sliderফিচারশিরোনাম

অন্ধকার কে অভিশাপ না দিয়ে মোমবাতি জ্বালুন

রুহুল ইসলাম টিপু: বাংলাদেশ বন্যা কবলিত। ২৪ আগষ্ট ২০২৪ পর্যন্ত তথ্য অনুযায়ী-বন্যা সবচেয়ে ভয়ংকর রূপ ধারণ করেছে ফেনীতে। জেলায় ৩ লক্ষ মানুষ বন্যা আক্রান্ত। ২০ হাজার মানুষকে উদ্ধার করে বিভিন্ন আশ্রয় কেন্দ্রে রাখা হয়েছে। শ্রোত এবং বন্যার পানির কারণে উদ্ধার কর্মীর অনেকেই ফিরে আসতে বাধ্য হয়েছেন; নেটওয়ার্ক সমস্যায় স্বজনদের সাথে দেশের অন্যত্র এবং প্রবাস থেকে মোবাইল যোগাযোগ ব্যাহত হচ্ছে- বলে সংবাদ মাধ্যমে এসেছে। ফেনীতে বন্যা দুর্গতদের বাঁচাতে গিয়ে পানিতে ডুবে মারা গেছেন রামগঞ্জের বাসিন্দা সাইফুল ইসলাম সাগর। বন্যা কবলিত অপর জেলাগুলো হচ্ছে- চট্টগ্রাম, কুমিল্লা, নোয়াখালী, সিলেট, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ,ব্রাম্মণবাড়িয়া, লক্ষ্মীপুর, খাগড়াছড়ি, রাঙামাটি ও কক্সবাজার। ১৫ জনের মৃত্যুর খবর এসেছে।

সিলেটে এটি চতুর্থ দফায় বন্যা। সুনামগঞ্জসহ বৃহত্তর সিলেট এ বছর তিনবার বন্যায় কবলে পড়েছে। আগষ্ট মাসে এ নিয়ে তিনবার বন্যা হলো খাগড়াছড়িতে। ১১ জেলায় ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের সংখ্যা ৪৪ লক্ষ ৯৭ হাজার ৫ শত ৩৫ জন। ৮ লক্ষ ৮৭ হাজার ৬ শত ২৯ পরিবার পানি বন্দি অবস্থায় আছেন। আশ্রয় কেন্দ্রে আশ্রয় নিয়েছেন ১ লক্ষ ৮৮ হাজার ৭ শত ৩৯ জন। বন্যা পরিস্থিতি উন্নতি হচ্ছে। পুনর্বাসন কার্যক্রমের উপর জোর দেওয়া হচ্ছে। মানুষ ঘুরে দাঁড়ানোর আপ্রাণ সংগ্রামে স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করছেন। বাংলাদেশের সংগ্রামের তো শেষ নেই। প্রাকৃতিক মনুষ্য সৃষ্ট কত রকমফের কত সংগ্রাম। তবুও বাঁচতে হয়। আমরা বেঁচে আছি। চাই স্বাভাবিক জন্ম স্বাভাবিক মৃত্যু’র নিশ্চয়তা। এটিই মানবাধিকারের প্রথম কথা। বাংলাদেশ হোক এমন এক রাষ্ট্র।

