sliderমতামতশিরোনাম

বৈশ্বিক সংকট ও উৎসবের অর্থনীতি

মো.নজরুল ইসলাম : কবি গুরুর অমর পদ দিয়েই বলতে হয়- “মানুষেরা উৎসব করে। মানুষ যেদিন আপনার মনুষ্যত্বের শক্তি বিশেষভবে উপলব্ধী করে, সেইদিন।…. প্রতিদিন মানুষ ক্ষুদ্র দীন একাকী কিন্তু উৎসবের দিনে মানুষ বৃহৎ, সেদিন সে সমস্ত মানুষের সঙ্গে একত্র হইয়া বৃহৎ, সেদিন সে সমস্ত মনুষ্যত্বের শক্তি অনুভব করিয়া মহৎ“।

আমরা কেবল ইদ নয় উৎসবের ভূমিকায় বলতে পারি ঋতুর বর্নময় আত্মপ্রকাশের রঙ্গমঞ্চে বাঙালির মানসিক,সামাজিক,অর্থনৈতিক,ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক জীবনে বছরান্তে নানা উৎসব আসলেও প্রধান দুটি ইদ উৎসব অন্যতম। ইদের উৎসব পালনের সাথে নিবিরভাবে মিশে আছে ধর্মীয় চেতনা ও অর্থনীতির ফটকা কারবার ও বানিজ্য। বাংলাদেশের উৎসবগুলোকে কয়েকটি শ্রেণীতে ভাগ করা যায়। যেমন-ধর্মীয় উৎসব, সামাজিক উৎসব, সাংস্কৃতিক উৎসব, জাতীয় উৎসব, মণীষী স্মরণোৎসব ইত্যাদি। যে কোন উৎসব মিলন, শান্তি ও মৈত্রির ত্রিবেণী বন্ধন। আর সে উৎসবের সুরছন্দ, বর্ণগন্ধ শহরে যতখানি না পাওয়া যায় তার চেয়ে অধিক মিলে গ্রামে। নানারকম উৎসবের মধ্যে ধর্মীয় উৎসব বিশেষত ইদুল ফিতর ও উদুল আযহা মোদ্দাকথা ইদের উৎসবের বাতাবহ, অর্থনৈতিক সামাজিক সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক অঙ্গনে ব্যাপক প্রভাব ও দাপটের সহিত মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে সুশোভিত হয়ে টিকে আছে।

ইদুল আাযহা তথা বকরা ইদের কোরবানির কেন্দ্রীকতা নিয়ে রয়েছে অদৃশ্য নেকী পাওয়ার লোভ ও দৃশ্যমান প্রান্তিক মানুষের কঠোর খাটুনিতে গ্রামীণ অর্থনীতির সচলতায় জাতীয়য় আয়ের প্রবৃদ্ধিতে প্রবেশাধিকার। একজন কৃষক কৃষাণী সারাবছর কষ্ট করে একটি ষাড় লালন পালন করেন কোরবানী ইদের বাজারে উচ্চমূল্য পাওয়ার আশায়। যিনি কোরবানী প্রদান করবেন তিনিও সারা বছর সঞ্চয় করেন ইহলোকিক ও পরলোকিক শান্তির উদ্দেশ্যে তথা প্রচুর নেকির আশায় সুন্দর একটি পশু কোরবানির মধ্যে দিয়ে। ধমীয় এই উৎসব বা বিধানের বলে ধনীর সম্পদ কিছুটা হলেও প্রবাহমান হয় এবং প্রান্তিক শ্রেণীর মানুষ কিঞ্চিত অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্ভী বা প্রসারিত হয়। তাই বকরা ইদে ধনীর নেকী ও প্রান্তিক মানুষের কিঞ্চিত সঞ্চয় এবং গরিবের সামান্য মাংস খাওয়ার মধ্যে দিয়েই উৎসব শেষ হয়না।

