দক্ষিণ ভারতের ভেলোরে বিখ্যাত ক্রিশ্চিয়ান মেডিক্যাল কলেজ বা সিএমসি-তে মায়ের লিভারের চিকৎসা করাতে গত ৫ মার্চ ভারতে এসেছিলেন ঢাকার বাসিন্দা সাইফুল ইসলাম। গত ২৪ তারিখ তার মায়ের অস্ত্রোপচার সফলভাবে সম্পন্নও হয়েছে।
যে দিন সিএমসি-তে সাইফুল ইসলামের মায়ের অস্ত্রোপচার হয়, সে দিন রাতেই গোটা ভারত জুড়ে ‘টোটাল লকডাউন’ জারির কথা ঘোষণা করেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী।
বিদেশি নাগরিকদের জন্য সীমান্ত সিল করে দেওয়া হয়েছিল আরও অনেক আগে থেকেই, বন্ধ হয়ে গিয়েছিল আন্তর্জাতিক বিমানের ওঠানামাও।
ফলে হাসপাতাল মাকে এখন ডিসচার্জ করে দেওয়ার পরও মহাবিপদে পড়েছেন সাইফুল ইসলাম। তার দেশে ফেরার এখন কোনও উপায়ই নেই।
ভেলোর থেকে তিনি বিবিসিকে বলছিলেন, “এদিকে হাতের টাকা-পয়সাও ক্রমশ ফুরিয়ে আসছে।”
“হাসপাতালের বিল মেটালেও এই বাড়তি দিনগুলোর জন্য হোটেলের ভাড়া কীভাবে দেব বুঝতে পারছি না। আর কতদিন যে থাকতে হবে সেটাও তো কিছুই জানি না!”
তারই মতো অবিকল একই দশা নারায়ণগঞ্জের সাখাওয়াত হোসেন বা কুমিল্লার বিক্রম কর্মকারের – পরিবারের সদস্যদের চিকিৎসা করাতে এসে তারাও এখন ভেলোরে আটকা পড়ে গেছেন।
পয়সার টানাটানিতে গুনেগেঁথে শুধু ডাল আর ভাত দিয়ে গতকাল দুপুরের খাওয়া সেরেছেন তাদের কেউ কেউ। লকডাউনের জেরে ভারতের বাজারেও জিনিসপত্রের দাম এখন অগ্নিমূল্য – তাতে আরও ভোগান্তি বেড়েছে এই বিদেশিদের।
দিল্লির অ্যাপোলো হাসপাতালে হার্টের চিকিৎসা নিতে এসে একইভাবে অনির্দিষ্টকালের জন্য স্বামী-পুত্রকে নিয়ে ভারতে আটকা পড়ে গেছেন চট্টগ্রামের এক নারী যিনি সংবাদমাধ্যমের কাছে নিজের নাম অবধি বলতে চান না, কারণ ভারতে তার ভিসার মেয়াদও ফুরিয়ে গেছে গত ২৫ মার্চ।
২৩ মার্চ দিল্লি থেকে ইন্ডিগো এয়ারলাইন্সের বিমানে তার সপরিবারে ঢাকা ফিরে যাওয়ার কথা ছিল, কিন্তু তার আগেই সব আন্তর্জাতিক উড়ান বাতিল করে দেয় ভারত – অগত্যা তারা এখন দক্ষিণ দিল্লির একটি গেস্ট হাউসে গৃহবন্দী।
শুধু চিকিৎসা নয় – বেড়াতে এসে ভারতে আটকা পড়েছেন এমন বাংলাদেশী নাগরিকের সংখ্যাও কম নয়।
গত ফেব্রুয়ারি মাসের শেষ দিকে ভারত ভ্রমণের বিশাল ট্যুর প্যাকেজ নিয়ে এ দেশে ঢুকেছিলেন বরিশালের নাবিলা আঞ্জুমান ও তার আরও জনাদশেক সঙ্গী।
সাড়ে তিন সপ্তাহ নিরুপদ্রবে ঘুরে বেড়ানোর পর গত ১৮ মার্চ থেকে তারা কর্নাটকের মাইসোরে আটকা পড়ে আছেন।
নাবিলা বলছিলেন, “যে কোনওভাবে টাকা পাঠানোর জন্য আমরা দেশে খবর পাঠিয়েছি। বুঝতে পারছি না কীভাবে কী করব!”
