে।
ভারতের জাতীয় নমুনা সমীক্ষা (এনএসএস) থেকে পাওয়া পরিসংখ্যান বলছে, ৬৫ বছর বা তার ঊর্ধ্ব বয়সী মানুষের ৫০ শতাংশেরও বেশি বিবাহিত, এবং ৪৫ শতাংশ বিধবা বা বিপত্নীক। এবং এই বিধবা বা বিপত্নীক জনগোষ্ঠীর প্রায় ৮০ শতাংশই তাদের কোনো না কোনো সন্তানের সাথে বসবাস করে।
পক্ষান্তরে, বয়স্ক দম্পতিদের মাত্র ৪০ শতাংশ হয় নিজেরা না হয় অবিবাহিত সন্তানদের সাথে থাকেন। সন্তানদের ছাড়াই থাকার এই সংখ্যা গত ২৫ বছরে মাত্র ছয় শতাংশ পয়েন্ট বেড়েছে।
ড. ব্রেটন বলছেন, “এই পরিসংখ্যান প্রমাণ করছে ভারতে নিউক্লিয়ার পরিবার অর্থাৎ একক বা এক দম্পতির পরিবারের সংখ্যা বেড়েছে খুবই কম।“
কেন ছেলেরা বাবা-মায়ের সাথে থেকে যায়
কেন ভারতে তরুণ-যুবকরা এখনও তাদের বাবা-মায়ের সাথে থেকে যায়- তার অন্যতম কারণ মানুষের গড় আয়ু বৃদ্ধি। ১৯৮০ সালের তুলনায় ২০২০ সালের ভারতে একজন ৩০ বছরের যুবক তার বাবা-মায়ের মধ্যে অন্তত একজনের সাথে থাকার সম্ভাবনা অনেকটাই বেড়ে গেছে। কারণ তার বাবা-মায়েরা এখন বেশিদিন বেঁচে থাকছে।
আরেকটি প্রধান কারণ- ভারতে নগরায়ণের শ্লথ গতি। এখনও ভারতের জনসংখ্যার মাত্র ৩৫ শতাংশ নগরে বাস করে, যেখানে চীনে সেই সংখ্যা এখন ৬০ শতাংশ। যদিও অনেক গবেষক মনে করেন, ভারতে জনগণনার সময় অনেক নগর অঞ্চলকে ভুল করে গ্রাম হিসাবে দেখানো হয়, তারপরও বড় শহরগুলোতেও যে এক ব্যক্তি বা এক দম্পতির পরিবার খুব যে বেড়েছে তার প্রমাণ নেই।
লন্ডনে কিংস কলেজের সমাজবিজ্ঞানী অ্যালিস ইভান্স বলেন, ভারতে এখনও সিংহভাগ মানুষের যৌথ পরিবারে বসবাস করার পেছন পারিবারিক ব্যবসা এবং চাকরি বা পেশায় নারীদের অপেক্ষাকৃত কম অংশগ্রহণ বড় ভূমিকা রাখছে। তিনি মনে করেন, এসব কারণে পরোক্ষভাবে পরিবারের মধ্যে শক্ত বন্ধন তৈরি হয়।
ভারতে ধনী-শিক্ষিতদের চেয়ে নিরক্ষর শ্রমজীবী মানুষরাই একক পরিবারে বেশি থাকে
সেই সাথে যোগ হয়েছে জীবনযাপনের ব্যয় বৃদ্ধি যার পরিণতিতে বহু মানুষ বাধ্য হয়েই যৌথ পরিবারে আটকে থাকে।
তবে ভারতীয় পরিবারই যে একবারেই ব্যতিক্রমী তা নয়।
ড. ইভান্স বলেন ১৯০০ সালে চীন, জাপান, কোরিয়া এবং তাইওয়ানেও একই চিত্র ছিল। ঐ সব দেশেও যৌথ পরিবারের বাইরে বসবাস একসময় খুবই বিরল ঘটনা ছিল।
“পূর্ব এশিয়ায় পরিবারে শক্ত বন্ধন একসময় ভারতের মত একইরকম ছিল। কিন্তু বিংশ শতাব্দী ধরে পরিবারের বাইরে কর্মসংস্থান, গ্রাম থেকে শহরে অভিবাসন এবং নারীদের কর্মসংস্থান বাড়ার পরে ঐ সব দেশে যৌথ পরিবার আলগা হয়ে গেছে,“ বিবিসিকে বলেন ড, ইভান্স।
পূর্ব এশিয়া কেন বদলে গেল
