sliderধর্মশিরোনাম

প্রবারণার আলোয় আলোকিত হোক আমাদের জীবন: আত্মশুদ্ধি, মৈত্রী ও ত্যাগের মহিমা

অসীম বিকাশ বড়ুয়া: ৬ অক্টোবর সোমবার বাংলাদেশে যথাযথ ভাবগাম্ভীর্য ও মহাসমারোহে অনুষ্ঠিত হচ্ছে শুভ প্রবারণা পূর্ণিমা উৎসব। প্রবারণা পূর্ণিমা বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের অন্যতম প্রধান ও দ্বিতীয় বৃহত্তম ধর্মীয় উৎসব,যা আশ্বিনী পূর্ণিমা নামেও পরিচিত। এই উৎসব ত্রৈমাসিক বর্ষাবাস (আষাঢ়ী পূর্ণিমা থেকে আশ্বিনী পূর্ণিমা পর্যন্ত তিন মাস) সমাপনী এবং ভিক্ষু সংঘের আত্মশুদ্ধি ও বিনয়িক আচারের প্রতীক। প্রবারণা শব্দটি পালি ‘পবারণা’ থেকে এসেছে, যার অর্থ ব্যাপক ও তাৎপর্যমণ্ডিত। এটি মূলত ‘প্রকৃষ্টরূপে বরণ করা’ এবং ‘নিষেধ করা’—এই দুটি দিককে নির্দেশ করে।

​প্রবারণার মূল তাৎপর্য ও আদর্শ: প্রবারণা কেবল একটি উৎসব নয়, এটি জীবনবোধ তৈরির সর্বোত্তম শিক্ষা। এর গভীর তাৎপর্যগুলি আমাদের ব্যক্তিগত ও সামাজিক জীবনে সুদূরপ্রসারী প্রভাব ফেলে:

​আত্মশুদ্ধি ও আত্মসমালোচনা: বর্ষাবাস শেষে ভিক্ষু সংঘ এক পবিত্র বিনয়িক বিধান পালনের মাধ্যমে একে অপরের কাছে নিজেদের দোষ-ত্রুটি স্বীকার করেন। জ্ঞাত বা অজ্ঞাতসারে ঘটে যাওয়া যেকোনো ভুলের জন্য প্রায়শ্চিত্ত ও ক্ষমা প্রার্থনার আহ্বান জানান। এর মাধ্যমে তাঁরা চারিত্রিক শুদ্ধি অর্জন এবং ভবিষ্যতের জন্য ত্রুটিমুক্ত থাকার অঙ্গীকার করেন। এটি শেখায় যে, ভুল স্বীকার করার মধ্যেই মহত্ত্ব নিহিত।

কুশল বরণ ও অকুশল বর্জন: প্রবারণা মানেই অন্যায় (অকুশল) কর্মকে বর্জন করা এবং ন্যায় (কুশল) ও সত্যকে বরণ করার শপথ নেওয়া। গৃহী বা সাধারণ বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীরাও এদিন দান, শীল (নীতি), ভাবনা ও প্রজ্ঞার অনুশীলন করে নিজেদের জীবনের ভুলভ্রান্তি স্বীকার করেন এবং বিশুদ্ধ জীবনযাপনের আদর্শে ব্রতী হন।

মৈত্রী, সৌহার্দ্য ও সম্প্রীতি: এই উৎসব পারস্পরিক মিলন ও ভালোবাসার প্রতীক। সব ভেদাভেদ ভুলে গিয়ে একে অপরের প্রতি মৈত্রী, ভালোবাসা ও বন্ধুত্বের ভাব বিনিময় করা হয়। এটি মনের মলিনতা দূর করে,একতা ও সম্প্রীতির বন্ধনকে সুদৃঢ় করে।

ভিক্ষুসংঘের বিনয়িক বিধান: ভগবান বুদ্ধ শ্রাবস্তীর জেতবন বিহারে অবস্থানকালে বর্ষাবাস শেষে ভিক্ষুদের প্রতি এই প্রবারণার প্রবর্তন করেন। তিনি নির্দেশ দেন যে, ভিক্ষুগণ যেন মৌনব্রত পালন না করে পরস্পরের কাছে দৃষ্ট, শ্রুত বা আশঙ্কিত যেকোনো ত্রুটি সনির্বন্ধ অনুরোধের মাধ্যমে জ্ঞাপন করেন, যা অপরাধ হতে উদ্ধার ও নিয়মানুবর্তিতার পথ।
​ঐতিহাসিক ও ধর্মীয় ঘটনা,প্রবারণা পূর্ণিমা মহামানব গৌতম বুদ্ধের জীবনের কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার স্মৃতি বহন করে:

​মাতৃদেবীকে ধর্মদেশনা ও মর্ত্যে অবতরণ: এই পূর্ণিমা তিথিতে গৌতম বুদ্ধ তাবতিংস স্বর্গে তাঁর প্রয়াত মাতৃদেবী মাতা মায়াদেবীকে অভিধর্ম দেশনা করার পর সাংকশ্য নগরে অবতরণ করেছিলেন। এটি বৌদ্ধদের জন্য অত্যন্ত স্মৃতিসমৃদ্ধ ও আনন্দের একটি ঘটনা।