“আমাদের পাশের একটি গেস্ট হাউসেও বাংলাদেশী ট্যুরিস্টদের আর একটি দল আটকা পড়ে আছেন”, জানাচ্ছেন তিনি।
করোনাভাইরাসের সঙ্কট সামাল দিতে ভারত তাদের বর্ডার সিল করে লকডাউন জারি করার পর এভাবেই শত শত বাংলাদেশি নাগরিক ভারতে আটকা পড়েছেন।
উপায় খতিয়ে দেখছে বাংলাদেশ দূতাবাস
এখন তাদের কীভাবে দেশে ফিরিয়ে আনা সম্ভব, তার উপায়গুলো বাংলাদেশ সরকার খতিয়ে দেখছে।
দিল্লিতে বাংলাদেশ দূতাবাসের একটি সূত্র বিবিসিকে জানিয়েছে, “আমরা এই মুহুর্তে বাংলাদেশের এরকম আটকে-পড়া নাগরিকদের একটি পূর্ণাঙ্গ তালিকা প্রস্তুত করছি।”
সেই তালিকা তৈরি হলে তার মধ্যে থেকে যারা অবিলম্বে দেশে ফিরতে চান, তাদের বিশেষ বিমানের ব্যবস্থা করে ফেরানো যায় কি না – সেই সম্ভাবনাও খতিয়ে দেখা হচ্ছে বলে ইঙ্গিত মিলেছে।
দিল্লিতে বাংলাদেশ হাইকমিশনের ফেসবুক পেজেও এদিন (সোমবার) দিল্লি ও মুম্বাইতে তাদের দুটি হটলাইন নম্বর দিয়ে আটকে পড়া নাগরিকদের জরুরি প্রয়োজনে সেখানে যোগাযোগ করার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।
বিদেশে আটকে পড়া বাংলাদেশি নাগরিকদের সুবিধার্থে বাংলাদেশ ব্যাঙ্ক অনুমোদিত ফরেন এক্সচেঞ্জ ডিলার ও ব্যাঙ্কগুলোর প্রতি যে জরুরি নির্দেশিকা জারি করেছে, তার একটি প্রতিলিপিও সেখানে দেওয়া হয়েছে।
ভিসার মেয়াদ নিয়ে কিছু ছাড় দিচ্ছে ভারত
এদিকে ভারতের পক্ষ থেকেও বাংলাদেশকে আশ্বাস দেওয়া হয়েছে, এর মধ্যে যাদের ভিসার মেয়াদ ফুরিয়ে গেছে তাদের কোনও জরিমানার মুখে পড়তে হবে না – এবং এই বাংলাদেশীদের ভারতে ‘ওভারস্টে’-কেও বৈধ বলে গণ্য করা হবে।
সাধারণত ভিসার মেয়াদ উত্তীর্ণ হওয়ার পরও কোনও বিদেশি নাগরিক ভারতে থেকে গেলে তাকে সরকারের এফআরআরও বা বিদেশি পঞ্জীকরণ কেন্দ্রে গিয়ে মোটা অঙ্কের জরিমানা গুনতে হয়।
কিন্তু ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় একটি নোট পাঠিয়ে বাংলাদেশকে জানিয়েছে, এই ব্যতিক্রমী পরিস্থিতিতে সেই জরিমানা থেকে ছাড়ের ব্যবস্থা করা হবে।
চিকিৎসা বা পর্যটনের জন্য ভারতে এসে এখন আর দেশে ফিরতে পারছেন না, এরকম বাংলাদেশীর সংখ্যা মোট কত তা এখনও নির্দিষ্ট করে বলা সম্ভব হচ্ছে না।
তবে খুব কম করে হলেও এই সংখ্যা বেশ কয়েকশো হবে বলেই ধারণা করা হচ্ছে – হাতে টাকাপয়সাও ফুরিয়ে যাওয়ায় তাদের বেশির ভাগই এই মুহুর্তে প্রবল বিপদে আছেন।
হায়দ্রাবাদে এমনই একজন আটকে পড়া বাংলাদেশি আনোয়ার হুসেইন, গত ১৯ মার্চ যার ভিসার মেয়াদ ফুরিয়েছে।
হায়দ্রাবাদ থেকে টেলিফোনে তিনি এদিন বলছিলেন, “ফেসবুকে দেখলাম আমাদের পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী না কি বলেছেন যে নাগরিকরা ১৪ দিনে সরকারি সেন্টারে কোয়ারেন্টিনে থাকার মুচলেকা দেবেন শুধু তাদেরই না কি ফেরানো হবে।“
“আমি বলতে চাই, তাতে কোনও সমস্যা নাই। ১৪ দিন কেন, আরও বেশিদিন কোয়ারেন্টিনে থাকতেও আমাদের কোনও আপত্তি নাই, কিন্তু দয়া করে দ্রুত আমাদের ভারত থেকে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করুন!” – রীতিমতো করুণ আর্তি জানান তিনি। বিবিসি