তবে এখনও পূর্ব এশিয়ার ছেলে-মেয়েরা বৃদ্ধ বাবা-মাকে সাহায্য করে, কিন্তু “সেটা মূলত টাকা-পয়সা দিয়ে, একসাথে বসবাস করে নয়।“
নারীদের কর্মসংস্থান যে যৌথ পরিবার ভেঙ্গে পড়ার প্রধান একটি নিয়ামক, পূর্ব এশিয়া তার প্রমাণ।জাপান, কোরিয়া, তাইওয়ান এবং চীনে গত এক শতাব্দী ধরে নারীরা ক্রমবর্ধমান সংখ্যায় ঘরের বাইরে কাজ করতে যাচ্ছে, ফলে নারী-পুরুষ দুজনেই আয় করায় যৌথ পরিবার থেকে বেরিয়ে স্বাধীনভাবে থাকার আকাঙ্ক্ষা বেড়েছে।
দক্ষিণ কোরিয়ার উদাহরণ টেনে ড. ইভান্স বলেন, সেদেশে বিশাল বিশাল কোম্পানি যখন গড়ে উঠতে শুরু করে, তখন থেকে বহু শ্রমিক একসাথে কারখানায় কাজ করছে, তারা একসাথে ডরমিটরিতে থাকছে, কাজের জায়গায় অধিকারের জন্য একসাথে আন্দোলন করছে। “ফলে তাদের মধ্যে শ্রেণী সচেতনতা জন্ম নিয়েছে এবং পরিবারের বাইরে তারা অন্যদের সাথে সম্পর্ক স্থাপন করতে পরেছে।“
দক্ষিণ কোরিয়ায় নারীদের অর্থনৈতিক স্বাধীনতা যত বেড়েছে, তাদের সন্তান ধারণের সংখ্যা কমেছে। এর ফলে, বাইরে গিয়ে তাদের পক্ষে কাজ করার সুবিধাও বেড়েছে।
কেন দক্ষিণ এশিয়া তেমন বদলায়নি
কিন্তু, ড. ইভান্স বলেন, দক্ষিণ এশিয়ায় সে ধরণের পরিবর্তন তেমন হয়নি।
নগরায়ণ বা শিক্ষার প্রসার ভারতের যৌথ পরিবার কাঠামোতে তেমন প্রভাব ফেলতে পারেনি
“দক্ষিণ এশিয়ায় নারীদের প্রতি বঞ্চনার কারণে তাদের কর্মসংস্থান তেমনি হয়নি। গ্রামাঞ্চলে বাইরে কাজ করা বন্ধ করলে নারীদের সামাজিক ও পারিবারিক মর্যাদা বাড়ে, যেটা পশ্চিম ইউরোপ শিল্প বিপ্লবের শুরুর দিকে দেখা যেত। তাছাড়া. গ্রামে নারীরা কাজ করতে ইচ্ছুক হলেও, কৃষিখাতের যান্ত্রিকী-করণে তাদের কাজের সুযোগ কমে যাচ্ছে।“
নারীদের কর্মসংস্থানের অভাবে তরুণ-যুবক দম্পতিদের অর্থনৈতিক স্বাধীনতা দক্ষিণ এশিয়ায় এখনও কম।ড. ইভান্স বলেন, “নারীরা যদি কাজ করতে বাইরে না যায়, তাদের নেটওয়ার্ক যদি না বাড়ে, বৃহত্তর পরিবারের ভেতরেই জীবন কাটিয়ে দেয়া ছাড়া তাদের কোনো উপায় থাকেনা।“
তবে ভারতের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির মত একই হাল যেসব দেশে সেখানেও পরিবার কাঠামোর চরিত্র কম-বেশি একইরকম।সম্প্রতি ১৫টি উন্নয়নশীল দেশের জন-গণনার তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে স্টিভেন রাগলস্ এবং মিসটি হেগেনিস নামে দুজন গবেষক দেখেছেন, ঐ সব দেশে প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে মানুষজন যৌথ পরিবারে বসবাস করছে, এবং এই কাঠামোতে খুব বেশি পরিবর্তন হয়নি।
তবে অনেক গবেষক দাবি করেন, ভারতে পরিবার কাঠামোর জটিলতা খুব সহজে বিশ্লেষণ করা যাবেনা।
