আন্তর্জাতিক সংবাদশিরোনাম

বিবিসির জরিপ : ধর্মের প্রতি আগ্রহ কমছে আরবদের

গত পাঁচ বছরে ধর্মের প্রতি আরব বিশ্বের মানুষের আগ্রহ কমছে বলে জানিয়েছে, আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম বিবিসি। মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকাজুড়ে বিবিসি পরিচালিত সবচেয়ে বড় ও ব্যাপকভিত্তিক সমীক্ষায় বলা হয়েছে, আরব দেশগুলোতে ধর্মে অনাগ্রহী লোকের সংখ্যা বাড়ছে। জরিপে নারীর অধিকার, ধর্ম, মধ্যপ্রাচ্য নীতির ব্যাপারে আন্তর্জাতিক নেতৃত্ব, এ অঞ্চলের স্থিতিশীলতা, নিরাপত্তা, অভিবাসন ও যৌনতার ব্যাপারে আরবদের ভাবনা, অনুভূতি ও মতামত জানতে চাওয়া হয়। তবে লক্ষণীয়, এই জরিপে সৌদি আরব, কাতার, কুয়েত, ওমান, ইরান ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের মতো প্রভাবশালী দেশগুলো বাদ পড়েছে। এর ব্যাখ্যায় দেশগুলোর নাম উল্লেখ না করে বিবিসি বলেছে, কিছু দেশের সরকার জরিপ পরিচালনায় ‘অবাধ ও পূর্ণ’ প্রবেশাধিকার দেয়নি।
পরিবার সম্পর্কে অভিযোগ করে রাহাফ বলেছিলেন, ‘আমার দেশে আমি পড়তে পারি না। কাজ করতে পারিনি। আমি স্বাধীন হতে চাই। পড়তে চাই। আমার ইচ্ছেমতো কাজ করতে চাই।’ তিনি জানান, পরিবারে তিনি শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের শিকার হতেন। চুল কেটে ফেলার কারণে তাঁকে ছয় মাস ঘরে বন্দী করে রাখা হয়।
পরিবারের অতিমাত্রায় শাসন থেকে বেরিয়ে দম ফেলার জন্য কোনো সৌদি তরুণীর এটাই প্রথম পলায়ন নয়; রাহাফের আগে আরেক সৌদি তরুণী দিনা আলী লাসলুমও (২৪) বাড়ি থেকে পালিয়েছিলেন। তবে তিনি সফল হননি। ২০১৭ সালের এপ্রিলে দিনাকে ফিলিপাইনের ম্যানিলা বিমানবন্দরে আটক করা হয় এবং ফিরিয়ে দেওয়া হয় পরিবারের কাছে।
রাহাফের ঘটনার আট মাস আগে সালওয়া নামের আরেক সৌদি নারী বাড়ি থেকে পালিয়েছিলেন। তবে তিনি একা পালাননি। সঙ্গে নিয়েছিলেন ছোট বোনকে। দুই বোন এখন বাস করছেন কানাডার মনট্রিয়লে।
তাহলে প্রশ্ন উঠেছে, ধর্মীয় বিধিনিষেধ কি আরব সমাজের অনেকের জন্য শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতি তৈরি করেছে? উত্তরটা ‘হ্যাঁ’। শুধু নারী নয়, অনেক পুরুষের জন্যও এ উত্তর প্রযোজ্য। বিবিসির এক সাম্প্রতিক জরিপও তেমন ইঙ্গিতই দিচ্ছে।
বিবিসি নিউজ অ্যারাবিকের জন্য আরব ব্যারোমিটার রিসার্চ নেটওয়ার্কের করা এই জরিপে সাক্ষাৎকার নেওয়া হয় ২৫ হাজারেরও বেশি মানুষের। ২০১৮ সালের শেষে এবং ২০১৯ সালের বসন্ত পর্যন্ত ১০টি দেশে জরিপটি পরিচালনা করা হয়। জরিপে অংশগ্রহণকারী দেশগুলো হচ্ছে আলজেরিয়া, মিসর, ইরাক, জর্ডান, লেবানন, মরক্কো, ফিলিস্তিন-অধ্যুষিত এলাকা, সুদান, তিউনিসিয়া ও ইয়েমেন।
