বাংলাদেশের ফ্রাঞ্চাইজ টি-টোয়েন্টি ক্রিকেট টুর্নামেন্ট বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগ শুরু হচ্ছে আগামীকাল থেকে। ২০১২ সাল থেকে এই টুর্নামেন্ট হয়ে আসছে, যদিও নিয়মিত নয়, মাঝেমধ্যেই বিরতি পড়েছে।
ফ্রাঞ্চাইজিগুলোও অনিয়মিত, মালিকানায় পরিবর্তন এসেছে বেশ কয়েকবার।
এমনকি কোনো ক্রিকেটারও দীর্ঘদিন একই দলের হয়ে খেলেননি, যেমনটা দেখা গেছে ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগে ব্যাঙ্গালোরে বিরাট কোহলি, চেন্নাইয়ে এম এস ধোনি।
তবুও এটিই বাংলাদেশের একমাত্র টি-টোয়েন্টি টুর্নামেন্ট যেখানে টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটের জন্য ক্রিকেটার যাচাই করা যায়, ঘরোয়া ক্রিকেটাররা কিছু অর্থ উপার্জন করতে পারেন এবং বাংলাদেশের ক্রিকেট সমর্থকরা মাঠে বসে কিছু বিদেশি ক্রিকেটারদের খেলা উপভোগ করতে পারেন।
চট্টগ্রামের দলে গতবারের বিবাদের ছাপ স্পষ্ট
বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগে এখন পর্যন্ত চট্টগ্রাম শিরোপা জেতেনি কিন্তু প্রতিবারই আশাব্যঞ্জক দল নিয়ে মাঠে নামে। চট্টগ্রাম চ্যালেঞ্জার্স গতবারও আশা দেখিয়েছিল কিন্তু শেষ পর্যন্ত শক্তির প্রদর্শনী দেখাতে পারেনি।
বাংলাদেশ জাতীয় দলে খেলা নাসুম আহমেদ ও মেহেদী হাসান মিরাজের সাথে প্রকাশ্য বিবাদে জড়িয়েছিল ফ্রাঞ্চাইজি। এই বিবাদের ছাপ এবারের দলে স্পষ্ট। দেশি বা বিদেশী কোনো তারকা ক্রিকেটার নেই চট্টগ্রাম দলে।
আপাতত বাংলাদেশ জাতীয় দলের তরুণ ক্রিকেটার আফিফ হোসেনকেই মানা হচ্ছে দলের সবচেয়ে বড় নাম। এছাড়া আছেন অভিজ্ঞ ক্রিকেটার শুভাগত হোম, তিনি এবার অধিনায়কত্ব করবেন চট্টগ্রাম চ্যালেঞ্জার্সের। ইরফান শুক্কুর, মেহেদী মারুফের মতো ঘরোয়া ক্রিকেটে পরিচিত নাম আছেন।
তবে এই দলটাকে ইতিবাচক ফল এনে দিতে পারেন আয়ারল্যান্ডের কার্টিস ক্যামফার, টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে তিনি ঝড়ো ইনিংস খেলে নিজের সামর্থ্যের প্রমাণ দিয়েছিলেন।
পাকিস্তানের ফাস্ট বোলার শাহনেওয়াজ দাহানিকে পেলে দলটির বোলিংও খানিকটা শক্তি পাবে। স্পিন নির্ভর কন্ডিশনের জন্য আছেন তাইজুল ইসলাম, যিনি বাংলাদেশের টেস্ট দলের গুরুত্বপূর্ণ একজন সদস্য।
এছাড়া আছেন মেহেদী হাসান রানা, এই বা-হাতি ফাস্ট বোলার গত মৌসুমে ১৮ উইকেট নিয়েছিলেন।
সিলেট স্ট্রাইকার্সে আছেন মাশরাফি আর মুশফিক
সিলেট এবারে স্ট্রাইকার্স নাম নিয়ে এসেছে বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগে। এই টুর্নামেন্টের ইতিহাসেই সবচেয়ে ব্যর্থ দল বলা যায় সিলেটকে। এই ব্যর্থ দলে এসেছেন এবার বিপিএলের সফলতম অধিনায়ক মাশরাফী বিন মর্তুজা। তবে তিনি সর্বশেষ কোনো পেশাদার ক্রিকেট খেলেছেন গত বছরের এপ্রিল মাসে।
বাংলাদেশ জাতীয় সংসদের সদস্য মাশরাফী এবং আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টি ক্রিকেট থেকে অবসর নেয়া মুশফিক সিলেটের বড় নাম। মুশফিকুর রহিম আর সিলেটের একটা মিল রয়েছে, ব্যক্তি হিসেবে মুশফিক এবং দল হিসেবে সিলেট এখনও বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগ শিরোপা জেতেনি।
সিলেট স্ট্রাইকার্সের কোচ রাজিন সালেহ সিলেটেরই ক্রিকেটার। বাংলাদেশ জাতীয় দলের হয়ে খেলেছেন দীর্ঘদিন। সিলেট স্ট্রাইকার্সের মূল শক্তি দুই পাকিস্তানি ক্রিকেটার মোহাম্মদ হারিস ও মোহাম্মদ আমির। যাদের পুরোটা সময় পাবে না দলটি।