অন্যদিকে যেনতেনো মানুষ কোরবানি দিতে পারেনা ধর্মীয় বিধান মতে মসজিদের ইমাম মুয়াজ্জিন বা মাদ্রাসার ছাত্র শিক্ষকরাই এই পুণ্যের কাজটি করতে পারবেন। আমরা গণমাধ্যমের বরাত দিয়ে জানতে পারি, পশু জবেহ/কোরবানি দিতে গিয়ে প্রতি বছর শতাধিক মানুষ আহত ও নিহত হন। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকজন ইমাম বলেন,কাজটি অত্যন্ত কঠিন,সেচ্ছায় নিজের জীবন কেউ দিতে চায়না,আমারা আল্লাহর নাম নিয়ে জোর করেই জবেহ করি। আমাদেরও কষ্ট লাগে রাতে বাজে স্বপ্ন দেখায় এই কাজ থেকে আমি অব্যহতি নিয়েছি। মাদ্রাসার যুবক ছাত্রদের দিয়ে করালে ভালো হয়। এদিকে চামড়ার দাম একেবারে পড়ে যাওয়ায় মাদ্রাসার যুবক ছাত্র শিক্ষকদের এই কাজে আগ্রহ কামে গেলেও ভিন্ন লাভের চুক্তিতে তারা এগিয়ে আসছে। তবুও বাকীর লোভ জমা রেখে ইহলৌকিক অর্থনীতির চাকা গতিশীল হচ্ছে।

এছারাও মুসলিমরা তাদের প্রিয় নবী হযরত মোহাম্মদ (স:) এর জন্ম ও মৃত্যু দিনকে ইদে মিলাদুন্নবী বলে থাকেন এবং উৎসবের সহিত এই দিনও পালন করেন। আবার মহররম মাসের দশ তারিখে কারবলার ময়দানে নবীর বংশ ধ্বংসের দিনকে বলা হয় বিষাদের দিন। তাই বিষাদময় ভাবগম্ভির্য্য নিয়ে দশই মহররম পালন করা হয়। উল্লেখ্য যে নবী করিম (স:) এর দৌহিত্র ইমাম হাসানকে বিষপান ও ইমাম হোসেন কে কারবলার প্রান্তরে ওহাবিয়া মতবাদের প্রবক্তা ইসলামের আরেক খাদেম হযরত ইয়াজিদের সৈন্যদের হাতে নির্মমভাবে সপরিবারে নিহত হন এবং ইয়াজিদ তারপর থেকেই আওলঅদে রাসুলের বিপরীত আদর্শ তথা ইয়াজিদের ইসলাম প্রচার ও প্রসার করেন এবং বর্তমানে তার ভাবধারার ইসলামই অধিক শক্তিশালী। ইয়াজিদ অনুসারী ও আহলে সুন্নাত তথা আওলাদে রাসুলের অনুষারীদের দ্ব›দ্ব সংঘাত এখনো বিদ্যমান। রাসুলের আশেকানরা সেই বিষাদময় স্মৃতি উদযাপনকেই মহররম বলে অবিহিত করেন। সাধারনত ধর্মীয় উৎসবগুলো এক একটি ধর্মীয় বিশ^াস ও ভাবনাকে কেন্দ্র করে অনুষ্ঠিত হয়। বাংলাদেশের ধমীয় উৎসবগুলোর মধ্যে মুসলমানদের ইদুলফিতর,ইদুলআযহা,ইদ-ই মিলাদুন্নবী,মহররম এগুলোই প্রধানভাবে উল্লেখযোগ্য। উৎসবকে কেন্দ্র করে সড়কে প্রতি বছর শত মানুষের অকাল জীবনহানি ও পঙ্গুত্ব হলেও এই সকল উৎসব পৃথিবীর অনেক দেশে দেশে ধর্মীয় মর্যাদা নিয়ে পালিত হয় এবং বাংলাদেশের সংস্কৃতির সাথে ধর্মীয় প্রথাগুলো মিশে যাওয়ায় আমরা নারীর টানে ঘরে ফিরে ভিন্নমাত্রায় ইদ উৎসব পালন করে থাকি। হিন্দু সম্প্রদায়ের ধর্মীয় উৎসবগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো দূর্গাপূজা,স্বরস্বতী পূজা,লক্ষ¥ীপুজা,কালীপুজা,শ্রীকৃষ্ণের জন্মাষ্ঠমী ও শিবরাত্রি ইত্যাদি। এদের মধ্যে দূর্গাপূজাই প্রধান।