জরিপ থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুসারে, ২০১৩ সাল থেকে এসব অঞ্চলে ধর্মে মন নেই—এমন লোকের সংখ্যা ৮ শতাংশ থেকে বেড়ে ১৩ শতাংশ হয়েছে বলে শনাক্ত করা হয়। ৩০ বছরের নিচের বয়সীদের মধ্যেই এ প্রবণতা বেশি। এই বয়সীদের মধ্যে ১৮ শতাংশ ধর্মে আগ্রহী নয় বলে শনাক্ত হয়েছে। একমাত্র ইয়েমেনের ক্ষেত্রে এ চিত্র উল্টো।
রাজনীতিতে নারীর অধিকারকে বেশির ভাগ সমর্থন জানালেও পরিবারে পুরুষের আধিপত্যই চেয়েছেন তাঁরা। এমনকি নারীরাও চান পুরুষের সিদ্ধান্ত হোক ‘শেষ কথা’।
জরিপে অংশ নেওয়া বেশির ভাগ মানুষ নারীদের প্রেসিডেন্ট বা প্রধানমন্ত্রী হওয়ার অধিকারকে সমর্থন করেন। তবে এ ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম আলজেরিয়া। জরিপে আলজেরিয়ার অংশগ্রহণকারীদের ৫০ শতাংশেরও কম নারীদের দেশের প্রধান হওয়ার বিষয়টি সমর্থন করেছে।
তবে পারিবারিক জীবনের ক্ষেত্রে নারীসহ বেশির ভাগই মনে করেন, পরিবারের চূড়ান্ত কোনো সিদ্ধান্ত স্বামীর বা পুরুষের নেওয়া উচিত। তবে এ ক্ষেত্রে মরক্কো থেকে জরিপে অংশগ্রহণকারীরা কিছুটা ব্যতিক্রম ছিলেন। তাঁদের অর্ধেকেরও কম মনে করেন, স্বামীর হাতেই শুধু পারিবারিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার কর্তৃত্ব থাকা উচিত।
তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ানের বিরুদ্ধে নিজ দেশে বিরোধী মত কঠিনভাবে দমনের অভিযোগ থাকলেও মধ্যপ্রাচ্যবিষয়ক নীতির ব্যাপারে তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি ও উদ্যোগ এই জরিপে সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয়তা পেয়েছে। বেশির ভাগই এ ক্ষেত্রে নেতা এরদোয়ানের নাম নিয়েছেন। তবে তিনটি দেশের অংশগ্রহণকারীরা এরদোয়ানের চেয়ে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনকে তাঁদের পছন্দে এগিয়ে রেখেছেন। এ-বিষয়ক জরিপের প্রতিটি ধাপে সবচেয়ে নিচে স্থান পেয়েছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প।
জরিপে বলা হয়েছে, অংশগ্রহণকারীদের ৫১ শতাংশ এরদোয়ান, ২৮ শতাংশ পুতিন এবং ১২ শতাংশ ট্রাম্পের পক্ষে মত দিয়েছে। লেবানন, লিবিয়া ও মিসর পছন্দের শীর্ষে রেখেছে পুতিনকে। তবে এ ক্ষেত্রে এটাকে অংশগ্রহণকারীদের শতভাগ মতামতের সমষ্টিকে বোঝায় না। কারণ, ‘জানি না’ ও ‘প্রতিক্রিয়া জানাতে অস্বীকৃতি’ জানিয়েছেন যাঁরা, সেসব এতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি।
মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকার অনেকেই নিরাপত্তার বিষয়টি উদ্বেগজনক বলে মনে করেছেন। যখন তাঁদের কাছে প্রশ্ন করা হয়েছে, এই অঞ্চলের নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতার ক্ষেত্রে কোন দেশকে হুমকি মনে করেন? জবাবে সবচেয়ে বেশি উচ্চারিত হয়েছে ইসরায়েলের নাম। এরপরই যুক্তরাষ্ট্র এবং তৃতীয় দেশ হিসেবে ইরানের নাম এসেছে।
