sliderরাজনীতিশিরোনাম

যৌথ আলোচনা সভায় বক্তারা:সরকারকে কয়েকটি রাজনৈতিক দলের মন যুগিয়ে চলার নীতি বাদ দিতে হবে

পতাকা ডেস্ক: বাংলাদেশ রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলন, এবি পার্টি ও আপ বাংলাদেশ-এই তিন দলের যৌথ আয়োজনে রবিবার সকালে ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটি মিলনায়তনে ‘স্বল্প আস্থার সমাজে সংস্কার ও নির্বাচনী ঐক‍্যের রাজনৈতিক চ‍্যালেঞ্জ” শীর্ষক এক আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়। এতে বক্তারা বলেন, গণভোট ও সংবিধান আদেশ নিয়ে এখন যে বিতর্ক নতুন করে তৈরী হয়েছে তা খুবই দুর্ভাগ্যজনক। স্বল্প আস্থার সমাজে সংস্কার এবং নির্বাচনী জোট গণতান্ত্রিক ব‍্যবস্থা সমুন্নত করতে কতটুকু কাজ করবে তা প্রশ্ন সাপেক্ষ। বক্তারা আরও বলেন, সরকার শুরু থেকে জনগণ বা গণঅভ্যুত্থানের আকাঙ্ক্ষার কথা না ভেবে, কখনও বিএনপি, কখনও জামায়াত, কখনও এনসিপির চাপে সিদ্ধান্ত বদল করেছে, বর্তমান সংকটের এটাও একটা বড় কারণ। কয়েকটি রাজনৈতিক দলের মন যুগিয়ে চলার নীতি বাদ দেওয়ার জন‍্য সরকারের প্রতি সভা থেকে আহ্বান জানানো হয়।
বাংলাদেশ রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলনের সভাপতি এডভোকেট হাসনাত কাইয়ূমের সভাপতিত্বে আলোচনা সভায় প্রধান আলোচক ছিলেন বিশিষ্ট রাষ্ট্র চিন্তক ও অর্থনীতিবিদ সেয়াস ইউনিভার্সিটি অব লন্ডনের অধ্যাপক ড. মুশতাক হোসেন খান। বক্তব‍্য রাখেন এবি পার্টির চেয়ারম্যান মজিবুর রহমান মঞ্জু, আপ বাংলাদেশের আহ্বায়ক আলী আহসান জোনায়েদ, জেএসডি সাধারণ সম্পাদক শহিদ উদ্দিন মাহমুদ স্বপন, রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলনের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ হাসিব উদ্দিন হোসেন, এবি পার্টির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান মেজর (অব) অধ্যাপক আব্দুল ওহাব মিনার, আপ বাংলাদেশের সদস্যসচিব আরেফিন মো. হিজবুল্লাহ, এবি পার্টির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ব্যারিস্টার জোবায়ের আহমদ ভুঁইয়া, রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলনের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক দিদার ভুইয়া, আপ বাংলাদেশের প্রধান সংগঠক নাঈম আহমাদ। উপস্থিত ছিলেন এবি পার্টির ভাইস চেয়ারম্যান লে. কর্নেল (অব) হেলাল উদ্দিন, ভয়েস অব রিফর্মের সংগঠক ফাহিম মাসরুর প্রমূখ।
প্রধান আলোচক অধ্যাপক মুশতাক হোসেন বলেন, সমাজকে পরিবর্তন করতে যে জাতি জীবন দিতে পারে সেই জাতি অনেক শ্রদ্ধার। তিনি বলেন, নতুন বন্দোবস্ত চুক্তি করে হয় না, কারণ কায়েমি স্বার্থবাদীরা নতুন বন্দোবস্ত মেনে নেয় না। তবে নতুন রাষ্ট্র ব্যবস্থার জন্য লড়াই চালিয়ে যেতে হবে। ইংল্যান্ডের টরি পার্টির বিরুদ্ধে দুর্বল রাজনৈতিক দলগুলোর বিপ্লবের উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, সেখানেও সমঝোতা হয়নি, সংগ্রামের মধ্য দিয়েই জনগনের বিজয় অর্জিত হয়েছিল। বাংলাদেশে বিদ্যুৎ খাতে হাজার হাজার কোটি টাকা লুটপাটের অনুসন্ধান চলছে জানিয়ে তিনি বলেন, যারা ক্ষমতা কুক্ষিগত করতে চায় তারা উচ্চকক্ষ নিম্নকক্ষ সব জায়গা দখলের পদ্ধতি জানে। তিনি বলেন, আস্থার অভাবে ঝগড়া করে এদেশে রাজনৈতিক দলগুলো সবাই ক্ষতিগ্রস্ত হয় অথচ, আস্থাশীল হলে সবাই লাভবান হতে পারত। তিনি বলেন, এদেশের মানুষের সহজে ক্ষমা করে দেয়ার প্রবণতার কারণে আওয়ামী লীগ বেচে গেছে। তিনি বলেন, স্বার্থবাদী দলগুলো ‘ভাইভাই রাজনীতি’ করে বলেই স্বৈরাচার আর ফ্যাসিস্ট বারবার আসে। তিনি বলেন, অপরাধ করলে কোন না কোনভাবে শাস্তির ব্যবস্থা থাকতেই হবে। আস্থাহীনতা কমাতে হলে সামাজিক ব্যবস্থা জোরদার করতে হবে যেন অপরাধ করলে সামাজিকভাবে বয়কট করা হয়। অনিয়ম করলে তাকে সামাজিক, রাজনৈতিক এবং ধর্মীয়ভাবে শাস্তির মুখোমুখি করতে হবে। আস্থাহীনতার কারণেই অলিগার্করা রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করে। অধ্যাপক মুশতাক বলেন, গোটা দুনিয়ায় ভারত পরাস্ত শক্তি হলেও বাংলাদেশে সে প্রভাব বিস্তার করে কারণ আমাদের দেশে রাজনৈতিক দলগুলোর চরম আস্থাহীনতা আছে, এবং প্রভাবশালীদের অনেকের হাঁড়ির খবর ভারতের কাছে আছে। তাছাড়া নিজেদের সুবিধার জন্যই অনেকে ভারতপন্থী হচ্ছে। তিনি বলেন, সকল শ্রেণী পেশার মানুষের আস্থা অর্জন কঠিন হলেও নিজেদের মধ্যে কঠিন আস্থা বজায় রাখতে হবে এবং চোরদের সাথে কখনো আপোষ করা যাবে না। যারা আওয়ামী লীগের সহযোগী ছিল তাদের কোন না কোনভাবে বিচার বা ক্ষমা চাওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। ঐক্যমত্য বা নতুন সংবিধান এখনি নাহলেও লড়াই চালিয়ে গেলে জনতা পাশে থাকবে বলে তিনি আশাবাদ জানান। রাজনৈতিক শক্তি, প্রতিবেশী দেশ এবং অর্থনৈতিক স্বার্থবাদীরা কখনো ক্ষমতা এবং প্রভাব ছাড়তে চাইবে না, তাদের বাধ্য করতে হবে।
