ঈদ মোবারক

শনিবার সারা দেশে পবিত্র ঈদুল আজহা উদযাপিত হচ্ছে। ঈদ মোবারক। ত্যাগের মহিমায় চিরভাস্বর পবিত্র এ উৎসব পালনে ইতোমধ্যেই বিভিন্ন প্রস্তুতি নিয়েছেন ধর্মপ্রাণ মুসলমানেরা। এ ঈদে পশু কোরবানিই প্রধান ইবাদত। এ জন্য এখন চলছে কোরবানির পশু কেনার পর্ব। অনেকে ইতোমধ্যে পশু কিনেছেন, আজো কিনবেন অনেকে।
ঈদুল আজহা উপলে আজ থেকে তিন দিনের সরকারি ছুটি শুরু হয়েছে। তবে এর আগেই রাজধানী ঢাকা ছেড়েছেন কয়েক লাখ লোক। গত কয়েক দিনে বাস, ট্রেন ও লঞ্চ টার্মিনালে ছিল মানুষের উপচে পড়া ভিড়। ফলে রাজধানী কিছুটা ফাঁকা হয়ে গেছে। তবে সড়ক ভাঙাচোরা থাকায় ও তীব্র যানজটের কারণে পথে পথে ব্যাপক ভোগান্তির শিকার হতে হয়েছে যাত্রীদের। তার পরও প্রিয়জনের সাথে আনন্দ উপভোগের আশায় সব কিছু তুচ্ছ মনে করে নাড়ির টানে বাড়ি ফিরেছেন তারা। ঈদকে সামনে রেখে জাতীয় দৈনিকগুলোয় বিশেষ সংখ্যা বের হয়েছে। বাংলাদেশ টেলিভিশন, বাংলাদেশ বেতার, সব ক’টি বেসরকারি টিভি চ্যানেল ও এফএম রেডিও ঈদ উপলে কয়েক দিনব্যাপী বিশেষ অনুষ্ঠানমালা সম্প্রচার করবে।
হিজরি বর্ষপঞ্জি অনুসারে জিলহজ মাসের ১০ তারিখে ঈদুল আজহা পালিত হয়। আরবি ‘আজহা’ ও ‘কোরবান’ উভয় শব্দের অর্থ হচ্ছে উৎসর্গ। কোরবানি শব্দের উৎপত্তিগত অর্থ হচ্ছে আত্মত্যাগ, আত্মোৎসর্গ, নিজেকে বিসর্জন, নৈকট্য লাভের চেষ্টা, অতিশয় নিকটবর্তী হওয়া প্রভৃতি।
ইসলামের পরিভাষায় কোরবানি হলো নির্দিষ্ট পশুকে একমাত্র আল্লাহর নৈকট্য ও সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে নির্দিষ্ট সময়ে তারই নামে জবাই করা। মহান সৃষ্টিকর্তার দরবারে জবাই করা পশুর গোশত বা রক্ত কিছুই পৌঁছায় না, কেবল নিয়ত ছাড়া।
সূরা হজে বলা হয়েছে, ‘এগুলোর গোশত ও রক্ত আল্লাহর কাছে পৌঁছে না, কিন্তু তোমাদের তাকওয়া পৌঁছে যায়।’ আল্লাহর বান্দারা কে কতটুকু ত্যাগ ও খোদাভীতির পরিচয় দিতে প্রস্তুত এবং আল্লাহ পাকের নির্দেশ পালন করেন, তিনি তা-ই প্রত্য করেন। প্রত্যেক আর্থিক সামর্থ্যবান মুসলমানের ওপর কোরবানি করা ওয়াজিব। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, যে ব্যক্তি সামর্থ্য থাকার পরও কোরবানি দিলো না, সে যেন আমার ঈদগাহে না আসে’ (মুসনাদে আহমদ)।
কোরবানির ইতিহাস সুপ্রাচীন। হজরত ইব্রাহিমের (আ:) সুন্নত অনুসরণ করেই সারা বিশ্বের মুসলমানেরা ১০ জিলহজ কোরবানি দিয়ে থাকেন। হজরত ইব্রাহিম (আ:) স্বপ্নে তাঁর সবচেয়ে প্রিয় বস্তু কোরবানির জন্য মহান আল্লাহ তায়ালার নির্দেশ পেয়েছিলেন। পরপর দু’বার তিনি পশু কোরবানি করেন। তৃতীয়বার একই নির্দেশ পেয়ে তিনি অনুধাবন করেন শেষ বয়সে জন্ম নেয়া পুত্র ইসমাইলের চেয়ে প্রিয় তাঁর কেউ নেই। আল্লাহ পাক তাঁকেই কোরবানি করতে নির্দেশ দিচ্ছেন। হজরত ইব্রাহিম (আ:) তাঁর প্রাণপ্রিয় পুত্র হজরত ইসমাইল (আ:)- কে আল্লাহর নির্দেশ জানালেন। শিশু ইসমাইল (আ:) নির্ভয় চিত্তে সম্মতি দিয়ে পিতাকে আল্লাহ তায়ালার নির্দেশ পালন করতে বলেন। কোরবানি করতে উদ্যত হজরত ইব্রাহিমের (আ:) পুত্রস্নেহে যেন হৃদয় দুর্বল না হয়ে পড়েন, সে জন্য তিনি চোখ বেঁধে নিয়ে পুত্রের গলায় ছুরি চালিয়েছিলেন। আল্লাহ তায়ালার অপার কুদরতে এ সময় হজরত ইসমাইলের (আ:) পরিবর্তে দুম্বা কোরবানি হয়ে যায়। হজরত ইব্রাহিমের (আ:) অনুপম ত্যাগের অনুসরণে হাজার হাজার বছর ধরে বিশ্ব মুসলমানেরা কোরবানি করে আসছেন। তাঁরই নিদর্শনস্বরূপ প্রতি বছর হজ পালনকারীরা কোরবানি দিয়ে থাকেন। একই সাথে দেশে দেশে মুসলমানেরা পশু কোরবানি দিয়ে থাকেন।