সমাজবিজ্ঞানী ড তুলসি প্যাটেল, যিনি ভারতের পরিবার কাঠামো নিয়ে অনেক লেখালেখি করেন, বলেন ভারতে একক পরিবারকে সংজ্ঞায়িত করাও অনেক সময় জটিল একটি বিষয়।
“বৃদ্ধ বাবা-মায়েরা তাদের নাতি-নাতনিদের সঙ্গ দিতে এবং তাদের দেখা-শোনা করতে এক ছেলের বাড়ি থেকে আরেক ছেলের বাড়িতে যায়। ছেলেরা যখন বিদেশে চলে যায়, তখন তারা মেয়ের বাড়িতেও থাকে। ফলে যৌথ পরিবারের কাঠামোও অদল-বদল ঘটতে থাকে। এমন সব পরিবর্তনশীল পারিবারিক কাঠামোকে আপনি কীভাবে একটি ছাঁচে ফেলবেন?” বিবিসিকে বলেন ড. প্যাটেল।
ধনী-শিক্ষিতরাই যৌথ পরিবার ছাড়েনা
সবচেয়ে মজার বিষয় হলো, ভারতে গরীবদের চেয়ে ধনীরাই তুলনামুলকভাবে অনেক বেশি যৌথ পরিবারে থাকে।ডঃ ব্রেটন তার গবেষণায় দেখেছেন, ভারতে ২০০০ সাল থেকে ৩০ এর কোটায় বয়স এমন বিবাহিত যুবকরা যারা যৌথ পরিবারে থাকে তাদের অধিকাংশই কলেজ ডিগ্রিধারী এবং চাকুরীজীবী।
লেখাপড়া না জানা দরিদ্র কৃষক বা শ্রমজীবীরা সেই তুলনায় অনেক বেশি সংখ্যায় একক পরিবারে থাকে।গরীবদের মধ্যে যৌথ পরিবার থেকে বেরিয়ে যাওয়ার প্রবণতা বেশি থাকার অন্যতম কারণ তাদের বাবা-মায়ের এমন কোনা সম্পত্তি থাকেনা যা দিয়ে তারা ছেলেদের নিয়ন্ত্রণ করতে পারে।
গরীব পরিবারের আয়তন বাড়ার সাথে সাথে অল্প জমিতে ভাগীদার বাড়ে, ফলে পরিবারে অভাব বাড়তে থাকে। এ কারণে, গরীব পরিবারের সন্তানদের মধ্যে যৌথ পরিবারে থাকার আকর্ষণ কম।
ডঃ ব্রেটন বলেন, ভারতে বহু দরিদ্র নিরক্ষর শ্রমজীবীরা বৃদ্ধ বয়সে একা থাকেন। বিশেষ করে কৃষকদের মধ্যে এই প্রবণতা অনেক বেশি। “এতেই প্রমাণিত হয় যে ভারতের আধুনিক, শহুরে এবং বিত্ত-শীল মানুষের সংখ্যা বৃদ্ধি পরিবার কাঠামোতে তেমন প্রভাব ফেলেনি।“
তবে ভারতের পরিবার কাঠামো যে একেবারেই স্থবির হয়ে আছে তা বলা যাবেনা।ধীরে হলেও সমাজে নারীদের ক্ষমতা বাড়ছে। দেখা-শোনা করে বিয়ে হলেও, সঙ্গী নির্বাচনে নারীরা তাদের সিদ্ধান্ত দিচ্ছে। তাছাড়া, যেসব বয়স্ক বাবা-মা অর্থনৈতিকভাবে সচ্ছল, তারা বিবাহিত সন্তানদের সাথে থাকতে চাইছেন না।
এছাড়া, ভারতে পরিবারে সন্তান সংখ্যা কমছে। অনেক পরিবারে একটি ছেলে বা কোনো ছেলেই এখন নেই। ড. ব্রেটন মনে করেন, কম ছেলে সন্তান এবং ছেলে সন্তান বিহীন পরিবারের মধ্যে যৌথ পরিবার গঠনের আগ্রহ কমবে।
গবেষকরা বলছেন, ভবিষ্যতে হয়ত বাবা-মায়েরা বৃদ্ধ বয়সে ছেলের সাথে না থেকে নানা সাহায্যের জন্য তাদের বিবাহিতা মেয়েদের দ্বারস্থ হবেন।
তবে ড, ব্রেটন মনে করেন ভারতে শিক্ষিত এবং সম্পন্ন মানুষদের চেয়ে নিরক্ষর শ্রমজীবীরাই পরিবার কাঠামো পরিবর্তনের চালিকা শক্তি হবে। সুত্র : বিবিসি