মেয়ের ধর্ষকদের সাথে লড়াই করা এক মায়ের গল্প

নকুবঙ্গা কাম্পি নামের এক মহিলা দক্ষিণ আফ্রিকায় পরিচিত হয়ে উঠেছেন ‘লায়ন মামা’ অর্থাৎ ‘সিংহ মা’ হিসেবে। তবে এই নামের পেছনে লুকিয়ে আছে লোমহর্ষক কাহিনী। তার মেয়ের তিন ধর্ষণকারীর একজনকে হত্যা এবং অন্য দু’জনকে আহত করার পর লোকজন তাকে এ নামেই ডাকতে শুরু করেন।
আন্তর্জাতিক সংবাদ সংস্থা বিবিসি এমন একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে।
এজন্য তার বিরুদ্ধে খুনের অভিযোগ আনা হয়েছিল। কিন্তু জনগণের প্রতিবাদের কারণে সেই বিচার বন্ধ করে দিতে হয়। এর ফলে এখন তিনি তার মেয়ের সেরে ওঠার ব্যাপারে তাকে সাহায্য করার সময় পেয়েছেন।
ঘটনার দিন রাতে নকুবঙ্গা কাম্পি কাছে যখন ফোনটা আসে তখন মধ্যরাত। ঘুমিয়ে ছিলেন তিনি। ফোনের অপর পাশে তার মেয়ে সিফোকাজি মাকে জানায়, তিনজন পুরুষ তাকে ধর্ষণ করেছে এবং তাদেরকে তারা সবাই বেশ ভালো মতোই চেনে।
খবরটা শুনে নকুবঙ্গা প্রথমেই তার মেয়েকে পুলিশের সাথে যোগাযোগ করতে বললেন। কিন্তু অপর পাশ থেকে তিনি কোনো সাড়া পেলেন না।
মা নকুবঙ্গা জানতেন পুলিশের সাথে যোগাযোগ করা হলেও দক্ষিণ আফ্রিকার ইস্টার্ন কেইপ প্রদেশের প্রত্যন্ত এই গ্রামটিতে পৌঁছাতে তাদের অনেক সময় লাগবে। তাই হয় তো সিফোকাজি ভেবেছিলেন এরকম একটা সময়ে সাহায্যের জন্যে হয়তো তার মা-ই একমাত্র আছেন, যিনি এগিয়ে যেতে পারেন।
এ বিষয়ে নকুবঙ্গা বলেন, ‘আমি খুব ভয় পেয়েছিলাম। কিন্তু আমি যেতে বাধ্য হলাম কারণ সে তো আমারই মেয়ে। আমি ভাবছিলাম যখন আমি পৌঁছাবো তখন হয়তো দেখবো সে মরে পড়ে আছে। কারণ সে তো ধর্ষণকারীদের চিনতো।’
তিনি আরো বলেন, ‘ওই লোকগুলো যেহেতু তাকে চেনে, সে কারণে ওরা নিশ্চয়ই আমার মেযেকে মেরে ফেলতো – যাতে সে ধর্ষণের ব্যাপারে পুলিশের কাছে অভিযোগ করতে না পারে।’
মেয়ে সিফোকাজি তার মায়ের কাছ থেকে ৫০০ মিটার দূরে ওই গ্রামেরই আরেকটি বাড়িতে কয়েকজন বন্ধুর সাথে দেখা করতে গিয়েছিলেন। সেখানে তিনি যখন ঘুমিয়ে পড়েন তখন তার বন্ধুরা তাকে একা রেখে বাড়ির বাইরে চলে যায়। সেই সুযোগে রাত দেড়টার দিকে পাশের আরেকটি বাড়ি থেকে তিনজন মাতাল পুরুষ এসে তাকে আক্রমণ করে।
নকুবঙ্গা সঙ্গে সঙ্গে ঘুম থেকে উঠে গিয়ে কিচেনে গিয়ে সেখান থেকে একটি ছুরি হাতে নেন।
তিনি বলেন, ‘ছুরিটা আমি নিয়েছিলাম আমার নিজের জন্য। রাতের অন্ধকারে যখন রাস্তা দিয়ে ওই বাড়িতে হেঁটে যাবো, ভেবেছিলাম ওটা আমার জন্যে নিরাপদ হবে না। খুব অন্ধকার ছিল বাইরে। মোবাইল থেকে টর্চের আলো জ্বালিয়ে পথ দেখে দেখে আমাকে যেতে হয়েছিল।’