ঈদের জামাতের আগে আলোচনায় ইমাম-খতিবেরা হজরত ইব্রাহিমের (আ:) আত্মত্যাগের এ কাহিনী তুলে ধরবেন। ঈদের জামাতে ব্যক্তি, সমাজ, দেশ, মুসলিম উম্মাহ ও সারা বিশ্বের শান্তি ও কল্যাণ কামনা করে দোয়া করা হবে। ১০ জিলহজ পবিত্র ঈদুল আজহা অনুষ্ঠিত হলেও পরের দুই দিন অর্থাৎ ১১ ও ১২ জিলহজেও কোরবানি করার বিধান রয়েছে। সাধারণত উট, দুম্বা, গরু, মহিষ, ছাগল ও ভেড়া এসব পশুই কোরবানি করার বিধান রয়েছে। কোরবানিকৃত পশুর তিন ভাগের এক ভাগ গরিব-মিসকিন, এক ভাগ আত্মীয়স্বজনের মধ্যে বিলিয়ে দিতে হয়। আবার পুরোটাই বিলিয়ে দেয়া যায়। এ দিকে ৯ জিলহজ ফরজ নামাজের পর থেকে ১৩ জিলহজ আসর পর্যন্ত প্রতি ফরজ নামাজের পর তাকবিরে তাশরিক পাঠ করা ওয়াজিব। তা হলো, ‘আল্লাহু আকবার, আল্লাহু আকবার, লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়াল্লাহু আকবার, আল্লাহু আকবার, ওয়ালিল্লাহিল হামদ।’
ঈদুল ফিতরের মতো ঈদুল আজহায় ঠিক আগের দিনে চাঁদ দেখা নিয়ে অনিশ্চয়তা নেই। ১০ দিন আগেই ঠিক হয়ে যায় ঈদের দিনণ। ঈদুল আজহা আমাদের দেশের মানুষের কাছে ‘কোরবানির ঈদ’ নামেই পরিচিত। কোরবানির পশু কেনা, তার যতœ-পরিচর্যায়ই ঈদের মূল প্রস্তুতি ও আনন্দ।
ইতোমধ্যে সারা দেশে জমে উঠেছে কোরবানির পশুহাট। রাজধানী ঢাকায় ট্রাকে করে কোরবানির গরু, মহিষ, ছাগল, ভেড়া আনা হয়েছে দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে। কোরবানিদাতারা পছন্দের পশুটি কেনার জন্য গাবতলীর প্রধান হাটসহ সুবিধামতো বিভিন্ন হাটে যাচ্ছেন। গতকাল পর্যন্ত অনেকেই কোরবানির পশু কিনেছেন। তবে আজ শেষ দিনে সবচেয়ে বেশি কেনাবেচা হবে। চলতি পথে প্রায়ই চোখে পড়ে গলায় রঙিন কাগজ ও জরির মালা জড়ানো হৃষ্টপুষ্ট ষাঁড়ের দড়ি ধরে ঘরমুখো চলছেন কোরবানিদাতারা, আর পাশ থেকে কেউ জিজ্ঞেস করছেন ‘ভাই দাম কত’ এটাই এখন রাজধানীর অন্যতম চিত্র হয়ে উঠেছে। কোরবানির পশু কিনে ভবনের কার পার্কিং ও সামনের ফুটপাথে রাখা হচ্ছে। পাড়া-মহল্লার অলিগলিতে শুধু গরু আর গরু। সর্বত্রই এখন শোনা যাচ্ছে গবাদিপশুর ডাক। এ ছাড়া গরুর খাবার তাজা কাঁঠালপাতা, খড়-বিচালি-ভুসি প্রভৃতি বিক্রি হচ্ছে অলিগলিতে।
বাণী : পবিত্র ঈদুল আজহা উপলে রাষ্ট্রপতি মো: আবদুল হামিদ, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া পৃথক বাণীতে দেশবাসীকে ঈদের শুভেচ্ছা জানিয়েছেন।
রাষ্ট্রপতি তার বাণীতে বলেছেন, ঈদুল আজহার ত্যাগের আদর্শ ব্যক্তি ও সমাজজীবনে প্রতিফলিত হলে পারস্পরিক হিংসা-বিদ্বেষ কমে সমাজে শান্তি প্রতিষ্ঠিত হবে। তবে ধর্মকে ব্যবহার করে কেউ যেন ফায়দা লুটতে না পারে, সে ব্যাপারে সজাগ থাকার জন্য তিনি আহ্বান জানিয়েছেন।
প্রধানমন্ত্রী তার বাণীতে ঈদুল আজহার তাৎপর্য অন্তরে ধারণ করে নিজ নিজ অবস্থানে থেকে জনকল্যাণকর কর্মসূচিতে অংশ নিয়ে বিভেদ-বৈষম্যহীন সুখী-সমৃদ্ধ সমাজ গড়ার জন্য আহ্বান জানিয়েছেন। বিএনপির চেয়ারপারসন তার বাণীতে ত্যাগের মহিমায় উজ্জীবিত হয়ে সমাজে শান্তি ও সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠায় আত্মনিবেদিত হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন।
সুত্র : নয়া দিগন্ত