অন্ধকার’কে অভিশাপ না দিয়ে মোববাতি জ¦ালুন শিরোনাম মাথায় ঘুরপাক খায়- বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলাকালীন এবং সফলতার সময়। সুখ শান্তি সমৃদ্ধির বাংলাদেশের নাগরিক হিসেবে হিংসা বিদ্বেষ ধ্বংস মৃত্যু নয়, চাই আলো জ্বালাতে। আমরা আলো জ্বালাতে পারি; বিশ্ব জানে বাংলাদেশবাসীর সক্ষমতা। অন্ধকারে হাবু ডুবু খাওয়া জাতি তো আমরা নই। আলোর মিছিল
হাতে আমরাই পৃথিবীকে পথ দেখাবো। দেশের একাংশ আজ বন্যা কবলিত। দুবাই প্রবাসী সাইফুল হাসান কাঁদতে কাঁদতে বলেন, আমার বউ, বাচ্চা, বাবা, মা—-খাবার অভাবে মারা যাইতেছে। ভিডিও বার্তার সংবাদটি বিবিসি বাংলায় এসেছে। কান্না বাংলাদেশ হতে শেষ হচ্ছেই না। আইন বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা আসিফ নজরুল এর বর্ণনা,‘প্রথমে চাকুরির কোটা এবং তারপর সরকার পতনের আন্দোলনকে কেন্দ্র করে জুলাই ও আগষ্ট মাসে বাংলাদেশে ঘটে যাওয়া হত্যাকান্ড হচ্ছে ‘জুলাই গণহত্যা’। স্বৈরচারী সরকারের পতনের মধ্য দিয়ে সফল হলো আন্দোলন। ৩৬ জুলাই ২০২৪। দিনটি গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডারে ০৫ আগষ্ট ২০২৪। বাস করি উত্তরা এলাকায়। ০৯ আগষ্ট ২০২৪ সন্ধ্যায় তিন নম্বর সেক্টরের ফ্রেন্ডস ক্লাব মাঠে ছাত্র-জনতা আন্দোলনে জীবননোৎসর্গ শহীদদের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে মোমবাতি প্রজ্বলন করা হয়। দুই কন্যা কাঁদতে কাঁদতে ছুটছে মাঠে। আমিও তাঁদের পিছে যাই। মাঠে মানুষ আর মানুষ। রাস্তায় মানুষ। ফুটপাতে মানুষ। আনাচে কানাচে মানুষ। উত্তরাবাসী এখন
ফ্রেন্ডস ক্লাব মাঠে। মানুষ কাঁদছে। কাঁদছেন তানভীনের মা। তিনি তানভিনকে পাঠিয়ে ছিলেন ব্যাংকে। মায়ের আর্তি তানভীন কে বাইরে না পাঠালে হয়ত সে বেঁচে যেতো। এ মৃত্যু মেনে নেওয়া কঠিন। ৬০ থেকে ৭০টি গুলি খেয়েছে তানভীন। বুকটা ঝাঝড়া করা হয়েছে। এ নির্মমতা মেনে নেওয়া যায় না। সকলের অনুভূতি এক। উৎকন্ঠা ভয় ছাত্রদের পাশে থেকে কিছু না করতে পারার কষ্ট। স্বজন হারানো শত মৃত্যু শোক অনেক ধ্বংস সহিংসতা ভয় বিভীষিকাময় জুলাই গণহত্যা’র উপর একরাশ ধকল সহেছে প্রিয় বাংলাদেশ। আন্দোলন সফলতা পায় ছাত্র- জনতার সাথে মায়েদের যুক্ত হওয়ায় সম্পৃক্ততায়। এই অভিব্যক্তি প্রকাশ করেন স্বজন হারানো মায়েরা। উত্তরা থেকে ছাত্র-জনতা আন্দোলনের নেতৃবৃন্দ সকলে আজ শোকার্ত। জুলাই গণহত্যার স্মারক রক্তাক্ত শার্ট এখন ইতিহাস। গাড়িচালক সাধারণ মানুষ বিভিন্ন পেশাজীবী কান্নাজড়িত কন্ঠে প্রকাশ করেন আবেগ মনের অভিব্যক্তি। জ্বালিয়ে দেওয়া হলো হাতে হাতে মোমবাতি। এক হাত হতে শত হাতে। মোমবাতি’র আলোতে জ্বলে উঠে উত্তরা আলো ছড়িয়ে পড়ে বাংলাদেশে। আমরা তো আলো ছড়িয়ে দিতে চাই বিশে্ব।
ছাত্র জনতার বৈষম্য বিরোধী জুলাই গণহত্যার আন্দোলনের ফসল নোবেল জয়ী অর্থনীতিবিদ ড.মুহাম্মদ ইউনুস এর নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের পূর্বেই সুপ্রীম কোর্টের আপীল বিভাগ বৈধতার উপর রুলিং প্রদান করে। তবে শোকে মাতম দেশ। এ আন্দোলনে ৬৫০ জন নিহত হয়েছেন বলছে জাতিসংঘ। ছাত্র আন্দোলনে ১ হাজারেরও বেশি
মানুষের মুত্যু হয়েছে বলে ভারতীয় গণ মাধ্যমে মন্তব্য করেন সদ্য সাবেক স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা ও বর্তমানে বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অবঃ) এম সাখাওয়াত হোসেন। রাষ্ট্র এবং বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের এখন প্রধান চ্যালেঞ্জ আইন শৃঙ্খলা পুরোদমে ফিরিয়ে আনা। বিদায়ী সরকারের রাষ্ট্রের অনুগত আইন শৃঙ্খলা বাহিনী আইনানুগ দায়িত্ব পালনে ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে। এ আন্দোলনে এবং বিদায়ী সরকারের সময় যেসব নিরাপধরাধ নাগরিক অকারণে জীবন দিয়েছেন শহীদ হয়েছেন তাদেরকে রাষ্ট্রের বিচারালয়ে আইনানুযায়ী শাস্তির ব্যবস্থা জরুরী।