মহান মুক্তিযুদ্ধের চার মূলনীতির অন্যতম ধর্মনিরপেক্ষ সমাজ ব্যাবস্থার আলেকে বাঙালীরা মুসলিম ও হিন্দুদের বেশিরভাগ উৎসব একসাথেই পালন করেন। মুসলিমদের ইদ,বাঙালির পহেলা বৈশাখ ও হিন্দুদের দূর্গাপূজা তাদের গন্ডি ছারিয়ে এটি বাঙ্গালীর সকল ধর্মালম্ভীদের জন্য জাতীয় উৎসবে পরিনত হয়। বিজয়া দশমীর বিদায়ের দিনসহ বোধন থেকে বিসর্জন এক অনন্যরুপে বাঙালি হিন্দুদের জীবনকে আন্দেলিত করে। তবুও এ বিদায় চিরন্তন নয়। বাঙালি হিন্দুরা দেবীকে বিদায় জানাতে গিয়ে বলেন, আবার এসো মা ফিরে।’ অন্যন্য ধর্মীয় উৎসবের মধ্যে খ্রিষ্টানদের বড় দিন,বৌদ্মদের বৌদ্ম পুর্ণিমা ইত্যাদি প্রধান।

সমাজিক উৎসব: বাঙালি সমাজের মানুষগুলো অন্যরকম তারা সবসময় উৎসব আমেজে সবাইকে মাতিয়ে রাখতে চায়। এগুলোর মধ্যে বাংলানববর্ষ,হালখাতা,পুণ্যাহ,বিবাহ,ভাইফোটা,খাৎনা। আবার জন্মদিন, নবান্ন, শ্রাদ্ধ, অন্নপ্রাশন,পৌষপার্বণ,জামাইষষ্টি ইত্যাদি প্রধান। বাংলা নববর্ষ বাঙালির অন্যতম প্রধান সামাজিক উৎসব।প্রকৃতির পট পরিবর্তন মানুষের জীবনেরও পট পরিবর্তন করে। নববর্ষ হালখাতা বর্ষবরন গ্রামীণ অর্থনীতির চাকা ঘুরাতে সহযোগীতা করে এবং নতুন বানিজ্যের শুভ সূচনা পয়লা বৈশাখেই সূচিত হয়। বলা বহুল্য যে নববর্ষ যেমন বছরের সূচনা তেমনি চৈত্র সংক্রান্তির গাজন ঘিরে গ্রামবাংলার প্রত্যন্ত অঞ্চল উৎসব মুখর হয়ে পড়ে। গ্রামের পথে ঘাটে,নদীর ধারে মেলা বসে। আবাল বৃদ্ধ সকলের কাছে এটি এক ভিন্নরকম আনন্দ। গ্রামবাংলার একটি অন্যরকম সামাজিক উৎসব নবান্ন। নানারকম পিঠে পায়েস এ উৎসবের অঙ্গ। বাঙালিরা তাদের সমগ্র পরিমন্ডলকে ছাপিয়ে জাতি ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে সবাইকে নিয়ে প্রানবন্ত করে রাখে এ উৎসবমুখর দিনগুলোতে।

জাতীয় উৎসব: আমরা উৎসবকে কেবল লোকাচারের মধ্যেই সিমাবদ্ধ করে থাকি,এটি মোটেও ঠিক নয়। উৎসব মানবইতিহাসের দীর্ঘদিনের সংগ্রামমুখর অধ্যয়। কর্মক্লান্ত জীবনের নিরানন্দ মরুভূমিতে আনন্দের জোয়ার এনে তাকে করে আরো রসসিক্ত। আমাদের এমন কিছু উৎসব রয়েছে যা কোন ধর্মকেন্দ্রীক সম্প্রদায়ের জন্য সীমিত নয়; সকল জাতি বর্ণ ও ধর্মীয় শ্রেণীর মানুষের পালনীয় উৎসব।এ সার্বজনিন উৎসবগুলো আমাদের কাছে জাতীয় উৎসব হিসেবে ব্যাপক পরিচিত। যেমন- মহান একুশে ফেব্রæয়ারী বা শহিদ দিবস,স্বাধীনতা দিবস,বিজয় দিবস ইত্যাদি।উল্লিখিত উৎসবগুলো যেমন রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় পালন করা হয়,তেমনি আমরা সামাজিকভাবেও পালন করে থাকি।একুশে ফেব্রƒযারী আমাদের সকলের কাছে শোকের প্রতিক।মাতৃভাষা বাংলাকে রক্ষা করতে গিয়ে ভাষা আন্দোলনের সূচনা হয় এবং আন্দোলন করে গিয়ে ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রæয়ারীতে যারা শহিদ হয়েছিলেন,তাদের স্মৃতিকে স্মরণ করা এবং শ্রদ্ধা জানানোর জন্য আমরা এইদিনকে উৎসবের মধ্যে দিয়ে পালন করে থাকি। এইদিনকে কেন্দ্র করে বইমেলা,খেলাধুলা,সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানসহ নানা আলোচনা অনুষ্ঠান হয়ে থাকে। ২৬ মার্চ স্বাধীনতা দিবস ও ১৬ ডিসেম্বর মহান বিজয় দিবস প্রায় একই কায়দায় অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে।

