মো. নজরুল ইসলাম : মধ্য সমতল ভূমির লোকায়ত সংস্কৃতির বহুমুখী সৃজনশীল ধারার সূতিকাগার আমাদের মানিকগঞ্জ জেলা। বৈচিত্রময় ঘটনা প্রবাহ ও বিভিন্ন উৎবসকে কেন্দ্র করে আমাদের দেশের লোকয়াত সংস্কৃতির উদ্ভব ও বিকাশ ঘটেছে। গ্রাম বাংলার সহজ ও সাদা মনের মানুষগুলো তাদের উত্তরসূরীদের কাছে থেকে মুখে মুখে যে জ্ঞান রপ্ত ও প্রয়োগের ধারাকে অব্যাহত রেখেছে তাকেই আমরা সাধারনত লোকায়ত জ্ঞান বলি। এগুলোকে তারা বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন কাজে ব্যাবহার করেছে। যেমন- গানের মধ্যে পুঁিথ,ছড়া,প্রবাদ, প্রবচন, পাচাঁলী,জারি,সারি,মার্সিয়া ইত্যাদি। বাংলা সাহিত্যের মধ্যযুগের পর মুসলিম ঘরনার পীর,ফকির এবং সুফিবাদে বিশ^াসী অনেক লোক-সংস্কৃতির উদ্ভব ঘটেছে। সনাতনী ভাববাদী ধর্মীয় অন্ধবিশ^াসের ভেতর দিয়েই ইসলামী সংস্কৃতির মধ্যেও কিছু আবেগ নির্ভর ভাববাদী ঐশ^রিক চর্চা প্রবেশ করেছে এবং ইহা এখন বাংলার লোক সংস্কৃতির এক বিশাল ভান্ডারে পরিনত হয়েছে। তাদের মধ্যে অন্যতম প্রধান হচ্ছে অনুষ্ঠান হলো মাদার বাঁশ উৎসব।
মো. মোশারফ হোসেন রচিত মানিকগঞ্জের লোক ঐতিহ্য বইয়ের(পৃ: ১৮৬) থেকে জানা যায়-মানিকগঞ্জে মুসলিম পীর,ফকির,সাধু দরবেশ ভিত্তিক অনেক লোক-বিশ^াস ও লোক সংস্কার চালূ রয়েছে। দমের নিয়ন্ত্রনকারি খ্যাত মাদার শাহ ফকির এ বিশ^াসী মানুষদের এরুপ লোক-সংস্কার হলো মাদার বাঁশ। গ্রামীণ জনপদের মানুষ মাদার বাঁশ উৎসবকে ধর্মীয় চেতনার অংশ হিসেবে বিশ^াস করেন। আমাদের এই অঞ্চলে ত্রেয়োদশ শতাব্দি থেকে সপ্তদশ শতাব্দি পর্যন্ত ব্যাপক ভাবে ইসলাম ধর্মের প্রচার ও প্রসার ঘটে। এই সময়ে মধ্য প্রাচ্যের দেশসমুহ থেকে ওলি-আউলিয়াগন বঙ্গদেশে এসে ইসলাম প্রচার করেন। আনুমানিক চতুর্দশ শতাব্দিতে হযরত বদি উদ্দিন শাহ মাদার (র:),(১৩১৫-১৪৩৭ খ্রি:) নামে এক সুফি সাধক ইসলাম প্রচার করতে আমাদের ভারত বর্ষে আগমন করেন। তিনি অসম্ভব অলৌকিক ক্ষমতার অধিকারি ছিলেন। তিনি যে কোন জটিল ও কঠিন রোগের সহজ সমাধান দিতে পারত। যে কোন রোগ বালাই, মুসিবত নিয়ে তার কাছে আসলে সে তদবির দিলে ভালো হইত। কথিত আছে তার চেহারা মোবারক এত সুন্দর ছিলো যে,তাকে দেখা মাত্রই সে পাগল হইত এবং বায়েত গ্রহন করত। অনুমান করা হয় এই মাদার শাহ(র:) বাংলাদেশের মাদারিপুর জেলায় এসেছিলেন। এখানে দরগাখোলা নামক জায়গায় তিনি আস্তানা করেছিলেন। আজও সেই জায়গাটি সনাতন ধর্মীয় অনুসারীদের পবিত্র স্থান হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আছে। মাদারীপুরের হিন্দুরা তাকে গঙ্গা দেবীর পুত্র বলে মনে করতো। এই সাধক মহাপুরুষ ভারতের কামপুরে ইন্তেকাল করেন। এই হলো হযরত বদি উদ্দিন মাদার শাহ (র;) এর সংক্ষিপ্ত পরিচয়।