ভুলে যাই আমি, ভুলে যাও তুমি। ভুলে যাক পুরো জাতি, কিভাবে মানুষ মরেছে অকালে, কিভাবে কেটেছে রাতি। আমি ভুলে যাই কিভাবে বুলেট ছিদ্র করেছে মুগ্ধকে, তুমি ভুলে যাও আবু সাইদের বিশ্বাসে ভরা বুকটাকে। এটি বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনের সময় পারশা মাহজীবন পূর্ণী’র গান। এ সময় আরো অনেক সঙ্গীত এসেছে। সকল সঙ্গীত আমাদেরকে উজ্জীবিত করেছে। সত্যি আমি ভুলতে চাই। ভুলা যায় না সন্তানের মূখ। জীবন থেকে সন্তান কে ভাই কে বোন কে দেশের মানুষকে আলাদা করা যায় না। আমরা যে এক এবং অভিন্ন। একই সত্ত্বা। বাঙালী এবং বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদীর সকলেই মিলেই তো আমরা। কোনরূপ বৈষম্য বাংলাদেশের জন্য আর নয়। বৈষম্য থাকবে অতীত যাদুঘরে। আমাদের সন্তান ভাই বোন পিতা মাতা- আবু সাইদ (২৩), আব্দুল আহাদ (৪), আবু তাহের (৩৫), আহসান হাবিব (২৫), আরাফাত ইসলাম আকাশ (১৬),আকরাম খান রাব্বী (২৮), আমিনুল ইসলাম আমিন (১৬), আসিফ ইকবাল (৩১), আজিজুল মিয়া (২২), দুলাল মাহমুদ, ফয়সাল আহমেদ শান্ত (২০) ফারহান ফাইয়াজ (১৭), গণি শেখ (৪৫), হাফেজ মো. সাদিকুল ইসলাম (১৭), হৃদয় চন্দ্র তারুজ্য (২২), ইরফান ভূইয়া (২২), জিসান আহমেদ (১৯),জোবায়ের আহমেদ (২০), খালিদ হাসান (১৬), মাহমুদুর রহমান সৈকত (১৯), মারুফ হোসেন(২০), মো. আদিল (১৬), মো. আহাদুন (১৬), মো. হাসান হোসেন (১৮), মো. ওমর ফারুক (২৪),মো. শাহজাহান (২৫), মো. টিটু হাওলাদার (৩৩), মো. জামান মিয়া (১৭), মোনায়েল আহমেদ ইমরান (১৬), মোস্তফা জামান সমুদ্র (১৭), মীর মাহফুজুর মুগ্ধ (২৫), মো. আরিফ (১৭), মোবারক হোসেন (১৩), মোহাম্মদ সোহেল (৩৫), মামুন হোসেন (২৮), মেহেদী হাসান (২৬), নাঈমা
সুলতানা (১৫), নাজমুল কাজী (৩৪), নুর ই আলম সিদ্দিক রাকিব (২০), রাকিব হাসান (২২), রিদয় আহমেদ শিহাব (১৮), রিদওয়ান শরীফ রিয়াদ (২১), রুদ্র সেন (২০), রবিউল ইসলাম, রিয়া গোপ (৬),রিদওয়ান হোসেন সাগর (২৪), শেখ আশহাবুল ইয়ামিন (২৪), শেখ ফাহমিন জাফর (১৮), শাওন খান (১৯), সাইফুল ইসলাম (৩৫), সাদ মাহমুদ (১৪), সজিব সরকার (৩১), সুমাইয়া আক্তার সুমি (২০), সবুজ আলী (২৬), শেখ শাহরিয়ার বিন মতিন সৌহার্ত্য (১৯), তাহির জামান প্রিয় (৩০),তাহমিদ ভূইয়া তামিম (১৫), জিহাদ হোসেন (২৪), জাকির হোসেন (২৯), গিয়াস উদ্দিন (৫৮), মাসুদ পারভেজ ভূইয়া, মুক্তাদির (৫০), জুয়েল শেখ, জাহিদুজ্জামান তানভীরসহ অনেক অনেক’কে আমরা হারিয়েছে। এখানে এসেছে সামান্য কয়েকটি নাম; কিন্তু অপরিসীম প্রেরণা। স্বৈরাচার বিরুদ্ধে আন্দোলনে নব স্বাধীনতার শহীদানের সামান্য অংশ। শহীদের তালিকায় আছেন ৪ ও ৬ বছর বয়সের আব্দুল আহাদ ও রিয়া গোপ; আছেন সাংবাদিক, ফল বিক্রেতা, ক্রিকেটার, ফ্যাক্টরি ওয়ার্কার, চাকুরিজীবী, ডাব বিক্রেতা, ব্যাংকার, ইলেকট্রিসিয়ান, শ্রমজীবী, বিক্রেতা, হকার,গাড়ী চালক, রেস্তোরার ওয়েটার, দুধ বিক্রেতা, মোবাইল সার্ভিসিং এজেন্ট, ক্লিনার, দোকানের কর্মচারী, দোকান মালিক, কৃষক, শিক্ষক, গৃহিণী, টেইলার্স, পুলিশ, আনসার সদস্য এবং বাকী অন্যরা সবাই শিক্ষার্থী, আন্দোলনের পুরোধা। চাই বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনের সকল শহীদ
এর পূর্ণাঙ্গ তালিকা। ছাত্র সমাজ আন্দোলন শুরু করেছিলেন। জীবন দিয়ে স্বৈরাচার বিদায় করে জাতিকে সফলতা এনে দিলেন। এই তো নতুন স্বাধীনতা।