সাংস্কৃতিক উৎসব: আমাদের হাজার বছরের অনেক প্রাচীন সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য রয়েছে- আধুনিককালে তার পরিসর ও কলেবর আরো কয়েকগুন বৃদ্ব্যি পেয়েছে। যেমন-সামাজিক যাত্রাপালা,নাটক,বাযোস্কপ। এছারাও গ্রামীণ খেলাধুলা,র্সাকাস,মেলা,বর্ষবরণ,সংগীতানুষ্ঠান,বইমেলা, রবীন্দ্র-নজরুল-সুকান্ত জয়ন্ত্রী, দিবস ও তেহার কেন্দ্রীক আলোচনা অনুষ্ঠান,পীর মুরশীদ ও অলী আউলিয়াদের দরবার কেন্দ্রীক গান বাজনা, যাত্রা, নাটক ইত্যাদি বাংলাদেশের উল্লেখযোগ্য সাংস্কৃতিক উৎসব। প্রতিবছর জাতীয় ও স্থানীয়ভাবে একুশে বইমেলা বাঙালীর জন্য এক বড় উৎসবে পরিনত করে। এই ধরনের উৎসব গুলোতে পত্রিকাগুলো বিশেষ সংখ্যা প্রকাশ করেন। রেডিও টেলিভিষনেও অবিরাম ভিন্নমাত্রায় অনুষ্ঠান চলতে থাকে। বিভিন্ন দিবস ও দিবস ছারাও গ্রামে গঞ্জে যাত্রাপালা এখনো জনপ্রিয়তার শীর্ষে। একুশের বইমেলা ও অন্যান্য উৎসবগুলো যথেস্ট সমৃদ্ধির দিকে নিয়ে যাচ্ছে আমাদের সাংস্কৃতিক জীবনকে। তাই যুগ যুগ ধরে এসব উতসব পালিত হচ্ছে এবং হবেই; এগুলোর আবেদন ও প্রয়োজনীয়তা বলে ও লিখে শেষ করা যাবে না।

উৎসবের নানামুখীন বৈশিষ্ট: বাংলাদেশের উৎসব বাঙালির দীর্ঘদিনের সংগ্রামশীল কর্মক্লান্ত জীবনের নিদারুন মরুভূমিতে নির্মল আনন্দের উৎস। উৎসব তাই সমাজের শারিরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের নিপুণ করিগর। তাই প্রতিটি সমাজকে তার পরিবেশ এবং স্বভাবের সঙ্গে খাপ খাইয়ে রচনা করে দিতে হয় নিজস্ব উৎসবের ধারায়। উৎসব সমাজকে ভিন্ন ধারায় অভিষিক্ত করে সংস্কৃরি ধারামুখ উদয় মুক্ত করে। উৎসবকে কেন্দ্র করে দেশে দেশে রচিত হয়েছে কত সংগীত কত নৃত্য,অঙ্কিত হয়েছে কত পট ও চিত্রসম্ভার। উৎসব সকল কালের সকল মানুষের নব সৃষ্টির প্রেরণার জন্মভূমি।

