sliderস্থানীয়

অস্তিত্ব সংকটে মানিকগঞ্জের নদ নদী

আব্দুর রাজ্জাক,ঘিওর, মানিকগঞ্জ : পদ্মা-যমুনা ছাড়াও মানিকগঞ্জে বয়ে গেছে ইছামতী, কালীগঙ্গা, কান্তাবতী, মনলোকহানী, গাজীখালী, ক্ষীরাই, মন্দা, ভুবনেশ্বর, ধলেশ্বরী। নদ-নদীর আধিপত্যে মানিকগঞ্জের ইতিহাস বেশ দাপুটে। ১৩৭৯ বর্গকিলোমিটার আয়তনের মানিকগঞ্জে নদীর দৈর্ঘ্য প্রায় ২৪১ কিলোমিটার। ছোট-বড় ১১টি নদীতে বছর জুড়েই পানির প্রভাব ছিল বিস্তর। কিন্তু বর্তমানে পানির জায়গায় পানির জন্যই হাহাকার। জেলার মাঝ দিয়ে প্রবাহিত এসব নদী পানিশূন্য হয়ে পড়েছে। শুকনো মৌসুমে পানি সঙ্কট বিরাজ করছে। নদীর বুকজুড়ে ধুধু বালুচর, কোথাও চাষাবাদ, কোথাও গরু চরানো কিংবা দুরন্তদের ক্রিকেট ও ফুটবল খেলার দৃশ্য চোখে পড়ে।

নদীর তলদেশ ভরাট হয়ে যাওয়া, ড্রেজিং না করা, বালু ব্যবসায়ীদের অবৈধ ও অপরিকল্পিত বালু উত্তোলন, দূষন এবং নদী পাড় দখলের কারণে ৬টি নদী, ২৩টি খাল-বিল ও দুই শতাধিক ছোট জলাশয়ের অস্বিত্ব বিলীন হওয়ার পথে। একসময় যেখানে বছরজুড়ে পানি থাকত, শুকনো মওসুমে সেখানে এখন এক ফোঁটা পানিও মেলে
না। নৌকার পরিবর্তে চলাচল করে ঘোড়ার গাড়িসহ বিভিন্ন যানবাহন। মানিকগঞ্জ সীমানায় এর মধ্যে মনলোকহানী, ক্ষীরাই, মন্দা, ভুবনেশ্বর নদীর অস্তিত্ব হারিয়ে গেছে মানচিত্র থেকে। ধলেশ্বরী আর কালীগঙ্গা নদীরও করুণ অবস্থা। নাব্যতা হারানো এসব নদীর আকার-আয়তন মারাত্মকভাবে হ্রাস পাচ্ছে।
বদলে যাচ্ছে নদীর গতিসীমা।

পানির উৎসকে বাঁচিয়ে রাখার দাবীতে সম্প্রতি মানিকগঞ্জ নদী বাঁচাও আন্দোলন কমিটি সকল নদী ও খালের নাব্যতা রক্ষায় নিয়মিত খনন কার্যক্রম অব্যাহত রাখার দাবীতে জেলা প্রশাসক ও পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী বরাবর স্মারকলিপি জমা দিয়েছেন। ধলেশ্বরী নদী বাঁচাও আন্দোলন কমিটির যুগ্ম
আহবায়ক জাহাঙ্গীর আলম বিশ্বাস বলেন “পানি ছাড়া জীবন বাঁচে না আর পানি না থাকলে নদী বাঁচবে না। নদীতে এখন পানি নাই। নদীতে ধুলা উড়ে। জেলার ওপর দিয়ে প্রবাহিত নদী ও খালের নাব্যতা রক্ষায় নিয়মিত খনন কার্য্যক্রমের দাবী জানাই।

বিশিষ্ট পরিবেশবাদী লেখক সাংবাদিক সাইফুদ্দিন আহমেদ নান্নু বলেন, নদী মাতৃক বাংলাদেশে মানিকগঞ্জে নদীর প্রভাব ছিল বিস্তর। পানি কেন্দ্রিক নদীকে ঘিরেই গড়ে উঠেছিল এ অঞ্চলের কৃষি, অর্থনীতি, কৃষ্টি, সংস্কৃতি ও সভ্যতা। কিন্তু সেই ঐতিহ্য ক্রমশই হয়ে আসছে সংকুচিত। আজ পানির দেশে পানির জন্যই হাহাকার। সমন্বিত নদী ব্যবস্থাপনায় সরকারের মনোযোগ ও কার্যকরী পদক্ষেপে আরো গুরুত্ব দেওয়া জরুরি।

