sliderশিরোনামশীর্ষ সংবাদ

স্বাধীন বাংলার পতাকার ইতিবৃত্ত

১৯৭০ সালের ৪-৬ জুন ঢাকার মতিঝিলের ইডেন হোটেলে আওয়ামী লীগের কাউন্সিল অধিবেশন, এ উপলক্ষে ছাত্রলীগের অভ্যন্তরে সিরাজুল আলম খানের দ্বারা পরিচালিত র‌্যাডিকাল গ্রুপটি একটি শোডাউনের পরিকল্পনা করে। এ পরিকল্পনার অংশ হিসেবে ৭ জুন পল্টনে র‌্যালি এবং ‘জয় বাংলা বাহিনী’ নামে একটা দল করে কুচকাওয়াজের মহড়া দেয়া। এর আগে এ গ্রুপটি সার্জেন্ট জহুরুল হকের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে ‘জহুর বাহিনী’ তৈরি করে যা পরবর্তীতে ‘জয় বাংলা বাহিনী’ নামে পরিচিতি লাভ করে। ৭ জুন কুচকাওয়াজের জন্য নির্ধারিত করা হয়- ছেলেদের জন্য সাদা শার্ট-প্যান্ট ও সাদা জুতা এবং মেয়েদের জন্য একই রঙের শাড়ি অথবা সেলোয়ার-কামিজ, মাথায় টুপি (টুপিটা ছিল অনেকটা নেতাজি সুভাষ বসু’র সামরিক পোশাকের সঙ্গে ব্যবহৃত টুপির মতো; রং ছিল উপরের দিকে গাঢ় সবুজ ও নীচে লাল রঙের একটা মোটা ফিতার মতো পট্টি এবং টুপির সামনে গোল করে বসানো হলুদ রঙের মাঝে ‘জয় বাংলা’ লেখা যা টুপির সঙ্গে সেফটিপিন দিয়ে আটকানো)। টুপিগুলো বানানো হয় নিউ মার্কেটের ১নং গেটের পশ্চিম দিকের এক দোকান থেকে, যার মালিক ছিলেন কে এম ওবায়দুর রহমানের ভাই হাবিবুর রহমান। কুচকাওয়াজের মহড়া হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন ইকবাল হলের মাঠে। ৬ জুন সন্ধ্যায় সিদ্ধান্ত হয় ‘জয় বাংলা বাহিনী’র একটা পতাকা তৈরির। পতাকা তৈরির কাজ সহ ৭ জুনের ‘জয় বাংলা বাহিনী’র কুচকাওয়াজের সমস্ত পরিকল্পনা সমন্বয় করছিলেন তৎকালীন ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি মনিরুল ইসলাম, যিনি মার্শাল মনি নামে পরিচিত ছিলেন (বর্তমান জাসদ নেত্রী শিরীন আখতারের স্বামী)। সভা বসল ইকবাল হলের আ স ম রবের জন্য বরাদদকৃত কক্ষে। সভায় ছিলেন- আ স ম রব, শাজাহান সিরাজ, কাজী আরেফ আহমেদ, মার্শাল মনি, শেখ শহিদুল ইসলাম, কামরুল আলম খান খসরু, হাসানুল হক ইনু, শরীফ নুরুল আম্বিয়া, চিশতি শাহ্ হেলালুর রহমান, মোয়াজ্জেম হোসেন খান মজলিশ, রফিকুল ইসলাম, গোলাম ফারুক প্রমুখ। কাজী আরেফ আহমেদের প্রস্তাব অনুযায়ী সিদ্ধান্ত হলো পতাকায় সবুজ জমিনের ওপর থাকবে একটি লাল বৃত্ত। পতাকার জন্য প্রয়োজনীয় গাঢ় সবুজ ও লাল রঙের কাপড় জোগাড় করতে মনিরুল ইসলাম (মার্শাল মনি, তৎকালীণ ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সহ-সভাপতি) দায়িত্ব দিলেন ‘লিটল কমরেড’ খ্যাত রফিকুল ইসলামকে (Rafiqul Islam)। রফিকুল ইসলাম জগন্নাথ কলেজের ছাত্র নজরুল ইসলামকে নিয়ে পুরান ঢাকার নবাবপুর চষে বেড়ালেন, কিন্তু কালচে রঙের সবুজ কাপড় পেলেন না কোথাও। তাঁরা নিউ মার্কেটে এলেন। ওইদিন নিউ মার্কেট সাপ্তাহিক ছুটির কারণে ছিল বন্ধ , তখন সন্ধ্যাও হয়ে গিয়েছিল। নিউ মার্কেটের এ্যাপোলো ফেব্রিক্সের মালিক রফিকের বন্ধু ইকবালের বাবা মালিক লস্করের বাসায় গিয়ে সবকিছু খুলে বলার পর তিনি দোকানের চাবি দিয়ে দিলেন। তাঁরা ইকবালকে নিয়ে নিউ মার্কেটের দোকানে এসে পছন্দের কাপড় পেলেন। তারপর কামরুল আলম খান খসরু সহ কাপড় নিয়ে গেলেন বলাকা বিল্ডিংয়ের ৩ তলায় ছাত্রলীগের অফিসের পাশের একটা দর্জির দোকানে, নাম- পাক ফ্যাশন টেইলার্স। ঐ দোকানের বিহারি দর্জি নাসির উল্লাহ, মোহাম্মদ হোসেন ও আবদুল খালেক পতাকাটি সেলাই করে দিলেন। তারপর তাঁরা এলেন ইকবাল হলের ১১৬নং কক্ষে, ওই রুমে থাকতেন তৎকালীন ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক শাজাহান সিরাজ। এখন প্রয়োজন সিরাজুল আলম খান কর্তৃক অনুমোদন। সিরাজুল আলম খান ইকবাল হলের ৩ তলার একটি কক্ষে প্রায়ই থাকতেন। সেখানেই তাঁকে সবকিছু বলার পর তিনি বললেন, যে নাম দিয়েই পতাকা প্রদর্শন করো না কেন, একে ভবিষ্যতের স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা হিসেবেই মনে করা হবে। এটা নিয়ে প্রতিপক্ষ অপপ্রচার চালাবে, পূর্ব বাংলার স্বাধীনতা আন্দোলনকে অনেকেই যুক্ত বাংলার কথা বলে ভারতের সাথে ট্যাগ করে দিবে। অনেক আলোচনার পর সিদ্ধান্ত হয়- লাল বৃত্তের মাঝখানে বাংলাদেশের একটি মানচিত্র এঁকে দেয়ার; সোনার বাংলার প্রতীক হিসেবে মানচিত্রের রং হবে সোনালী। তখনই প্রয়োজন পড়ে মানচিত্র আঁকার জন্য একজন ভাল শিল্পীর। সলিমুল্লাহ হল শাখা ছাত্রলীগের সম্মেলন উপলক্ষে ব্যানার-ফ্যাস্টুন আঁকার জন্য কুমিল্লা ছাত্রলীগের নেতা শিবনারায়ণ দাশ তখন সলিমুল্লাহ হলে অবস্থান করছিলেন । শিবনারায়ণ দাশকে নিয়ে আসা হলো। সমস্যা দেখা দিল, নির্ভূলভাবে মানচিত্র আঁকার। হাসানুল হক ইনু (তৎকালীন ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক ও স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী পরিষদের সদস্য) ছাত্রলীগের একজনকে সাথে নিয়ে গেলেন প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন জিন্নাহ হলের (বর্তমানে তিতুমীর হল) এনামুল হকের (ইনু ভাইয়ের কাজিন) ৪০৮ নং কক্ষে। তাঁর কাছ থেকে অ্যাটলাস নিয়ে ট্রেসিং পেপারে পূর্ব পাকিস্তানের মানচিত্র এঁকে আনলেন ইকবাল হলে। রং-তুলির জন্য কামরুল আলম খান খসরু গেলেন নিউ মার্কেটে কাঁচাবাজারের মধ্যে এক রঙের দোকানে, দোকানি ঘুমিয়ে ছিলেন। খসরু তাকে ডেকে তুলে রঙ নিয়ে আসলেন। সেই রং দিয়ে আঁকা হলো বাংলাদেশের মানচিত্র। পরদিন ৭ জুন, সকালে বৃষ্টি ছিল। পল্টনে ‘জয় বাংলা বাহিনী’র কুচকাওয়াজ; সবার সামনে ‘জয় বাংলা বাহিনী’র প্রধান আ স ম রব, তাঁর পেছনেই উপ-প্রধান কামরুল আলম খান খসরু। অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান। সামরিক কায়দায় বঙ্গবন্ধুকে সালাম জানানো হলো, তিনিও কপালের কাছে হাত তুলে জবাব দিলেন। রব একটা কাঠিতে প্যাঁচানো পতাকাটি বঙ্গবন্ধুর হাতে দিলেন, বঙ্গবন্ধু পতাকাটি খুলে দেখলেন এবং পাশে দাঁড়ানো একজনের হাতে তা দিলেন। এ গেল প্রথম পর্ব।