বাংলাদেশের উৎসবগুলোতে বহুমাত্রিকতা রয়েছে। বিভিন্ন সম্প্রদায়ের উৎসবের মধ্যে মিলন ও ঐক্যতত্তে¡র বহি:প্রকাশ লক্ষ করা যায়। মুসলমানদের মহররম অনুষ্ঠানে হিন্দুদের অংশগ্রহন কিংবা হিন্দু সম্প্রদায়ের পূজা পার্বণে মুসলমানদের অংশগ্রহন প্রত্যক্ষ করা যায়। আবার বাংলা নববর্ষ উৎসবে বাংলাদেশের সকল ধর্মালম্ভী লোকেরাই একসঙ্গে অংশগ্রহন করে থাকে। মহান মুক্তিযুদ্ধের তথা স্বাধীকার আন্দোলনের একতা এটাই প্রমান করে বাংলাদেশ অসাম্প্রদায়িক চেতনার উর্বর ভূমি। এখানে ৯০% এর তকমা দিয়ে বাঙালিকে কখনোই বিপথগামী করা যাবে না। ধর্মীয় বিশ^াস ও অনুভূতির সুযোগ নিয়ে বীপরিত আদর্শ তথা অন্ধকার পথে নেয়ার কোন সুযোগ নেই। সুতরাং আমরা বলতে পারি এদেশের সার্বজনিন সকল উৎসবগুলো নানা জাতি ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে সকল সম্প্রদায়ের লোকের মধ্যে দেখা সাক্ষাত,আলাপ আলোচনার মাধ্যমে নিবির ঐক্যের বন্ধন সৃষ্টি করে। কাজেই উৎসরের গুরুত্ব ও তৎপর্য্য সিমাহীন। অন্যভাবে বলতে গেলে মানুষের বেদনাবিধুর জীবনে উৎসব নতুন প্রাণ ও আনন্দ সঞ্চার করে। তবে উৎসব মানেই কেবল উল্লাস নয়, আনন্দ মানে নয় যথেচ্ছাচার। আদিম অরণ্যকে জীবনের বর্বর উল্লাস বর্তামন সমাজে অচল। আমাদের উৎসব যে মহৎ ভাবরাশি একদিন ছিল, যে মূল্যবোধ আমাদের চলতে,চালাতে সাহায্য করছে,তা আবার জীবনে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। এ বিষয়ে আমরা সকলে সচেতন হলেই গড়ে ওঠবে এক জাতি,এক প্রাণ ও একতাবদ্ধ বহুত্ববাদি মানবতার সমাজ।

করোনাকালীন সংকট উত্তোর ইউক্রেণ-রাশিয়া যুদ্ধ ও মানব¯্রােত: ২০১৯ সালের শেষের দিকে চিনের উহান প্রদেশ থেকে মর্তবাসীর জন্য সংকটের এক নতুন নাম শোনা যায় কোডিড-১৯ বা করোনাভাইরাস। ২০২০ সালের মধ্যে চিনের গন্ডি ছারিয়ে সারা দুনিয়াতে ছরিয়ে পড়ে এই মরনঘাতি ভাইরাস। সারা দুনিয়ার মতো তৃতীয় বিশ্বের উন্নয়নশীল দেশ বাংলাদেশেও অদৃশ্য এই ভাইরাসের সাথে আমরন যুদ্ধ করছে। প্রায় দুই বছর করোনার সাথে প্রত্যেক্ষ-পরোক্ষ যুদ্ধ করে অনেক প্রিয়জনকে হারিয়ে কোনমতে টিকে থাকলেও বৈশি^ক পূজিবাদী শীতল যুদ্ধে আমেরিকা গং ইউক্রেণ-রাশিয়া যুদ্ধ দামামায় আমরা স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে পারছিনা।

যুদ্ধ-বিগ্রহ,বণ্যা-খড়াসহ মনুষ্য ও প্রাকৃতিক দুর্যোগে প্রতিদিন মানুষ আক্রান্ত ও মানুষের মৃত্যু আমাদেরকে শুধু আহতই করেনা সার্বিকভাবে মর্মাহত ও ক্ষতিগ্রস্থ করছে। বৈশি^ক প্রেক্ষাপটে আমাদের অর্থনীতি বেশ নাজুক অবস্থায় আছে। দ্রব্যমূল্যসহ সেবা-পরিসেবা সাধারন মানুষের নাগালের বাইরে। জাতি রাষ্ট্রের জন্মের ইতিহাসে ভয়ংকর মূল্যস্ফ্রীতি সবাইকে ভাবিয়ে তুলছে। অন্যদিকে গণতন্ত্রকে কেন্দ্র করে রাজনৈতিক সংকট পারিবারিক সামাজিক রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক পরিমন্ডলকে চরমভাবে পুঞ্জিভূত করে রেখেছে। আমরা জানি ব্যক্তির দৈনন্দিন অর্থনৈতিক আয় উন্নতিই বছর শেষে দেশের প্রবৃদ্বিতে যোগ হয়। মাথাপিছু আয়ের অন্যতম মাপকাঠি হলো ব্যক্তি ও পারিবারিক উন্নয়ন। বৈশি^ক মহামারি করোনাভাইরাস এই উন্নয়নের গতিকে থমকে দিয়েছে। মহামারী করোনাভাইরাসের মধ্যেও কৃষিভিত্তিক গ্রামীণ সমাজ,প্রান্তিক মানুষ,গার্মেন্টস কর্মী ও প্রবাসীদের নিরলস পরিশ্রমে মন্থর গতিতে অর্থনীতির চাকা চলতেছিলো। কিন্তু বর্তমান আমাদের দেশে রোহিঙ্গা সংকটের ঘনিভূত রুপ নিয়ে যুদ্ধ দামামায় ডলার সংকটসহ বানিজ্য ঘাটতি নিয়ে আরো কিছুদিন নিদারুন কষ্ট পোহাতে হবে বলে মনে হচ্ছে।

