sliderখেলাশিরোনাম

তামিমের অবসরগ্রহণের নেপথ্যে যা

টেলিফোনের অন্য প্রান্তে হাবিবুল বাশার স্তম্ভিত। বাংলাদেশ উদীয়মান দলের ম্যনেজারের দায়িত্ব পালন করতে এই মুহূর্তে শ্রীলঙ্কায় আছেন জাতীয় দলের সাবেক এই অধিনায়ক।

সেখান থেকেই চোখ রাখছিলেন জাতীয় দলের কার্যক্রমে। আফগানিস্তান সিরিজের খোঁজ খবর রাখাটা তার কর্তব্যের মধ্যেই পড়ে। জাতীয় দলের সাবেক অধিনায়কের পাশাপাশি একজন জাতীয় নির্বাচকও তিনি।

সিরিজের মাঝ পথে তামিম ইকবাল এমন একটা ঘোষণা দিয়ে বসতে পারেন এটা তার কাছে কল্পনারও অতীত। খবরটা জানাতেই কিছুক্ষণ তিনি শব্দহীন। অনেকটা সময় আবেগকে ধরে রেখে শুধু একটা বাক্যই উচ্চারণ করতে পারলেন, ‘বাংলাদেশের সর্বকালের অন্যতম সেরা ক্রিকেটার তামিম।’

চোখের কোণও কি একটু ভিজে উঠেছিল তার? তামিমের কাছে তিনি তো শুধু জাতীয় দলের সাবেক অধিনায়ক বা নিছকই একজন জাতীয় নির্বাচক নন। জাতীয় দলে তামিমের প্রথম অধিনায়কও ছিলেন তিনি।

আজকের দিনটা শুধু তামিমের চোখের পানিতে বিদায় বলে দেয়ার দিন নয়। বাংলাদেশের ক্রিকেটের সাথে সম্পৃক্ত আরো অসংখ্য মানুষের জন্যই এই দিনটা আবেগের। মাঠে, মাঠের বাইরে কত স্মৃতি তামিম উপহার দিয়েছেন সবাইকে। তামিমের অবসর ঘোষণা প্রায় সবার জন্যই একটা বিরাট ধাক্কা।

মুখে যতই বলুন, ক’দিন ধরেই অবসর নিয়ে পরিবার ও ঘনিষ্ঠজনদের সাথে আলাপ করেছিলেন- এমন একটা ঘোষণা দেয়ার জন্য সম্ভবত তামিম নিজেও প্রস্তুত ছিলেন না। সংবাদ সম্মেলনে যখন এলেন চোখ অনেকটা লালচে। বুঝাই যাচ্ছিল যে অনেকটা সময় কান্নাকাটি করেছেন তিনি। হয়ত একাই।

শুরুতে বেলা ১২টায় সংবাদ সম্মেলনে আসবেন বলেছিলেন। এলেন আরো ঘণ্টা দেড়েক পর। হয়ত এই সময়টায় নিজের সাথে বোঝাপড়া করেছেন। কখনো বা নিজেকে প্রবোধ দিয়েছেন। নিজের সিদ্ধান্ত নিজে কাঁটা-ছেড়া করেছেন। তার হাতে তো একাধিক অপশন ছিল। চাইলে শুধু জাতীয় দলের অধিনায়কত্ব ছেড়ে দিতে পারতেন। কিংবা ওয়ানডে ছেড়ে দিয়ে আরো কিছু দিন টেস্ট চালিয়ে যাওয়ার কথা বলতে পারতেন। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটকে একেবারেই বিদায় বলে দেয়া ছিল চরমতম সিদ্ধান্ত। তামিম সেটাই বেছে নিয়েছেন।

তার এই সিদ্ধান্তের পেছনে সবাই আবেগের বাড়াবাড়ি দেখলেও তামিম হয়ত নিজেকে বিজয়ী ভাবতে চেয়েছেন। তার মতো করে বাংলাদেশের প্রায় আর কোনো অধিনায়কই যে বিদায় নিতে পারেনি। অনেক বছর আগে মুশফিকুর রহিম জিম্বাবুয়েতে এমন একটা আবেগতাড়িত ঘোষণা দিয়েছিলেন। কিন্তু সেটা ছিল কেবলই অধিনায়কত্ব ছাড়ার ঘোষণা। নিছকই অপরিপক্ব সিদ্ধান্ত, যা মুশফিক নিজেও পরে বুঝতে পেরেছেন এবং সিদ্ধান্ত বদল করেছেন।

তামিম তার সিদ্ধান্ত বদলাবেন কি-না তা সময়ই বলে দিবে। তবে এই ঘটনার পেছনের যে প্রেক্ষাপট তাতে তেমন সম্ভাবনা সামান্যই। আফগানিস্তান সিরিজটি নিশ্চয় তামিম অবসর নিবেন ভেবে শুরু করেননি। বিশ্বকাপকে সামনে রেখে তিন বছর আগেই তাকে অধিনায়ক করা হয়েছিল। বাংলাদেশের ক্রিকেটে মাশরাফি মর্তুজা ছাড়া আর কোনো ক্রিকেটারকে এতটা লম্বা সময় দেয়া হয়নি। তাহলে বিশ্বকাপ শুরুর তিন মাস আগে কেন তিনি দায়িত্ব ছেড়ে দিবেন?