গতবারের বরিশালের মতো করে, সিলেট এবারে অলরাউন্ডার রেখেছে টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটারের চাহিদা পূরণ করতে। ইমাদ ওয়াসিম আছেন, আছেন থিসারা পেরেরা, ধনঞ্জয়া ডি সিলভা এবং জিম্বাবুয়ের রায়ান বার্ল। টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে নজরকাড়া কলিন অ্যাকারম্যান আছেন এই দলে।
ঢাকার মাঠে বরিশালের শক্তি স্পিন
ফরচুন বরিশাল গত মৌসুমেই বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগের সবচেয়ে শক্তিশালী দলগুলোর একটি ছিল। ফাইনালে হারলেও, শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত দাপুটে ক্রিকেট খেলেছে দলটি। এই দলটির মূল শক্তির জায়গা ছিল স্পিন বোলিং।
অধিনায়ক সাকিব আল হাসান তো আছেনই। সাথে মুজিবর রহমান ছিলেন, এই দুজনের ৮ ওভারে ৪০ রান তোলাও কঠিন হয়ে গিয়েছিল প্রতিপক্ষের জন্য। এবার সাকিবের সাথে আছেন ইন-ফর্ম মেহেদী হাসান মিরাজ এবং রাহখিম কর্নওয়াল। বাংলাদেশের ঘরোয়া লিগের সানজামুল ইসলাম আছেন।
এছাড়া বিকল্প হিসেবে মাহমুদুল্লাহ রিয়াদ এবং শ্রীলঙ্কার চতুরঙ্গ ডি সিলভাকেও ব্যবহার করতে পারে টিম ম্যানেজমেন্ট। বরিশালের মূল লক্ষ্য অলরাউন্ডার ভিত্তিক দল গড়া, গত মৌসুমেও বরিশাল উইকেটরক্ষক বাদে দশজন অলরাউন্ডার নিয়ে দল সাজিয়েছিল।
এবার অবশ্য খানিকটা দুর্বল দল নিয়েই বিপিএলে ঢুকছে বরিশালের এই ফ্রাঞ্চাইজ। কিন্তু দলের বড় শক্তি অধিনায়ক সাকিব। সম্প্রতি একটি জরিপে বাংলাদেশের সর্বকালের সেরা অ্যাথলিটের পুরস্কার পাওয়া সাকিব, বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগের সফলতম ক্রিকেটারও বটে।
এখন পর্যন্ত আট মৌসুমে চারবার টুর্নামেন্টের সেরা ক্রিকেটারের পুরস্কার পেয়েছেন সাকিব আল হাসান। সাকিবের সাথে আছেন মেহেদী হাসান মিরাজ, যিনি ভারতের বিপক্ষে ওয়ানডে সিরিজে দুর্দান্ত সেঞ্চুরি করেছেন।
শেষদিকের ব্যাটসম্যানদের সাথে জুটি গড়ে ম্যাচ জিতিয়েছেন, বল হাতে ভূমিকা রেখেছেন এবং সিরিজ জেতানোয় মূল ভূমিকা রেখে ম্যান অফ দা সিরিজের পুরস্কার জিতেছেন।
ঢাকা ডমিনেটরসের বড় নাম কারা?
আপাতত ঢাকা ডমিনেটরসের সবচেয়ে বড় নাম মনে হচ্ছে চামিন্ডা ভাসকে। শ্রীলঙ্কার সাবেক এই ফাস্ট বোলার এই দলটির কোচের দায়িত্বে আছেন।
তার সাথে কাজ করতে পেরে নিজের আনন্দের কথা জানিয়েছেন বাংলাদেশের ফাস্ট বোলার তাসকিন আহমেদ। চোটের সমস্যাটুকু বাদ দিলে তাসকিন সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশের সেরা ফাস্ট বোলার। তার সাথে আছেন শরীফুল ইসলাম ও আল আমিন। এই ফাস্ট বোলাররাই ঢাকার মূল শক্তি। এছাড়া আছেন চামিকা করুনারত্নে।
বাংলাদেশের ঘরোয়া ক্রিকেটের পরিচিত নাম অলক কাপালি, মুক্তার আলীরা আছেন স্কোয়াডে। পাকিস্তানের শান মাসুদ হতে পারেন ভরসার জায়গা, যিনি টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে পাকিস্তানের ব্যাটিং লাইনআপে ভ্যালু অ্যাড করেছিলেন।
সৌম্য সরকারের জন্য এই টুর্নামেন্ট একটা বড় সুযোগ হতে পারে আরো একবার নিজের সামর্থ্যের সাথে পারফরম্যান্সের প্রমাণ দেয়ার। এছাড়া আছেন মোহাম্মদ মিথুন ও নাসির হোসেন।
খুলনায় আছেন বিপিএল স্পেশাল খালেদ মাহমুদ সুজন