প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া ১৯৭১-এর ১ মার্চ বেলা একটায় রেডিওতে ঘোষণা দিয়ে জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত করলে ঢাকার রাজপথে সাধারণ মানুষ নেমে আসে, পাকিস্তানী পতাকা পোড়ায় বিভিন্ন জায়গায়। বঙ্গবন্ধু ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়ে অহিংস আন্দোলনের কর্মসূচী ঘোষণা করেন- ২ মার্চ ঢাকায় এবং পরদিন ৩ মার্চ সারাদেশে হরতাল। ঐদিন বিকেলে ছাত্রলীগের একক নেতৃত্বে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়। পরদিন ২ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা ভবনের বটতলায় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের পক্ষ থেকে ছাত্র জমায়েত অনুষ্ঠিত হয়। কলা ভবনের সামনে পশ্চিম দিকে গাড়িবারান্দার ছাদের ওপর ছাত্রলীগের প্রধান নেতারা সবাই দাঁড়ালেন। এ সময় মুহুর্মুহু শ্লোগান চলছে- ‘বীর বাঙালি অস্র ধরো, বাংলাদেশ স্বাধীন করো’, ‘তোমার আমার ঠিকানা, পদ্মা মেঘনা যমুনা’। এমন সময় জগন্নাথ কলেজ ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক শেখ জাহিদ হোসেনের নেতৃত্বে একটি মিছিল এলো একটি পতাকা সাথে করে নিয়ে। এটা সেরকম পতাকা যা ১৯৭০-এর ৬ জুন তৈরি করা হয়েছিল এবং ৭ জুন ‘জয় বাংলা বাহিনী’র কুচকাওয়াজে ব্যবহার করা হয়েছিল। ১ মার্চ রাতে এই পতাকাটি ইকবাল হলের ২১৫নং কক্ষে নতুন করে এই পতাকাটি আবার বানানো হয়। কক্ষটিতে থাকতেন ছাত্রলীগের নেতা চিশতি শাহ হেলালুর রহমান (২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর হামলায় শহীদ হন)। শেখ জাহিদ হোসেন বাঁশের খুঁটিতে পতাকাটি উঁচু করে ধরে আ স ম রবের হাতে দিলে তিনি বাঁশটা ধরে বেশ কয়েকবার ডানে-বাঁয়ে নাড়িয়ে বললেন- ‘এই পতাকাই আজ থেকে স্বাধীন বাংলা দেশের পতাকা’। তারপর এ পতাকাটা হাতে হাতে ঘুরল। আমাদের মুক্তিসংগ্রামের পতাকা হলো।
এই পতাকাটি আবার আনুষ্ঠানিকভাবে উত্তোলন করা হয় ১৯৭১ সালের ২৩ মার্চ। ১৯৭১ সালের ২৩ শে মার্চ ছিল পাকিস্তান রিপাবলিক দিবস। ঐদিন পল্টন ময়দানে পাকিস্তানী পতাকা পুড়িয়ে গানফায়ার করে আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করা হয় (কামরুল আলম খান খসরু গানফায়ার করেন ও হাসানুল হক ইনু পতাকা উত্তোলন করেন।) এবং জয় বাংলা বাহিনীর চারটি প্লাটুন কুচকাওয়াজ দ্বারা ঐ পতাকাকে অভিবাদন জানায়। কুচকাওয়াজে নেতৃত্ব দেন জয় বাংলা বাহিনীর কমান্ডার আ স ম আবদুর রব, সাথে ছিলেন ডেপুটি কমান্ডার কামরুল আলম খান খসরু ও হাসানুল হক ইনু। আ স ম রব সামরিক কায়দায় বঙ্গবন্ধুকে অভিবাদন জানান ও বঙ্গবন্ধুকে পতাকা প্রদান করেন। ঐ দিনই বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে ও গাড়িতে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করা হয়। উত্তোলনের পূর্বে বঙ্গবন্ধু নিজেই পতাকাটি বাসার সামনে উপস্থিত জনতার উদ্দেশ্যে কয়েকবার আন্দোলিত করেন। পরবর্তীতে মুক্তিযুদ্ধকালীন প্রবাসী সরকার এই পতাকাকেই বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা হিসেবে অনুমোদন করেন।
(Mukul Rahman’র টাইমলাইন থেকে নেয়া।)

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published.

Back to top button