সদ্ধর্ম প্রচারের নির্দেশ: প্রথম বর্ষাবাস শেষে আশ্বিনী পূর্ণিমার অন্তে বুদ্ধ ৬০ জন অর্হৎ ভিক্ষুকে “বহুজনের হিতের ও সুখের জন্য আদি-মধ্য-অন্তে কল্যাণকর ধর্ম দিকে দিকে প্রচার কর”—এই গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশ দিয়েছিলেন। এর পরদিন থেকেই শুরু হয় দানোত্তম কঠিন চীবর দান উৎসব।

​ফানুস উড়ানোর তাৎপর্য প্রবারণা পূর্ণিমার অন্যতম প্রধান আকর্ষণ হলো সন্ধ্যায় আকাশ প্রদীপ বা ফানুস উড়ানো। এটিকে নিছক উৎসব হিসেবে না দেখে, এর পিছনে থাকা ধর্মীয় তাৎপর্য উপলব্ধি করা প্রয়োজন:

​কেশরাশির প্রতি পূজা ও সম্মান প্রদর্শন: কথিত আছে, সিদ্ধার্থ গৌতম গৃহত্যাগ করার পর যখন কেশররাশি কেটে ঊর্ধ্বে নিক্ষেপ করে সত্যক্রিয়া করেন, তখন দেবরাজ ইন্দ্র সেই কেশরাশি তাবতিংস স্বর্গে নিয়ে গিয়ে চুলামনি চৈত্য প্রতিষ্ঠা করে পূজা শুরু করেন। মর্ত্য থেকে সেই পবিত্র চুলামনি চৈত্যকে পূজা ও সম্মান প্রদর্শনের উদ্দেশ্যে বৌদ্ধরা ফানুস বা আকাশ প্রদীপ উত্তোলন করেন।

অন্ধকার দূর করে আলোর পথে: ফানুসের আলো মানুষের অন্তর্জগৎকে আলোকিত করার প্রতীক। এটি সব রকমের পাপ, অন্ধত্ব, কুসংস্কার ও অকুশল কর্ম থেকে দূরে সরে গিয়ে পবিত্রতা ও জ্ঞানের আলোকে বরণ করার বার্তা দেয়।

​প্রবারণার নৈতিক আবেদন: মৈত্রীই হোক আমাদের পথ
​প্রবারণা পূর্ণিমার মূল আদর্শ হলো হিংসা-বিদ্বেষ ভুলে পারস্পরিক মৈত্রী, সহাবস্থান ও অহিংসার মাধ্যমে একটি পরিচ্ছন্ন সমাজ গঠন করা। উৎসবের জাঁকজমক যেন ধর্মের মূল নীতি ও আদর্শকে ছাপিয়ে না যায়, সেই বিষয়ে সচেতন থাকা জরুরি।

​আজকের দিনে যখন ব্যক্তিগত অহংবোধ ও ক্ষমতার লোভ আমাদের মধ্যে হানাহানি ও বিভেদ সৃষ্টি করে,তখন প্রবারণা আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয়:

​”কিসের এত রাগ, কিসের এত হিংসা! এই সামান্য জীবনে কিসের এত প্রতিযোগিতা, কিসের এত মুখ ফিরিয়ে নেওয়া? জীবন তো একেবারেই অনিশ্চিত, কাঁচের গ্লাসের মতো ভঙ্গুর।”

প্রকৃত ধর্মচর্চা মানে শুধু উৎসবে অংশ নেওয়া নয়, বরং বুদ্ধের অহিংসা, শান্তি ও মৈত্রীর আদর্শকে হৃদয়ে ধারণ করে মানুষ ও মানবতার জন্য জীবন উৎসর্গ করা। ভিক্ষু বা গৃহী—সকলের উচিত বুদ্ধের পঞ্চশীল মেনে চলা, অসচ্ছল মানুষের পাশে দাঁড়ানো এবং নিজেদের ভুল-ত্রুটির জন্য ক্ষমা চেয়ে নতুন উদ্যমে সৎ পথে জীবন পরিচালনা করা।

​আসুন, শুভ প্রবারণা পূর্ণিমার এই মহালগ্নে আমরা প্রত্যেকে ফানুসের আলোর মতো আমাদের অন্তর্জগৎকে আলোকিত করি। সব বাদ-বিসংবাদ ভুলে পরস্পরকে ক্ষমা করি এবং ভালোবাসা, হাসি ও পূর্ণতায় জীবন ভরিয়ে তুলি। জগতের সকল প্রাণী সুখী হোক।

লেখক: সাংবাদিক, প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট ও এক্স ভাইস-চেয়ারম্যান(কোরিয়া বাংলা-প্রেসক্লাব)

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button