জানা যায়, নাগরপুরের যমুনা থেকে ধলেশ্বরী নদী উৎপত্তি হয়ে ঘিওর ও সাটুরিয়া উপজেলার মাঝ দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। ৬০ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের এ নদীতে বর্ষা ছাড়া বাকি সময় নৌকা চলাচলের মতো পানিও থাকে না। ধলেশ্বরীর শাখা কান্তাবতী, মনলোকহানী, ক্ষীরাই, মন্দা ও ভুবনেশ্বর নদীর এখন আর অস্তিত্ব নেই। নতুন প্রজন্ম এসব নদীর নাম শুধু বই-পুস্তক আর প্রবীণদের মুখে শুনেছে। ২৬ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের পুরাত ধলেশ্বরী নদী মূল যমুনা থেকে শুরু হয়ে ঘিওর উপজেলার জাবরা এলাকায় এসে শেষ হয়। ধলেশ্বরীর আরেকটি শাখা নদী গাজীখালি একসময় গ্রোতস্বিনী থাকলেও বর্তমানে কার্যত মরা নদীতে পরিণত হয়েছে। প্রায় ৫০ কিলোমিটার বিস্তৃত এ নদী বছরের ৮-৯ মাসই পানি শূন্য থাকে। সেই সুযোগে স্থানীয় প্রভাবশালীরা দখল করে নিয়েছে নদীটির বিশাল এলাকা। দৌলতপুরের যমুনা থেকে কালীগঙ্গা নদী উৎপন্ন হয়ে জাবরা কোল ঘেঁষে সিঙ্গাইরের ধল্লা পর্যন্ত এ নদীটির বিস্তৃৃতি। ৭৮ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের কালিগঙ্গার গড় প্রস্থ ২৪২ মিটার। বর্তমানে নৌকা চলার মতো পানিও নেই। চলছে ফসলের চাষাবাদ। পদ্মার শাখা ৯০ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের ইছামতী নদীতে শুধুমাত্র বর্ষা মওসুমে একটা সরু ধারা প্রবাহিত হয়।

নদী ও খাল-বিলেও পানি নেই; জেলেরা বদল করছেন পেশা। ফলে পরিবার নিয়ে তারা দুর্বিষহ জীবনযাপন করছে। জাবরা গ্রামের পরীক্ষিত হালদার বলেন, “নদীতে পানি শুকিয়ে গেছে। পানি নেই, মাছ নেই। বাধ্য হয়ে পূর্বপুরুষদের পেশা বাদ দিয়ে স্বর্ণের দোকানে কাজ করছি।

ঘিওর উপজেলা সিনিয়র মৎস্য কর্মকর্তা মিজানুর রহমান বলেন, নদী পানি শূণ্য হয়ে পড়ায় মাছের উৎপাদন কমেছে ৪৫ ভাগ, হুমকির মুখে জেলেদের জীবন-জীবিকা।

কালীগঙ্গা নদীপারের প্রবীণ ব্যক্তি আবুল কাশেম জানান, ধলেশ্বরী, কালীগঙ্গা ও ইছামতি নদীতে নিয়মিতভাবে স্টীমার, বড় বড় লঞ্চ ও বাণিজ্যিক জাহাজ চলাচল করতে দেখেছেন। ধলেশ্বরী তীরবর্তী কাজলকোড়ী, তিল্লী, জায়গীর, মেঘশিমুল, উকিয়ারা, মানিকগঞ্জ, বেতিলা, বায়ড়া, সিঙ্গাইর, জয়মন্টপ,
পালপাড়া এলাকায় স্টিমার ঘাট ছিল। জাবরা, ঘিওর, তিল্লী, বায়ড়া এবং মানিকগঞ্জ ছিল ব্যস্ত বন্দরনগরী।

জেলা কৃষক সমিতির সাধারন সম্পাদক নজরুল ইসলাম বলেন, এ অঞ্চলের অধিকাংশ চাষি আগে নদী থেকে পানি তুলে জমিতে সেচ দিতেন। নদীগুলো মরে যাওয়ায় ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নেমে গেছে। এতে মারাত্মক সেচ সঙ্কটে পড়েছেন কৃষকরা। এর ফলে কৃষি মৌসুমে উৎপাদন ব্যাহত হওয়ার পাশাপাশি নদীকেন্দ্রিক
ব্যবসা-বাণিজ্যে দেখা দিয়েছে স্থবিরতা।

মানিকগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মোঃ মাঈন উদ্দিন বলেন, নদী খনন ও পুণ:খনন প্রকল্পের আওতায় নদীর নাব্যতা ফিরিয়ে আনতে বেশ কয়েকটি বড় প্রকল্পের কাজ করা হয়েছে। এ ছাড়া আরো খননের জন্য জলবায়ু ট্রাস্ট এবং সংশ্লিষ্ট মন্ত্রনালয় বরাবর কয়েকটি প্রকল্প দাখিল করা হয়েছে।

মানিকগঞ্জ পরিবেশ অধিদফতরের উপ-পরিচালক মো: সাইফুল ইসলাম বলেন, “মানিকগঞ্জে প্রবহমান নদীগুলোর অবস্থা করুন। বেশির ভাগ নদীতেই পানির অভাব। এতে তাপমাত্রা বৃদ্ধি, কৃষি, মৎস্য, জীববৈচিত্রসহ সর্বত্র এর বিরূপ প্রভাব পড়ছে। এভাবে চলতে থাকলে মারাত্মক পরিবেশগত বিপর্যয় ঘটার আশঙ্কা রয়েছে।

Related Articles

Leave a Reply

Back to top button