মা নকুবঙ্গা যখন ওই বাড়ির কাছাকাছি গিয়ে পৌঁছালেন তখন তিনি মেয়ের চিৎকার শুনতে পেলেন। আর বাড়িটির বেডরুমে ঢোকার পর মোবাইল ফোনের টর্চের আলোতে তিনি দেখলেন ‘মেয়েকে ধর্ষণ’ করার সেই ভয়ানক দৃশ্য।
তিনি বলেন, ‘খুব ভয় পেয়ে যাই। কোন রকমে দরজার পাশে দাঁড়িয়েছিলাম। জিজ্ঞেস করলাম তারা এখানে কী করছে। আমাকে দেখে তারা আমার উপর আক্রমণ চালাতে ছুটে এলো। ঠিক ওই মুহূর্তে নিজেকে বাঁচানোর কথা মনে হয়েছিল আমার।’ এরপর কী কী হয়েছিল, সে বিষয়ে বিস্তারিত আর বলতে চাইলেন না নকুবঙ্গা।
এই মামলার বিচারের সময় বিচারক আদালতে বলেছিলেন, ‘নকুবঙ্গার সাক্ষ্য থেকে বোঝা যায় যে তিনি কতোটা আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েছিলেন। কারণ তিনি দেখতে পেলেন যে তার মেয়েকে তার চোখের সামনে ধর্ষণ করা হচ্ছে। তিনি বলেছেন যে তিনজন পুরুষের একজন তার মেয়েকে ধর্ষণ করছিল, আর দু’জন প্যান্ট খোলা অবস্থায় পাশেই দাঁড়িয়েছিল। তারা অপেক্ষা করছিল তাদের পালা কখন আবার আসবে।’
এ বিষয়ে বিচারক এম্বুলেলো জলওয়ানা বলেন, ‘তিনি যে খুব ক্রুদ্ধ হয়ে পড়েছিলেন সেটা বোঝা যায়।’
এটা পরিষ্কার যে ওই পুরুষরা যখন নকুবঙ্গাকে আক্রমণ করে তখন তিনিও তার ছুরি দিয়ে পাল্টা আঘাত করেছিলেন। যখন তারা পালাতে উদ্যত হয় তখন তিনি ছুরি মারেন।
তাদের একজন জানালা দিয়ে পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়। ধর্ষণকারীদের দু’জন গুরুতর আহত হয় এবং অন্যজন মারা যায়। এরপর আর দেরি না করে নকুবঙ্গা তার মেয়েকে নিয়ে চলে যান কাছেই এক বন্ধুর বাড়িতে।
এই ঘটনার পর পুলিশ এসে নকুবঙ্গাকে গ্রেফতার করে নিয়ে যাওয়া হলো স্থানীয় একটি পুলিশ স্টেশনে। সেখানে একটি সেলে তাকে বন্দী করে রাখা হলো।
পুলিশ তাকে থানায় নিয়ে পর তার ভাবনার বিষয়ে বলেন,‘আমি শুধু আমার মেয়ের কথা ভাবছিলাম। কারণ তার কোন খবর ছিল না আমার কাছে। এটা এক দুঃসহ অভিজ্ঞতা।’
মেয়ে সিফোকাজিকে ততক্ষণে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। আর সেখানে শুয়ে শুয়ে ভাবছিলেন মায়ের যেন কী অবস্থা! আর খুনের কারণে মাকে কতো বছর জেলে কাটাতে হবে, সেটা ভেবে অস্থির হয়ে পড়েছিলেন তিনি।
সিফোকাজি বলছিলেন, ‘তাকে যদি কারাগারে যেতে হয়ে, তার হয়ে আমি জেল খাটতে রাজি আছি।’
সিফোকাজি এখন ওই রাতের কথা খুব সামান্যই স্মরণ করতে পারেন। কিন্তু তিনি মনে করতে পারেন যে দুদিন পর তার মা হাসপাতালে গিয়ে হাজির হয়েছিলেন। তাকে জামিনে মুক্তি দেয়া হয়েছিল মেয়ের সাথে দেখা করার জন্যে। এর পর থেকেই তারা দু’জনে একে অপরকে মানসিকভাবে সাহায্য দিয়ে আসছেন।
