
নাসিম উদ্দীন নাসিম, নাটোর থেকে : অর্ধবঙ্গেশ্বরী মহারানী ভবানী ও রাজা রাজণ্যের স্মৃতিধন্য বনলতা সেনের নাটোরে স্বাধীনতার অনেক আগে থেকেই বিভিন্ন সময় রাজনৈতিক ও সাংগঠনিক কাজে আসা-যাওয়া ছিল জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের। এখানে ছিল তার অনেক পছন্দের রাজনৈতিক সহকর্মী। নাটোর হয়ে উঠেছিলো তার পছন্দ আর ভালোলাগার একটি জায়গা। সে কারণেই নাটোরসহ উত্তরবঙ্গের উন্নয়নের স্বপ্ন দেখতেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। আর এ কাজকে ত্বরান্বিত করার জন্য তিনি নাটোরকে করতে চেয়েছিলেন উত্তরবঙ্গের প্রাণকেন্দ্র। তিনি সব সময়ই বলতেন নাটোর হবে দেশের দ্বিতীয় রাজধানী। সে লক্ষ্যে, ১৯৭২ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নাটোর দিঘাপতিয়া রাজবাড়িকে উত্তরা গণভবন নামকরণ করেন। এর একমাস পর বঙ্গবন্ধু উত্তরা গণভবনের মূল প্রাসাদের ভেতরে মন্ত্রীসভার একটি বৈঠকও করেন। এ বিষয়ে বৈঠক ও আলোচনাও করেছিলেন বঙ্গবন্ধু। প্রধানমন্ত্রীর উত্তরাঞ্চলীয় বাসভবন খ্যাত নাটোরের উত্তরা গণভবনে এ বিষয়ে প্রকাশ্য প্রতিশ্রুতিও দিয়েছিলেন তিনি। তবে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সপরিবারে নিহত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে উন্নয়নবঞ্চিত জনপদে পরিণত হয় নাটোর। সেই কথা আজও ভুলতে পারেনি নাটোরের প্রবীণ আওয়ামী লীগ নেতাকর্মী ও তাদের পরিবারের সদস্যসহ নাটোরের আপামর জনগণ। সর্বশেষ ১৯৯৬ সালে উত্তরা গণভবনে মন্ত্রীপরিষদের বৈঠক হয়। সেই থেকেই উত্তরা গণভবন ঢাকার বাহিরে প্রধানমন্ত্রীর দ্বিতীয় বাসভবন হিসেবে পরিচিতি লাভ করে। ১৯৭৪ সালে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, শেখ রাসেল, সজিব ওয়াজেদ জয়, সায়মা ওয়াজেদ পুতুলসহ এই গণভবনে সফরে আসেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। জানা যায়, নাটোর ছিল বঙ্গবন্ধুর অনেক পছন্দের জায়গা। নাটোরকে নিয়ে উন্নয়নের স্বপ্ন দেখতেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তিনি নাটোরকে উত্তরবঙ্গের প্রাণকেন্দ্র করতে চেয়েছিলেন। দেশের দ্বিতীয় রাজধানী করার স্বপ্নও দেখেছিলেন তিনি। নাটোরের স্থানীয় রাজনীতিকেও বঙ্গবন্ধু গুরুত্বের সঙ্গে দেখেছেন। বঙ্গবন্ধু ১৯৭২ সালে উত্তরা গণভবনে সফরকালে
রাজবাড়ি চত্ত্বরে একটি হৈমন্তী গাছ রোপন করেছিলেন। ১৯৬৪ সালের ৮ মে নাটোর মহকুমা আওয়ামী লীগের কর্মী সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এ সম্মেলনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রধান অতিথি ছিলেন। শুধু তিনি একাই নন, ওই সময়ের আওয়ামী লীগের খ্যাতনামা নেতাদেরকেও তিনি নাটোরে উপস্থিত করেছিলেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছাড়াও সম্মেলনে ছিলেন মওলানা আবদুর রশিদ তর্কবাগীশ, মতিয়ার রহমান কামরুজ্জামানসহ অনেকে। বঙ্গবন্ধু কর্তৃক উত্তরা গণভবন নামকরণের ৫০ বছর পূর্তি হয়ে গেলেও অধরাও থেকে গেল দ্বিতীয় রাজধানী বাস্তবায়নের স্বপ্ন ।
নাটোর জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সহ-সভাপতি ও নাটোর পৌর মেয়র উমা চৌধুরী জলি জানান, বঙ্গবন্ধুর কিছু প্রিয় মানুষ ছিলেন নাটোরে। তাদের টানে তিনি প্রায়ই ছুটে আসতেন। তাদের একজন ছিল আমার বাবা শংকর গোবিন্দ চৌধুরী। বঙ্গবন্ধু তাকে গভর্নর নিযুক্ত করেছিলেন। নাটোরে তার প্রিয় ব্যক্তিত্বদের মধ্যে ছিলেন সাবেক এমপি মরহুম সাইফুল ইসলাম, সাবেক যুবলীগ নেতা মুজিবুর রহমান রেজা, সাবেক ছাত্রলীগ নেতা মজিবর রহমান সেন্টু, আওয়ামী লীগের রমজান আলী প্রাংসহ অনেকে।