আন্যদিকে আমাদের দেশের অসংখ্য ভাববাদি ধারার আরেকটি উপশাখার অনুসারীরা মাদার শাহ(র:) কে ভিন্ন ভাবে আবিস্কার করেছেন। মানিকগঞ্জ পৌরসভাধীন সেওতার হানিফ ফকির বলেন-তাদের মতে কথিত শ্বাস প্রশাস নিয়ন্ত্রনকারি অন্য আরেক দমের মাদারকে নিয়ে তার উপর পুঁিথ,গান,জারি,প্রবাদ-প্রবচন ইত্যাদি রচনা করে এবং তারাই প্রকৃত মাদারীয় সম্প্রদায় বলে দাবি করেন। এই সম্প্রদায়ের মানুষ বিশ্বাস করেন যে- মাদার শাহ(র:) মা ফাতেমার অলৌকিক সন্তান ছিলেন। এমনকি হযরত আলী (রা;) ও জানতেন না যে কিভাবে এই মাদার শাহ এর জন্ম হলো বা এর রহস্য কি? একটি জারি গানে এভাবে বলা হয়-” আজগবি হইলো যেমন মাদারের জন্ম,ফাতেমা পাইয়া তারে করিল পালন,ফাতেমা খাশ তনু পালন করতো যারে,মাদারমনি নামটি তার দুনিয়ার পরে। একদিন আশা হাতে তাঁজ মাথে মাদার ঘরে গেল, এমন সময় শের আলীর তাই নজরে পড়িল,শের আলী বলে বিবি শোন সমাচার, তাজ মাথে আশ হাতে এই ছেলেটি কার?
মানিকগঞ্জ সদর উপজেলাধীন ভাটবাউর গ্রামের মাদার শাহ ফকিরের অনুসারী সিকিম আলী পীর সাহেব এর কাছ থেকে জানা যায়-মাদার শাহ ফকির ছিলেন মানব জাতির শ্বাস-প্রশ্বাস নিয়ন্ত্রনকারী মহাসাধক। আমরা যে শ্বাস-প্রশ্বাস নিয়ে বেঁেচ আছি সেটি মাদারের ক্ষমতা বলেই।মাদারীয় সম্প্রদায়ের মধ্যে এইরুপ বদ্ধমূল বিশ^াসকে সমুজ্জ্বল রাখার জন্য এবং তার প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্যই প্রতি বছর মাঘী পূর্নিমার সময় গুরু-ভক্তের সমাবেশ,মাদার বাঁশরর মিছিল,ধামাইল ইত্যাদি অনুষ্ঠানের আয়োজন করে থাকে।
মানিকগঞ্জ সদর উপজেলাধীন পুটাইল গ্রামের ছমির উদ্দিন দেওয়ান বলেন- মাদার বাঁশ প্রস্তুতের সময় কিছু নিয়ম নীতি মানতে হয়। যেমন- বাঁশ কাটার সময় পাক পবিত্র হয়ে জয় মাদার নামের ধ্বনি দিয়ে বাদ্য – বাজনা বাঁিজয়ে দম বন্ধ করে এককোপে বাঁশ কাটতে হয়। সাধারন নলী বাশ ব্যবহৃত হয়ে থাকে। বাঁশ কাটার পর সাইজ করে সেগুলোকে গোসল করাতে হয়। তারপর দুধ ও হলুদবাটা মিশিয়ে বাঁেশর সৌন্দর্য্য বৃদ্ব্যি করা হয়। তারপর লাল ও সাদা কাপর দিয়ে বাঁশগুলো মোড়ানো হয়। তারপর বাঁশের আগ মাথায় ’চামড়’(এক ধরনের লোমাকৃত বস্তু)যুক্ত করা হয়। এই ভাবে মাদার বাঁশ প্রস্তুত করা হয়। তারপর শুরু হয় মাদার বাঁশ ঘুরানোর কাজ। সারিবদ্ধভাবে মাদার ভক্তরা বাঁশ কাঁেধ নিয়ে গ্রামের বিভিন্ন পথে ঘাটে চলার দৃশ্য আসলেই অসাধারন ও চমতকার, মনোমুগ্ধকর উপভোগ্য বিষয়। ১০/১২ ফুটের লম্বা বাঁেশর মাথায় ’ চামট’ লাগিয়ে ভক্তবৃন্দরা সারিবদ্ধভাবে গ্রামে গ্রামে বাড়িতে বাড়িতে গিয়ে চাল,ডালসহ মানতের টাকা পয়সা সংগ্রহ করেন এবং সাথে জারি গান করেন। মাদারের এই জারিগানকে অনেকে ’নইল্যা’ গান বলে অভিহিত করে থাকে। মাদার ভক্তদের পরিবেশিত জারি গ্রামের আপামর জনসাধারন বিশেষ করে