কারণটা সম্ভবত প্রায় সবারই জানা। তবু বলি, শতভাগ ফিট না হয়েও প্রথম ম্যাচে তার খেলার সিদ্ধান্তের যে কড়া সমালোচনা বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড (বিসিবি) সভাপতি নাজমুল হাসান করেছেন তামিম তা নিতে পারেননি। সমালোচনাটা মোটেও অন্যায্য ছিল না। কিন্তু সিরিজের মাঝপথে অধিনায়কের এমন প্রকাশ্য সমালোচনা কতটা ন্যায্য তা প্রশ্ন রাখাই যায়।

বিসিবি সভাপতি তামিমের পেশাদারিত্ব নিয়ে প্রশ্ন করেছেন। তা তিনি করতেই পারেন। তবে বিসিবির ঠিক কোথায় কোথায় পেশাদারত্ব আছে ওই প্রশ্নে তার নিশ্চুপ থাকা ভিন্ন কোনো উপায় কী আছে? জাতীয় দল নিয়ে তার অতিকথন আগেও সমালোচিত হয়েছে। এখন তা বাংলাদেশকে একটা বড় ক্ষতির মুখেই ঠেলে দিয়েছে।

সিরিজে এই মুহূর্তে বাংলাদেশ ০-১ ব্যবধানে পিছিয়ে আছে। আজ (বৃহস্পতিবার) ছিল ভুল-ভ্রান্তি খুঁজে বের করার দিন। কিন্তু তা না করে এখন পরের ম্যাচের জন্য অধিনায়ক খুঁজতে হচ্ছে। সামনে আরো বড় ঝামেলায় পড়তে যাচ্ছে দল নিশ্চিতভাবেই।

টানা প্রায় ১৭ বছর ওয়ানডে দলে খেলছেন তামিম। ইনজুরি ছাড়া এক ম্যাচের জন্যও দল থেকে বাদ পড়েননি তিনি। বাংলাদেশে এই রেকর্ড আর কোনো খেলোয়াড়ের নেই। এমনকি সাকিব, মাশরাফিরও নেই। ক্যারিয়ারের শুরুর দিকে তাদেরও বাদ পড়ার অভিজ্ঞতা হয়েছে, কিন্তু তামিমের কখনো এই অভিজ্ঞতা হয়নি। বিসিবিকে এখন এমন একজন খেলোয়াড় ও অধিনায়ক তামিমের বিকল্প খুঁজে বের করতে হবে এবং তা আগামীকালই। এক দিন পরই যে আফগানিস্তানের সাথে দ্বিতীয় ম্যাচ। বিশ্বকাপও তো মাত্র তিন মাস দূরে।

একটা ক্রিকেট বোর্ডে পেশাদারত্বের সামগ্রিক ঘাটতি থাকেলেই কেবল দল এমন পরিস্থিতিতে পড়তে পারে। চাইলে বাংলাদেশের ক্রিকেট সংস্কৃতিকেও এ জন্য দায়ী করা যায় অনায়েসেই। নিজেদের ক্যারিয়ারে কখন থামতে হবে বাংলাদেশের অনেক ক্রিকেটারের ওই পরিকল্পনা থাকে না। যদিও বা কারো ওই পরিকল্পনা থাকেও সবাই মিলে পরিস্থিতি এমন করে তোলে যে মাঠ থেকে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটকে বিদায় বলার প্রায় কারো সুযোগ থাকে না। খালেদ মাহমুদ ছাড়া আর কোনো সাবেক অধিনায়ক ওই সুযোগ পাননি। মাশরাফি টি-টোয়েন্টি থেকে অবসর ঘোষণা দিয়েছেন টসের সময়। ওয়ান ডে থেকে তো বিদায় নিতেই পারেননি।

এই লেখা যখন লিখছিলাম ইংল্যান্ড থেকে ফোন করেছেন মোহাম্মদ আশরাফুল। তামিমের সিদ্ধান্তে হাবিবুল বাশারের মতো তিনিও বিস্মিত। তবে এবার তাকে এতটা আবেগ তাড়িত মনে হয়নি। অনেকটা উদাস স্বরে বললেন, ভালোই করেছে তামিম। চারদিক থেকে ন্যায্য, অন্যায্য এত সমালোচনা হচ্ছিল যে তার এ থেকে বাঁচার জন্য এর চেয়ে ভালো কিছু হাতে ছিল না।

আশরাফুলের কণ্ঠেও বিষণ্ণতার সুর। তামিম তবুও বিদায় বলার সুযোগ পেয়েছেন। আশরাফুল তো সেই সুযোগও পাননি। যতই তাকে ম্যাচ ফিক্সিং বিতর্ক ঘিরে থাকুক, বাংলাদেশের ক্রিকেটে প্রথম সুপারস্টার তো তিনি।

কিন্তু বাংলাদেশ আর কবে কাকে সম্মানের সাথে বিদায় দিয়েছে। কান্নাই বাংলাদেশের সব তারকার শেষ পরিণতি। তামিম তা-ও ভাগ্যবান। নিজেরে শহরে, স্মৃতির চট্টগ্রামে বিদায় বলতে পেরেছেন। আশরাফুল, হাবিবুল বাশারদের যত কান্না, আবেগ সব অন্ধকারে মিশে গেছে।
সূত্র : ডয়চে ভেলে

Related Articles

Leave a Reply

Back to top button