একদিনের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে উমা চৌধুরী বলেন, ১৯৭১ সালে দেশ স্বাধীনের পর বঙ্গবন্ধু আসেন উত্তরা গণভবনে। এসময় বাবা প্রয়াত শংকর গোবিন্দ চৌধুরী তার কাছে যান। সেখানে বঙ্গবন্ধু বাবাকে নিয়ে একাকী হাঁটতে হাঁটতে বিভিন্ন রাজনৈতিক ও রাষ্ট্রীয় বিষয় নিয়ে আলাপ আলোচনা করতে থাকেন। কিছুক্ষণ পর স্থানীয় আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ও ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা উপস্থিত হন উত্তরা গণভবনে। এ সময় এক বক্তব্যে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেছিলেন, নাটোর হবে উত্তরবঙ্গের উন্নয়নের প্রাণকেন্দ্র। এসময় তিনি নাটোরে একটি পূর্ণাঙ্গ টিভি সম্প্রচার কেন্দ্র স্থাপনের ঘোষণা দেন। এর কয়েকদিন পরেই নাটোর হরিশপুর ওয়াপদা মাঠে জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। সেখানেও বঙ্গবন্ধু নাটোরকে কেন্দ্র করে উত্তরবঙ্গের উন্নয়ন নিয়ে নানা কর্মসূচি ঘোষণা করেন। বঙ্গবন্ধু বেঁচে থাকলে পূর্ণাঙ্গ টিভি স্টেশনসহ উত্তরবঙ্গের উন্নয়নের প্রাণকেন্দ্র হতো নাটোর, এমন দাবি করেন উমা চৌধুরী জলি।
তৎকালীন জেলা ছাত্রলীগের নেতা বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল কাইয়ুম জানান, ১৯৭১ সালে জাতির পিতার আগমনের সময় গণভবনে তিনি উপস্থিত ছিলেন। এসময় নাটোরকে উত্তরবঙ্গের প্রাণকেন্দ্র হিসেবে ঘোষণা করেছিলেন বঙ্গবন্ধু। এসময় তিনি আরও ঘোষণা করেন, এজন্য নাটোরে একটি পূর্ণাঙ্গ টিভি স্টেশন স্থাপনসহ সার্বিক উন্নয়নের প্রতিশ্র“তিও দিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বঙ্গবন্ধু বেঁচে থাকলে নাটোর সত্যি সত্যি দেশের দ্বিতীয় রাজধানী হতো বলে মন্তব্য করেন তিনি।
নাটোরের জেলা প্রশাসক মো.শামীম আহমেদ জানান, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭২ সালে ৯ ফেব্রুয়ারি দীঘাপতিয়া রাজবাড়িকে ‘উত্তরা গণভবন’ নামকরণ করেন। এরপর থেকেই গণভবনটি গুরুত্বপূর্ণ স্থানে মর্যাদা পায়। তার স্মৃতিবিজাড়িত স্থানে আবারো ছোট আকারে হলেও যেন একটি মন্ত্রীপরিষদের বৈঠক করা যায়, সেজন্য জেলা প্রশাসক হিসেবে সরকারের কাছে আবেদন জানাবো।
জানা যায়, এই গণভবনটি ৪২ একর জায়গা জুড়ে অবস্থিত। নাটোরের রানী ভবানী তার নায়েব দয়ারামের উপরে সন্তুষ্ট হয়ে দিঘাপতিয়া পরগনা উপহার দেন। দিঘাপতিয়া রাজবংশের ও জমিদারীর গোড়াপত্তন ১৭৬০ সালে হয় রাজা দয়ারামের হাত ধরে। বিশালাকার এ রাজবাড়িতে রয়েছে দিঘী, বাগান, ইটালিয়ান গার্ডেন, চিড়িয়াখানা, নতুন সংগ্রহশালাসহ দেশ-বিদেশের হরেক ও বাহারি রকমের গাছের মেলা। পুরো গণভবনের চারপাশে উচু দেওয়ালে ঘেরা। নাটোর শহর থেকে প্রায় ৩ কিলোমিটার উত্তরে ইতিহাসখ্যাত দিঘাপতিয়া রাজবাড়ি তথা উত্তরা গণভবন অবস্থিত। বর্তমানে এ গণভবন জনপ্রিয় এক পর্যটনকেন্দ্র হিসেবে খ্যাতি পেয়েছে। এ বছরই বঙ্গবন্ধু ঘোষিত ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার স্মৃতিবিজড়িত উত্তরা গণভবনের নামকরণের ৫০ বছর পূর্ণ হলো। এ উপলক্ষে আবারও উত্তরা গণভবনে মন্ত্রিপরিষদের বৈঠক আয়োজনের জন্য দাবি জানিয়েছেন নাটোরবাসী।
নাটোর-নওগাঁ সংরক্ষিত নারী আসনের সংসদ সদস্য রতœা আহমেদ জানান, বঙ্গবন্ধু বেঁচে থাকলে নাটোর হতো সমৃদ্ধ নগরী। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার মধ্য দিয়ে দুষ্কৃতকারীরা শুধুমাত্র বঙ্গবন্ধু পরিবার ও আওয়ামী লীগের ক্ষতি করেনি। ক্ষতি করেছে নাটোরের অগ্রযাত্রার। নাটোরের চলনবিল এবং অবকাঠামোসহ সার্বিক উন্নয়ন পরিকল্পনা, উত্তরা গণভবনকে কেন্দ্র করে নাটোরকে পর্যটন নগরী হিসেবে গড়ে তোলা এবং নাটোরকে কেন্দ্র করে পুরো উত্তরবঙ্গের উন্নয়নের চিন্তা ছিল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নকে বাস্তবায়নের কাজ করছেন। তিনি দেশের সার্বিক উন্নয়নের পাশাপাশি বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের নাটোর গড়তেও ভূমিকা পালন করছেন।