জাতীয়শিরোনাম

সামাজিক বিড়ম্বনার শিকার করোনায় মৃত লোকের পরিবার

করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে ঢাকার কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান আব্দুর রহিম। এটি তার ছদ্ম নাম। সামাজিক বিড়ম্বনার ভয়ে পরিবারের মানুষেরা তার নাম প্রকাশ করতে চাননি।
রহিমের মৃত্যুর পর জামালপুর শহরের বাসিন্দা ওই পরিবারটি বুঝতে পারে, স্বজনের মৃত্যুই হয়ত সবচেয়ে বড় আঘাত নয়। আব্দুর রহিমের বোন বিবিসিকে বলছিলেন, ২৫ এপ্রিল কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে মারা যান তার বড় ভাই।
এরপর দাফন করার জন্য লাশ যখন জামালপুরে তাদের গ্রামে নিয়ে যান, জানাজা ও মাটি দেয়ার জন্য গ্রামের কেউ আসেনি।
“এমনকি কবর খুঁড়তেও আসেনি কেউ। সবাই ভাবছে এখানে এলে তাদেরও করোনা হবে।
যেহেতু আমাদের পরিবারে আর কোনো পুরুষ সদস্য নেই, তাই তখন আমরা আল মারকাজুলকে ফোন করি। ঘণ্টা দুয়েক পরে তাদের একটি দল এসে জানাজা পড়ে মাটি দেয় আমার ভাইকে।”
রহিমের বোন বলেন, ভাইয়ের কবর হয়ে যাওয়ার পর গ্রামবাসীর অসহযোগিতার আরেক ধরণ দেখতে পান তারা।
“অমানবিক আচরণ করে গ্রামের লোকজন। আমার ভাইয়ের স্ত্রী ও সন্তানদের বাইরে থেকে ঘরে তালা দিয়ে আটকে রাখতে চেয়েছিল তারা। কোনো আত্মীয়স্বজনকে বাড়ির ত্রিসীমায় আসতে দেয়নি।
সাধারণত মৃত মানুষের বাড়িতে খাবার দেয় আত্মীয়স্বজন, আমাদের কেউ খাবার দেয়নি, আর কাউকে খাবার নিয়ে আসতেও দেয়নি।”
“শোকের পরেও মানুষের খেতে হয়। আবার রোজাও শুরু হইছে। তখন বাধ্য হয়ে আমরা নিজেরা প্রতিবেশী কয়েকজনকে বলি কিছু বাজার করে দিতে, তখন তাদেরও হুমকি দেয়া হয় যে কেউ বাজার করে দিলে তাদেরও ঘরে তালা মেরে দেবে।”
এরপর রহিমের বোন এবং স্বামীর হস্তক্ষেপে স্থানীয় প্রশাসন এবং ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান এসে সবাইকে সহনশীল আচরণ করতে আহ্বান জানান।
কিন্তু গত ১১ দিনেও পরিস্থিতির খুব একটা উন্নতি হয়নি, এখনো তাদের পরিবারকে প্রায় ‘একঘরে’ করে রাখা হয়েছে।
“আমার ভাবি বা তাদের বাচ্চাদের কারো করোনাভাইরাসের কোনো উপসর্গ নাই, পরীক্ষা করে তাদের সবার নেগেটিভ আসছে। কিন্তু গ্রামের কেউ সেটা বিশ্বাস করছে না। তাদের সাথে কেউ কথা বলে না। কাছেও আসে না কেউ। কেউ ভাবেনা তাদেরও এই রোগ হতে পারে।”
রহিমের পরিবার এখন শঙ্কায় রয়েছে, সামাজিক রীতি পালন শেষে যখন তারা শহরে ফিরবেন, সেখানে তাদের জন্য কী পরিবেশ অপেক্ষা করছে।
ধর্মীয় রীতিতে দাফন-সৎকার
বাংলাদেশে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে কেউ মারা গেলে, পরিবারের বাকি সদস্যদের নানা গঞ্জনা ও সামাজিক নিগ্রহের শিকার হতে হচ্ছে। জামালপুরের রহিমের পরিবার এখানে একা নন।
নারায়ণগঞ্জে আখড়ার মোড়ের বাসিন্দা অনির্বাণ সাহার বাবা কোভিড-১৯ আক্রান্ত হয়ে মারা যান এপ্রিলের মাঝামাঝি।
ধর্মীয় রীতি অনুযায়ী সৎকারের জন্য অনির্বাণের আত্মীয়দের কেউ আসেননি। তার বাবার বন্ধুদের সহায়তায় অনির্বাণ আর তার মা দুইজন মিলে সৎকারের কাজটি করেছেন।
“যারা করোনাভাইরাস আক্রান্ত হয়, এখানে নারায়ণগঞ্জে কেউ তাদের সহজভাবে নেয় না। আমার বাবার যখন করোনাভাইরাস শনাক্ত হয়, আমাদের বিল্ডিংয়ের দারোয়ান পালিয়ে যায়। আত্মীয়রাও আসেনি।
”বাবাকে দাহ করে যখন আমরা রাতে বাসায় ফিরি, আমাদের বাড়িওয়ালা ফোন করে বলে যেন আমি আর আমার মা ১৪ দিন বাসা থেকে একদমই না বের হই।”
অনির্বাণ বলেছেন, বাড়িওয়ালা বলার আগেই তিনি ও তার মা সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, তারা দুজন ১৪ দিন কোয়ারেন্টিনে থাকবেন। কিন্তু পরবর্তী ১৪ দিনেও ভবনের কেউ এমনকি ফোনেও কোনো খোঁজ নেননি এই পরিবারটির।
অনির্বাণ বলছেন, তাদের বাবা আক্রান্ত হবার পর এবং তার মৃত্যুর পরে আরো একবার তিনি ও তার মায়ের করোনাভাইরাস পরীক্ষা করা হয়েছে, দুইজনেরই নেগেটিভ এসেছে ফলাফল।
“কিন্তু আশেপাশের মানুষের আচরণ দেখলে মনে হয়, আমি ও আমার মা কোন দোষ করেছি। তারা সরাসরি কিছু বলে না, কিন্তু আমাদের যেন দোষীর চোখে দেখে সবাই। যেন আমার বাবা মারা গেছেন এটা আমাদের কোন অপরাধ।”
অনির্বাণ বলছিলেন, “১৪ দিন টানা বাড়িতে থাকার পর যখন আমি বাসা থেকে বের হলাম, দেখলাম চারপাশের মানুষ হঠাৎ সরে যাচ্ছে দুই পাশ থেকে। এখনো বের হলেই দেখি নির্ধারিত সামাজিক দূরত্বের চেয়ে অনেক বেশি দূরে দূরে সরে যায় মানুষ।”
“আমার বাবা মারা গেছে, আমাকে বা আমার মাকে কেউ সান্ত্বনা তো দেয়ই না, উল্টো কেউ কথাও বলে না আমাদের সাথে। জানি না মানুষ কী আগে থেকে এরকম অমানবিকই ছিল, নাকি এখন করোনার কারণে হয়েছে!”
সূত্র : বিবিসি

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button