জরিপ চালানো দেশগুলোয় অর্থনৈতিক অবস্থা কতটা করুণ, তা উঠে এসেছে বেশির ভাগের দেশত্যাগের ভাবনা থেকে। তাঁরা দেশ ছেড়ে চলে যেতে চান ইউরোপ, আমেরিকা, এমনকি আরব বিশ্বের ধনী দেশগুলোয়। তবে অভিবাসনের জন্য দেশ নির্বাচনে তাঁদের পছন্দে পরিবর্তন এসেছে। ইউরোপ নয়, তাঁদের পছন্দের শীর্ষে এখন উত্তর আমেরিকা।
জরিপে অংশগ্রহণকারী ব্যক্তিদের প্রতি পাঁচজনের একজন অন্য দেশে অভিবাসনের কথা ভাবছেন। এ ভাবনায় সবচেয়ে এগিয়ে সুদান। অর্ধেক মানুষই অন্য দেশে চলে যেতে চান। এর জন্য দেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতিকেই দায়ী করেছেন তাঁরা।
উত্তর আমেরিকায় অভিবাসনে আগ্রহী লোকের সংখ্যা বেড়েছে। একসময় এই অঞ্চলের লোকজনের অভিবাসনের জন্য পছন্দের শীর্ষে ছিল ইউরোপ। এখন তাঁদের কাছে ইউরোপ খুব একটা জনপ্রিয় না। এ ছাড়া আরব বিশ্বের অন্য দেশগুলোও তাঁদের অভিবাসনের আগ্রহের জায়গায় রয়েছে।
সমকামিতার বিষয়ে মনোভাবে তারতম্য দেখা গেছে। তবে এ ব্যাপারে এই অঞ্চলগুলোয় গ্রহণযোগ্যতার হার কম, খুবই কম। প্রতিবেশী দেশগুলোর তুলনায় উদার হিসেবে সুনাম রয়েছে লেবাননের। এরপরও দেশটিতে সমকামিতার বিষয়ে উদার মনোভাব দেখিয়েছে মাত্র ৬ শতাংশ।
২৫ হাজার ৪০৭ জনের সঙ্গে মুখোমুখি কথা বলে জরিপটি পরিচালনা করা হয়। আরব ব্যারোমিটার রিসার্চ নেটওয়ার্ক হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের নিউজার্সির প্রিন্সটন ইউনিভার্সিটিভিত্তিক একটি গবেষণা নেটওয়ার্ক। ২০০৬ সাল থেকে নেটওয়ার্কটি এ ধরনের জরিপ পরিচালনা করে আসছে। ব্যক্তিগত স্থানে অংশগ্রহণকারীদের ৪৫ মিনিট ধরে সাক্ষাৎকার নিয়েছেন গবেষকেরা। এতে শুধু আরব বিশ্বের মতামত তুলে আনা হয়েছে। ফিলিস্তিনকে অন্তর্ভুক্ত করা হলেও এতে নেওয়া হয়নি ইসরায়েল ও ইরানের লোকজনকে। এই অঞ্চলের বেশি ভাগ দেশই এতে অংশ নিয়েছে। তবে কয়েকটি দেশের সরকার জরিপ পরিচালনায় অবাধ ও পূর্ণ প্রবেশাধিকার দিতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে। কুয়েতের জরিপ ফলাফল এত দেরিতে এসেছে যে তা বিবিসি অ্যারাবিক কাভারেজে অন্তর্ভুক্ত করা যায়নি। যুদ্ধ পরিস্থিতির কারণে সিরিয়ায় যাওয়া কষ্টসাধ্য হওয়ায় এ দেশটিও বাদ পড়েছে জরিপ থেকে। আইনি ও সাংস্কৃতিক দিক বিবেচনায় কিছু দেশের অংশগ্রহণকারীরা কিছু প্রশ্নের জবাব দিতে চাননি। ব্যাপক পরিসরে করা জরিপে এগুলো ছিল সীমাবদ্ধতা।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button