সভাপতির বক্তব্যে হাসনাত কাইউম বলেন, অনেক মতদ্বৈততা থাকলেও দেশের প্রশ্নে এক হয়ে নতুন রাজনীতির জন্য কাজ করতে হবে। সব রাজনৈতিক দলেই জালিম-মজলুম আছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, এখনি রাষ্ট্র সংস্কারের কাজ শুরু করতে হবে। তিনি বলেন, হাসিনা-ওবায়দুল কাদেররা সাংবিধানিক পদ্ধতি এমনভাবে সাজিয়েছে তার মধ্যেই ফ্যাসিস্ট হওয়ার উপাদান নিহিত আছে। তিনি বলেন, অতীতে জনগণের দাবি প্রতিষ্ঠা করতে পারার কারণে সফলতা এসেছে। এবার আন্দোলনের নেতৃত্বকে কিছু বুড়ো মানুষ ভুল পথে পরিচালিত করেছে, এবং টাকাওয়ালাদের কাছে নিয়ে গেছে, ফলে রাষ্ট্রের সংস্কার আজ অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। তিনি বলেন, পুরোনো পথে নতুন বন্দোবস্ত বাস্তবায়ন হবে না। তিনটি দলের এই আয়োজন দল ও ব্যক্তি স্বার্থের জন্য নয় বলেও জানান তিনি।

মজিবুর রহমান মঞ্জু বলেন, ‘বিএনপি নেতা সালাহউদ্দিন আহমেদ কথায় কথায় সংবিধানের রেফারেন্স দেন, এটা ভালো। তবে তার কাছে প্রশ্ন ফ‍্যসিস্ট হাসিনা সংবিধানের কোন আর্টিকেলের আলোকে আপনাকে গুম করে বিনা ভাড়ায় বিনা টিকিটে শিলংয়ে নিয়ে গিয়েছিল? আমাদের জানতে ইচ্ছে করে।
তিনি বলেন, তথাকথিত দায়িত্ব নেয়ার কালচার আমাদের রাজনীতি কলুষিত করেছে। এবি পার্টি শক্তিশালী হলে তার লোকেরা পাবলিক টয়লেট ইজারা নেবে না এমন গ্যারান্টি নাই মন্তব্য করে মঞ্জু বলেন, এই সংস্কৃতি বদলানোর জন্যই নতুন রাজনীতি দরকার। নতুন রাজনীতি দাঁড়াতে না পারার কারণ খোঁজার আহবান জানান তিনি। অধ্যাপক ইউনুসের সরকার তিন দলের চাপে পড়ে বারবার সিদ্ধান্ত বদল করে বলে অভিযোগ করে তিনি বলেন, জনগণের জন্য যা ভালো সেটা করতে হবে কোন দলের স্বার্থ হাসিল নয়। জনগণের কথা না শোনায় উপদেষ্টাদের সমালোচনা করে তিনি বলেন, ‘আপনাদের কিছুদিন পর জনগণের কাতারে আসতে হবে।’
সরকারের উদ্দ্যেশ্যে তিনি বলেন, এক-দুইটা রাজনৈতিক দলের মন যুগিয়ে চললে জুলাই শহীদ এবং আহতদের কাছে আজীবন ভিলেন হিসেবে অভিশাপ পেতে হবে।

আলি আহসান জুনায়েদ বলেন, হাসিনার হাতে ভেঙ্গে পড়া রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে কাজে লাগিয়ে রাজনৈতিক শক্তিগুলি ক্ষমতা ভোগের উৎসবে মেতেছে। ভোট কেন্দ্র দখলে অভ্যস্ত এবং বিপ্লব বিরোধীরা ক্ষমতায় আসলে জনগন আবারো হতাশ হবে বলে আশংকা প্রকাশ করেন তিনি। জনগণকে অন্ধকারে রেখে চেয়ার নিয়ে কাড়াকাড়ি চলছে বলে মন্তব্য করেন তিনি। জনগনের রাষ্ট্র গঠন করতে রাজনৈতিক দলগুলোর রাজনীতি করা উচিৎ বলে মত দেন তিনি। গণভোটে দুইটা ব্যালট রাখার প্রস্তাব আবারো তুলে ধরেন তিনি। সংস্কার প্রশ্নে জনগণকে সাথে নিয়ে লড়াই চালিয়ে যাবার ঘোষণা দেন তিনি।