ঢাকার মতো খুলনারও বড় শক্তির জায়গা কোচ। খালেদ মাহমুদ সুজন, বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগের পরিচিত নাম এবং সফল একজন কোচ।
এই দলের সবচেয়ে বড় তারকা তামিম ইকবাল। কোচ খালেদ মাহমুদ সুজন বলেন, তামিম ইকবাল শুধুমাত্র দলটির প্রধান ক্রিকেটারই নন, দল নির্বাচন থেকে শুরু করে টিম ম্যানেজমেন্টের গুরুত্বপূর্ণ সদস্যও তিনি।
খুলনা এবারের আসরের সবচেয়ে শক্তিশালী দলগুলোর একটি, অন্তত স্কোয়াড অনুযায়ী। পাঁচজন পাকিস্তানি ক্রিকেটার আছেন স্কোয়াডে, নাসিম শাহ, ফখর জামান, ওয়াহাব রিয়াজ।বড় ভূমিকা রাখতে পারেন আজম খান, পাকিস্তান সুপার লিগে মারকুটে ব্যাটিং দিয়ে নজর কেড়েছেন তিনি। এছাড়া আছেন শারজিল খান।
তবে খুলনা যদি প্লে অফে খেলে তারা শেষ পর্যন্ত থাকতে পারবেন না। শ্রীলঙ্কার আভিস্কা ফার্নান্দো আছেন। স্পিন সেক্টরে আছেন বাংলাদেশের সাম্প্রতিক সময়ে সবচেয়ে সফল টি-টোয়েন্টি বোলারদের একজন নাসুম আহমেদ। গত মৌসুমে চমক দেখানো নাহিদুল ইসলাম আছেন দলে।
এছাড়া কোচ খালেদ মাহমুদ সুজন বলেন, বাংলাদেশ জাতীয় দলে খেলা সাইফুদ্দিন ও ইয়াসির আলীর ওপর ভরসা রাখবে টিম ম্যানেজমেন্ট।
রংপুর রাইডার্স- পেশাদার ম্যানেজমেন্ট এবং ভালো স্কোয়াড
রংপুর রাইডার্সের আছে নিজস্ব অনুশীলন মাঠ এবং ভিন্ন ঘরানার ম্যানেজমেন্ট, যারা এখন পর্যন্ত বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের পেশাদারিত্ব বজায় রাখার চেষ্টা করছে।
টুর্নামেন্টের একবারের চ্যাম্পিয়ন এই দলটি গত মৌসুমে ছিল না। এবারে শক্তিশালী এক পেস বোলিং আক্রমণ নিয়ে বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগে এসেছে দলটি। পাকিস্তানের হারিস রউফ, বাংলাদেশের হাসান মাহমুদ থাকছেন আক্রমণের মূলভাগে।
পাকিস্তানের টি-টোয়েন্টি দলের গুরুত্বপূর্ণ সদস্য মোহাম্মদ নাওয়াজ আছেন, শোয়েব মালিক আছেন। জিম্বাবুয়ের তারকা ক্রিকেটার সিকান্দার রাজা পুরো মৌসুমের জন্যই রংপুরের হয়ে খেলবেন।
এই দলটির নেতৃত্ব দেবেন বাংলাদেশের নুরুল হাসান সোহান। এছাড়া আছেন শেখ মেহেদী হাসান, নাইম শেখ।
আরো একবার কুমিল্লা ‘ভিক্টোরিয়ান্স’ হতে পারবে?
বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগের বর্তমান চ্যাম্পিয়ন কুমিল্লা। এই নিয়ে মোট তিনবার এই শিরোপা জিতেছে এই ফ্রাঞ্চাইজি। কুমিল্লা ভিক্টোরিয়ান্স বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগের ১১ বছরের ইতিহাসে সবচেয়ে নিয়মিত দল।
যদিও শুরু থেকে দলটি ছিল না। কিন্তু মাঠে নামার পর থেকে জার্সি, লোগো, স্লোগান থেকে শুরু করে নির্দিষ্ট সমর্থক গোষ্ঠী তৈরিতে নিয়োজিত ছিল কুমিল্লা ভিক্টোরিয়ান্স কর্তৃপক্ষ।
এবারো শক্তিশালী দল গঠন করেছে। বাংলাদেশের লিটন কুমার দাশ, ইমরুল কায়েস, মোসাদ্দেক হোসেন সৈকত ও মুস্তাফিজুর রহমানের মতো তারকা ক্রিকেটাররা আছেন এই স্কোয়াডে।
সৈকতের সাথে অলরাউন্ডার ভূমিকায় আছেন আফগানিস্তানের মোহাম্মদ নবী, পাকিস্তানের বড় তারকা শাদাব খান এবং জিম্বাবুয়ের শন উইলিয়ামস। আরো আছেন পাকিস্তানের মোহাম্মদ রিজওয়ান।
যদিও রিজওয়ান ও শাদাব খানিকটা দেরিতে আসবেন বাংলাদেশে। তবে নবী শুরু থেকেই থাকবেন কুমিল্লার সাথে। এছাড়া আছেন ইংল্যান্ডের হয়ে আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টির সবচেয়ে সফল ব্যাটসম্যানদের একজন দাউদ মালান।
সূত্র : বিবিসি