কৃষক-কৃষাণী, বউ-ঝিসহ সকল শ্রেণী পেশার মানুষ দারুন উপভোগ করেন। তাছারা আয়োজকেরা বাড়িতে এই মাদার বাঁশ উতসবকে কেন্দ্র করে জারি,সারি, কবি,গাজীর ও বাউল গানসহ বৈচিত্রময় অনুষ্ঠানের আয়োজন করে থাকে। মাদার শাহ এর উপর ভিত্তি করেই রচিত বিভিন্ন ধরনের জারি গান যেমন-’মুখে মাদার মাদার বল সবে মাদার মস্ত পীর, দিল কুরআন খুলিয়া দেখ মাদার শাহ ফকির, মুখে বলরে মাদার মাদার”…লক্ষী জীবেরই পরান, লক্ষীর চরণ করলাম সার, লক্ষীকে নারায়ণ ঠাকুর করেছিলো বিয়া, তাই লোকে তাকে ডাকে গদাধর বলিয়া”… উল্লেখিত জারিসহ আরো হরেক রকমের জারি সারি গান বাড়িতে বাড়ীতে গিয়ে গাওয়া হইত।
বিশিষ্ঠ উন্নয়ণকর্মী ও সাবেক ইউপি সদস্য গাজী শাহাদত হোসেন বাদল বলেন- আজ পূজিবাদী অর্থব্যাবস্থার দাপটে গ্রামীণ সমাজের আধুনিক পরিবর্তনের নামে অপসংস্কৃতি দানা বেঁেধ উঠছে আর পক্ষান্তরে এইসব গানগুলো ক্রমান্বয়ে বিস্মৃতির অতল গহব্বরে হরিয়ে যাচ্ছে। তিনি আরো বলেন- আমরা ছোট বেলায় ঢাকার নবাবগঞ্জের নুরুল্যাপুরে মাদার বাঁেশর সবচেয়ে বড় অনুষ্ঠান দেখেছি। এছারাও মানিকগঞ্জের কয়রা,ছোট ভাটবাউর, পুটাইল, সেওতা, সাটুরিয়ার শিমুলিয়াসহ হরিরামপুরের বিভিন্ন স্থানে এই অনুষ্ঠান হয়। বাঁশ ঘুরানোর পর মাঘি পূর্নিমার রাতে ”তেঁতুল গাছের চলা দিয়ে আগুন জ¦ালিয়ে আগুনের কুন্ডলী তৈরী করা হইত। ভক্তবৃন্দ ঐ আগুনের কুন্ডলীতে পা রাখে এবং পাদুলী চক্করী দিয়ে নিভিয়ে ফেলে” মানুষ এগুলো দেখে বিস্মীত হয়। জলন্ত অগ্নিকান্ডের মধ্যে দিয়ে এইরুপ হেটে যাওয়াকে বলে ’ধামাইল’। ধামাইল শেষে পরের দিন মাদারের বাঁশগুলো আবার গোসল করানো হয় এবং গোসল
শেষে বিসর্জন দেয়া হয়। এই বিসর্জন পর্বের মধ্যে দিয়েই মাদার বাঁশ অনুষ্ঠানের সমাপনি ঘটে। মাদার অনুসারী জনমানুষ মাদার বাঁশ উতসবকে ধর্মীয় সংস্কৃতির অংশ মনে করলেও গ্রামীন লোকায়ত সংস্কৃতির এটি যে একটি বিশাল ভান্ডার ও সম্মৃদ্ধশালী উপাদন এতে কোন সন্দেহ নেই। এই আয়োজনের মাধ্যমে জাতি ধর্ম,বর্ণ নির্বিশেষে অসাম্প্রদায়িক চেতনা নিয়ে সামাজিক যে বন্ধন তৈরী হয় তাকে আমরা বহুত্ববাদ বলতে পারি।তই নতুন প্রজন্মের মাঝে এই চর্চাগুলো টিকে থাকা দরকার এবং এ্ধসঢ়;ই ধরনের কৃষ্টি ও সংস্কৃতিই পারবে আগামীদিনে একটি নারীবান্ধব সামাজিক ন্যায্যতার সমাজ প্রতিষ্ঠা করতে।