সিফোকাজি আরো বলেন, ‘আমাকে কোন কাউন্সেলিং দেয়া হয়নি। কিন্তু আমার মা আমাকে সহযোগিতা করছেন। আমি সেরে উঠছি।’মা নকুবঙ্গা চান আগের মতোই স্বাভাবিক জীবনে ফিরে যেতে। সেজন্যে চেষ্টাও চালিয়ে যাচ্ছেন তিনি।
মা নকুবঙ্গা বলেন, ‘আমি তো এখনো একজন মা এবং সে একজন কন্যা। তারা এখন একসাথে হাসেন, কাঁদেন। সুখ দুঃখের গল্প শেয়ার করেন। মজাও করেন তারা। সিফোকাজি বিয়ে করতে পারছে না কারণ বিয়ে হয়ে গেলে মা নকুবঙ্গাকে দেখার আর কেউ থাকবে না।’
নকুবঙ্গার আইনজীবী বুলে টনিস বলেন, ঘটনার এক সপ্তাহ পর তিনি যখন তাদের সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলেন, মনে হয়েছিল তারা জীবনের হাল ছেড়ে দিয়েছেন।
আইনজীবী বুলে টনিস আরো বলেন, ‘তাদের দারিদ্র এতোটাই প্রকট যে তারা ভাবছিল একজন জেলখানায় চলে গেলে আরেকজনের তখন কী হবে। তার পাশে তো দাঁড়ানোর কেউ থাকবে না। বিচার ব্যবস্থা তাদের জন্যে, যাদের কাছে অর্থ আছে।’
টনিস আরো বলেন, ‘তিনি যখন মা ও মেয়ের সাথে কথা বলছিলেন তখন তারা ঠিকমতো কথাও বলতে পারছিলেন না। তার মনে হলো ওই ঘটনা যেন তাদের মুখের কথাও কেড়ে নিয়েছে।’
দক্ষিণ আফ্রিকাতে দিনে গড়ে প্রায় ১১০টির মতো ধর্ষণের ঘটনা ঘটে এবং এই পরিস্থিতিকে প্রেসিডেন্ট সিরিল রামাফোসা দেশের জন্য জাতীয় সঙ্কট বলে উল্লেখ করেছিলেন। আর ইস্টার্ন কেইপ প্রদেশে সিফোকাজি’র যেখানে ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে। সেই এলাকাটি দেশটির অন্যতম দরিদ্র এলাকা, যার বেকারত্বের হার ৪৫ শতাংশ।
আর অন্য যে কোন জায়গার চেয়ে এই প্রদেশে ধর্ষণের ঘটনাও ঘটে বেশি। নকুবঙ্গা এবং সিফোকাজি যে গ্রামে থাকেন, সেই গ্রামেই ২০১৭/১৮ সালে ৭৪টি ধর্ষণের ঘটনা পুলিশের কাছে রিপোর্ট করা হয়েছে। যে গ্রামে মাত্র ৫ হাজারেরও কম মানুষের বসবাস করে, সেখানে এই সংখ্যা খুবই বেশি।
কিন্তু দক্ষিণ আফ্রিকায় এতো সব ধর্ষণের খবরের মধ্যে সিফোকাজি ও নকুবঙ্গার ঘটনা মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করলো। ধর্ষিতা মেয়েকে বাঁচাতে মায়ের এই গল্প উঠে এলো সংবাদ মাধ্যমে। খবরটি ছড়িয়ে পড়লো খুব দ্রুত।
মা ও মেয়ের পরিচয় গোপন রাখতে গিয়ে একটি পত্রিকা মায়ের নাম দিল ‘লায়ন মামা’ অর্থাৎ ‘সিংহী মা।’ খবরটি পাশে একটি ছবি ছাপা হলো যাতে একটি সিংহী তার শাবককে আগলে রেখেছে। আর এই নামটি খুবই আলোড়ন সৃষ্টি করলো।
মা নকুবঙ্গা বলেন, ‘প্রথমে এটা আমার পছন্দ হয়নি। কারণ আমি কিছু বুঝতে পারিনি। কিন্তু পরে যখন বুঝলাম যে আমাকে একজন বীর হিসেবে পরিচয় দেয়া হয়েছে তখন খারাপ লাগেনি। একটা সিংহ তার বাচ্চাকে তো রক্ষা করবেই।’