শহিদ উদ্দিন স্বপন বলেন, আইনের শাসন না থাকা এবং বৈষম্যের অর্থনৈতিক ব্যবস্থার কারণে বাংলাদেশে সব শ্রেণির মানুষের মধ্যে আস্থাহীনতা। জুলাই অভ্যুত্থানের পর সমাজ বিপ্লবের সম্ভাবনা তৈরি হলেও রাজনৈতিক নেতাদের পুরোনো চিন্তাচেতনার কারণে মানুষ আশাহত হয়েছে। যেটুকু অগ্রগতি গত ১৫ মাসে হয়েছে তাকে ভিত্তি ধরে লড়াই চালিয়ে যাওয়ার আহবান জানান তিনি। যারা জীবন দিয়ে ফ্যাসিবাদ হটিয়েছে তাদের সব জায়গা থেকে বাদ দিয়ে রাজনৈতিক দলকে সবকিছুর নিয়ন্ত্রক বানানোয় তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করেন তিনি।
সৈয়দ হাসিব উদ্দিন বলেন, এই মুহুর্তে চরম দুর্বল অবস্থায় আছে বাংলাদেশ, এটি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে। এই অবস্থার মোকাবেলায় নির্বাচন জরুরি। রাজনৈতিক দলগুলোকে গরম বক্তব্য না দিয়ে জনগনকে সাথে নিয়ে সংস্কার চালিয়ে যেতে হবে। ছাড় না দিয়ে নিজেদের মত চাপিয়ে দিলে সেটা স্বৈরাচারকে তরান্বিত করবে। রাষ্ট্র দুর্বল হলে সবার জন্য বিপদ আসবে তাই ছাড় দেয়ার মানসিকতা নিয়ে রাজনীতি করার আহবান জানান তিনি।
অধ্যাপক আব্দুল ওহাব মিনার বলেন, আমাদের দেশের সর্বস্তরে আস্থার প্রচণ্ড সংকট, এটি দূর করতে হলে রাজনৈতিক দলগুলোকে জনগণের কাছে পরীক্ষা দিতে হবে। তিনি বলেন, আমরা জীবিত থাকতে আওয়ামী লীগ এদেশে রাজনীতি করবে সেটি হতে পারে না। অহমিকা ছেড়ে সব দলকে ঐক্যের পথে আসার আহবান জানিয়ে তিনি বলেন, ডায়নোসর অনেক বড় ছিল কিন্তু আজ বিলুপ্ত হয়ে গেছে। আরেফিন মো. হিজবুল্লাহ বলেন, ফ্যাসিবাদকে নির্মূল করতে শেখ মুজিবের ছবি টানানো অবশ্যই বন্ধ করতে হবে। রাজনৈতিক দলগুলোর কাঠামোগত ফ্যাসিবাদ সংকটকে তরান্বিত করছে। যেসব জায়গায় ফ্যাসিবাদ তৈরি হওয়ার আশংকা আছে সেগুলো বন্ধ করতে হবে। তিনি বলেন, গুরুত্বপূর্ণ সব সংস্কার ইস্যুতে বিএনপি আপত্তি জানিয়েছে। বিএনপি ছাড়া অন্যদের ক্ষমতায় যাওয়ার প্রস্তুতি ও আত্মবিশ্বাস নাই। রাজনৈতিক ঐক্যের সম্ভাবনা নষ্ট হওয়ার কারণ রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে আস্থার অভাব। লাউকদু নিয়ে বিতর্ক না করে নতুন তরকারি রান্নার ওপর জোর দেন তিনি। দিদার ভুইয়া বলেন, ছেড়া ‘স্যান্ডেল থেকে ফাইভস্টার হোটেল কোন বিপ্লবীর চরিত্র হতে পারে না।’ রাজনৈতিক দলগুলোর নিজেদের মধ্যে আস্থাহীনতা বর্তমান সংকটের অন্যতম কারণ। উচ্চকক্ষে পিআর না মেনে বিএনপি নিজেদের ক্ষতি করছে। এমনকি নির্বাচনকে কেন্দ্র করে ব্যাপক প্রাণহানির আশংকা তৈরি হচ্ছে। ব্যারিস্টার জোবায়ের বলেন, প্রশাসনে নিজস্ব লোক সেট করতে ব্যস্ত তিন দল অথচ টেকসই রাষ্ট্র ব্যবস্থার জন্য রাজনৈতিক ইকো সিস্টেম জরুরি।
সভায় তিন দলের ঐক্যবদ্ধ পথ চলার অঙ্গীকার ব্যক্ত করা হয়।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button