অতিমারির সংকটে তথা রোগে শোকে মানুষের মৃত্যু ও অর্থনৈতিক সংকটে মানুষর মৃত্যু হোক তার কোনটিই কাম্য নয়। মৃত্যু উপতাক্য হোক আমার এই জন্মভূমি এটি আমরা কোনভাবেই চাই না। বিভিন্ন উৎসব তেহারেসহ বর্তমান বকরা ইদেও ভূরাজনীতির প্রতিকুলতা উপক্ষো করে ঘরমুখো মানুষ উৎসব করছে। প্রতিকুলতা ডিঙ্গিয়ে প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির ঢেঁকুর তুলে ঘরে ফিরে মানুষগুলো যেন এভারেষ্ট বিজয় করে এসেছে।
মানবজাতির কোনকালেই সংকট মোকাবিলায় ধর্ম কোন সহায়ক উপাদান ছিলো না বরং বিভেদ ও ফেৎনা সৃষ্টি করে অর্থনীতির গতিশীলতাকে বাহত করেছে। তারপরও আমরা বলতে চাই ভাববাদ দ্বারা প্রভাবিত হাজার বছরের চর্চিত বিশ^াস ভেঙ্গে এই মানুষগুলো এবং রাষ্ট্র নিজেও বস্তুবাদি চিন্তা তথা বিজ্ঞানমনস্ক চর্চায় শতভাগ প্রবেশাধিকার করতে পারবে না। পূজিবাদী দুনিয়াতে বিশেষত ধর্মীয় উতসবগুলোকে কেন্দ্র করে মানব¯্রােতের আনাগোনায় ফটকা কারবারে অর্থনৈতিক প্রবাহ কয়েকগুন বৃদ্ব্যি পেয়েছে। এই মানব প্রবাহকে সঠিক ধারায় ঘুরিয়ে দিতে রাষ্টুকেই দায়িত্ব নিতে হবে এবং সচেতন মহলকে আরো দায়িত্বশীল হয়ে কাজ করতে হবে। রাষ্ট্রের পাশাপাশি বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে মানবতার সেবায় বিভিন্ন সেবামুলক প্রণোদনা নিয়ে এগিয়ে আসতে হবে। সরকারকে কোমল ও কঠোর দুই আচরনই করতে হবে। প্রথমেই বলপ্রয়োগ নয়,শুরু করতে হবে রাষ্টীয় কাঠামোর বুনিয়াদ শিশুর শৈশবকাল থেকে। যেমন-সার্বজনিন গণমুখী একই ধারার বিজ্ঞানভিত্তিক শিক্ষা ব্যাবস্থা চালু করার মাধ্যমে রাষ্ট্রের সকল স্তর ও কাঠামোতে শিক্ষা সংস্কৃতি ও বৈচিত্র্যের মতাদর্শিক লড়াই জোরদার করা সম্ভব। শুধু কাগজে কলমে সংবিধান নয় মুক্তিযুদ্ধের চার মুলনীতি তথা অসাম্প্রদায়িক চেতনার আলোকে শক্ত হাতে ধর্মান্ধদের মোকাবেলা করতে হবে এবং সাংস্কৃতিক জাগরন ও বিকাশ ঘটাতে পারলেই আমরা স্বনির্ভরতার মাধ্যমে সম্মৃদ্ধ অর্থনীতিসহ নারীবান্ধব বহুত্ববাদি সামাজিক ন্যায্যতার সমাজ বির্নিমানের পথ পারি দিয়ে সাম্যতার দিকে অগ্রসর হইতে পারবো।
[লেখক: মো. নজরুল ইসলাম,সাধারন সম্পাদক,বাংলাদেশ প্রগতি লেখক সংঘ,মানিকগঞ্জ জেলা শাখা]

Related Articles

Leave a Reply

Back to top button