নকুবঙ্গার বিরুদ্ধে খুনের অভিযোগ আনার সিদ্ধান্তের তীব্র সমালোচনা করলো দক্ষিণ আফ্রিকার লোকজন। তার আইনি লড়াই’এ সহযোগিতা করতে তারা অর্থ সংগ্রহেও নেমে পড়ে। তার পর থেকে ধীরে ধীরে জনগণের সমর্থন বাড়তেই লাগলো। মানসিকভাবেও কিছুটা শক্তি পেতে শুরু করলেন তিনি। ঘটনার এক মাস পর তিনি উপস্থিত হলেন স্থানীয় একটি ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে।
মা নকুবঙ্গা বলেন, ‘আদালতে যাওয়ার ব্যাপারে আমি ভয়ে ছিলাম। সকালে ঘুম থেকে আমি প্রার্থনা করলাম।’
তিনি যখন আদালতে গিয়ে হাজির হলেন তখন দেখলেন, সেখানে তার প্রতি সমর্থন জানিয়ে আরো বহু শুভাকাঙ্ক্ষী ইতোমধ্যেই সেখানে জড়ো হয়েছেন।
মা নকুবঙ্গা বলেন, ‘সারা দক্ষিণ আফ্রিকা থেকেই লোকজন এসেছিল। আমি তাদেরকে ধন্যবাদ জানাই। তারা আমাকে খুব জোরালো সমর্থন দিয়েছিল। দিয়েছিল আশাও।’
তখন তাকে খুব দ্রুত আদালতের সামনে হাজির করা হলো এবং বলা হলো যে তার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ প্রত্যাহার করে নেয়া হয়েছে।
মা নকুবঙ্গা বলেন, ‘আমি শুধু দাঁড়িয়ে ছিলাম। খুব খুশি হয়েছিলাম তখন। তখন বুঝলাম যে কোনটা ভুল আর কোনটা ঠিক বিচার ব্যবস্থা সেটা নির্ধারণ করতে পারে। তারা ঠিকই বুঝতে পেরেছিল যে কারো জীবন কেড়ে নেয়া আমার লক্ষ্য ছিল না।’
তার আইনজীবী বলেন, ‘মামলা তুলে নেয়ার পর মা তার মেয়েকে ডাকলেন। সেদিনই প্রথম আমি তার মেয়েকে হাসতে দেখলাম। সেদিন সে বলেছিল যে ধর্ষণকারীদেরকে সে জেলখানায় দেখতে চায়।’
এজন্যে তাদেরকে আরো এক বছর অপেক্ষা করতে হয়েছে। ২০১৮ সালের ডিসেম্বর মাসে বেঁচে থাকা দুজন ধর্ষণকারীকে ৩০ বছর করে কারাদণ্ড দেয়া হয়।
সিফোকাজির বয়স এখন ২৭। ধর্ষণকারীদের বিচার ও সাজা হওয়ার কারণে তিনি খুশি। তিনি বলেন, ‘কিছুটা নিরাপদও বোধ করি আমি। তবে ওদের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হওয়া উচিৎ ছিল।’
এর পরে মামলাটি যখন পুরোপুরি বাতিল হয়ে গেল তখন তিনি নাম প্রকাশ করতে এগিয়ে এলেন যাতে ধর্ষণের শিকার অন্যান্যরাও তার ঘটনা থেকে উৎসাহিত হয়।
সিফোকাজি আরো বলেন, ‘আমি বলবো যে এরকম একটা ঘটনার পরেও জীবন আছে। এর পরেও আপনি সমাজে ফিরে যেতে পারেন। পারেন খুব স্বাভাবিক জীবন চালিয়ে যেতে।’
মা নকুবঙ্গাও আশা করেন যে তার মেয়ের ধর্ষণকারীরা এই ঘটনা থেকে শিক্ষণীয় কিছু একটা পাবে।
তিনি বলেন, ‘তাদের সাজা যখন শেষ হয়ে যাবে, আমি আশা করছি, তারা নিজেদের বদলে নতুন মানুষ হিসেবে সমাজে ফিরে যাবে। মানুষের কাছে তারা হয়ে থাকবে জীবন্ত উদাহরণ।’