সবই ছিল পূর্নীর গানে। আমি গান শুনি। তবে গানের বিজ্ঞান বুঝি না। জেনেছি আমার সোনার বাংলা তোমায় ভালোবাসি; এ গানটি স্বরলিপি থেকে গলায় তোলা ভীষণ কঠিন কর্ম। একাত্তরে আমার সোনার বাংলা যখন বাঙালীর গলায় চলে আসে তখন শিল্পীসমাজ উপলব্ধি করেন বাঙালীর বিজয় অবিসম্ভাবী। হলোও তাই। দেশবাসী অনেক অনেক গান পেয়ে যান এ ছাত্র-জনাতার আন্দোলন থেকে। তখনই বাংলাদেশ বুঝে ফেলেছে স্বৈরাচার আর নয়। গণতন্ত্রের জোয়ারে মানুষের মনের শক্তিকে রুখে দাঁড়ানো আর সম্ভব নয়। আমার শ্মশান বাংলা ভালো নেই আজ তবু তাকে আমি ভালোবাসি। শুধু এটি গান নয়। এ তো ১৮ কোটি মানুষের কথা।

বিগত একদলীয় শাসনে মানবাধিকার লঙ্ঘন, বাক স্বাধীনতা খর্ব, অপশাসন, দুর্নীতি, দ্রব্য মূল্যের উর্ধ্বগতি, উচ্চ বেকারত্বে দীর্ঘদিনের পঞ্জীভূত ক্ষোভে সাধারণ মানুষের সর্বাত্মক অংশগ্রহণে ঘটে বাংলাদশের নব অভ্যুত্থান। ক্ষোভ প্রশমন অর্থনীতি পুনরুদ্ধার, বিদেশী ঋণের চাপ মোকাবিলা দ্রুত নির্বাচন চাইছে রাজনৈতিক দলগুলো- এহেন পরিস্থিতিতে শুধুই প্রয়োজন সকলে মিলে জাতিকে পুনর্গঠনে মনোনিবেশ করানো; আমরা জ্বালাতে চাই হাজারো আলোর মোমবাতি।

দেখুন, বন্যা নিয়ে আমাদের তরুণ অন্তর্বর্তী সরকারের ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্য প্রযুক্তি এবং তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম অভিশাপ বা প্রতিহিংসার কথা না বলে আলো জ্বালানো কথা শুনালেন; তিনি বলেন, ‘সতর্কতা না দিয়ে বাঁধ খুলে ভারত অমানবিকতার পরিচয় দিলেও আমরা ভারতের বন্যা কবলিত জনগণের প্রতি সমব্যথী। প্রয়োজন হলে বাংলাদেশ থেকে সিকিম ত্রিপুরায় ত্রাণ সহায়তা পাঠানো হবে।’ এটাই দেখাতে চাই- আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে।
সকলের প্রতি নিবেদন- অন্ধকার কে অভিশাপ না দিয়ে মোমবাতি জ্বালুন!

উন্নয়ন কর্মী ও কলাম লেখক

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published.

Back to top button