শিরোনাম

‘ও বাবাজি’ আমাগো নামডা লেইখ্যা কিছু চাইল দেও

আব্দুর রাজ্জাক, মানিকগঞ্জ: আমতলী বাজারের এক কোনে বসে কাঁদছেন ৭০ বছরের বৃদ্ধা ফিরোজা বেওয়া। পাশ্ববর্তী জিয়নপুর এলাকার বাসিন্দা ছিলেন তিনি। একসময় ছিল বেশ সম্পদশালী। ছিল বাড়ি-ঘর, সুখের সংসার। এই মানুষটি নদীর ভাঙনে ৫ বার বাড়িঘর হারিয়েছেন। স্বামী মফিজ উদ্দিন মারা গেছেন প্রায় ২০ বছর আগে। একমাত্র ছেলে আজিজও দূর্ঘটনায় মারা যান ৬ বছর আগে। ছেলের ঘরে এক ছেলে ও এক মেয়েকে নিয়ে বিধবা ফিরোজা বেওয়া মানবেতর জীবনযাপন করছেন। বন্যায় মাথা গোঁজার ঠাঁইটুকু পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় বাঁধের ওপর বসবাস করছেন নাতি, নাতনি ও ছেলের বিধবা স্ত্রীকে নিয়ে। শুধু বললেন, ‘বাজান ঘরে চাইল নাই। হুনছি (শুনছি) এইহানে চাইল দিবো। তুমি একটু কইয়া দিলে আমারে কয়ডা চাইল দিতো। আমার নামডা নিয়া একটু চাইল দেয়ার ব্যবস্থা কইরা দেও।
রাহেলা বেগমের শেষ সম্বল ছিল স্বামীর রেখে যাওয়া ভিটামাটি ও একটি একচালা টিনের ঘর। সেই সম্বলটুকুও কেড়ে নিল বানের পানি। স্বামী মারা গেছে প্রায় এক যুগ। দুই সন্তান নিয়ে অনেক কষ্টেই চলতো তার সংসার। এখন সম্বল মাত্র ১০ কেজি ত্রাণের চাল। মানিকগঞ্জের দৌলতপুর উপজেলার আবুডাঙ্গা গ্রামের বাসিন্দা রাহেলা বেগমের ঠাঁই হয়েছে স্থানীয় বাঁধে। বাঁধে, স্থানীয় বিদ্যালয়ে পলিথিনের ডেরায় বাস করছে এমন আরো কয়েকশ পরিবার। সবকিছু হারিয়ে পাথর হয়ে গেছেন এই মানুষগুলো। শুধু বারবার তাকিয়ে দেখছেন চোখের পলকে হারিয়ে যাওয়া ভিটামাটি। ফেলছেন চোখের পানি। বৃষ্টিতে ভিজে ত্রাণের চাল রান্না করতে হাঁড়ি-পাতিল ও চুলা নিতে হচ্ছে অন্য আশ্রিতদের কাছ থেকে। সে রান্না করার জায়গাটুকুও নেই। রান্না করতে হচ্ছে রাস্তার ওপর।
চারদিকে অথই পানি। ছোট একটি নৌকায় চুলা জ্বালিয়ে রান্না করছেন ঘিওর উপজেলার আশাপুর গ্রামের রাশেদা বেগম নামে এক গ্রহবধূ। স্বামী মফজেল মিয়া ব্যস্ত ছোট্ট শিশুকন্যা নিয়ে। দিন-রাত সব সময়ই তাদের চোখে চোখে রাখতে হয়। কারণ চতুর্দিকে বন্যার পানি। যেকোনো সময় একটা অঘটন ঘটে যেতে পারে। রাশেদা বেগম জানান, বাড়িতে পানি উঠে যাওয়ায় কোনো উপায় না পেয়ে নৌকায় তিনি সংসার পেতেছেন। এখন পর্যন্ত কোনো ধরনের সাহায্য-সহযোগিতা পাননি তারা। তাদের মতো আরো অনেক পরিবারই নৌকায় ঠাঁই নিয়েছে। কেউ কেউ ঘরের চালায় আবার কারো ঠাঁই হয়েছে স্কুলের আশ্রয়কেন্দ্রে।
‘ও বাবাজি, আমাগো নামডা একটু লেইখ্যা নেও। পানিতে বাড়িঘর সব তলাইয়া গেছে। চেয়ারম্যান-মেম্বাররা কেউ খোঁজখবরও নেয় নাই। আমাগো নাম লেইখ্যা নিয়্যা কিছু চাইল দেও।’ কথাগুলো মানিকগঞ্জের যমুনা নদীবেষ্টিত তেওতা ইউনিয়নের জাফরগঞ্জের রাজগঞ্জ এলাকার ৬০ বছরের বিধবা মহারানীর। বন্যায় তার বাড়িঘর সব এখন পানির নিচে। অন্যের বাড়িতে বসবাস করে মানবেতর জীবনযাপন করছে অসহায় এই বৃদ্ধা। একই এলাকার হারুন শেখ, ফুলতার, লালজানরা অসহায় তাকিয়ে আছেন ফ্যালফ্যাল চোখে। ঘরে খাবার নেই। যেখানেই ত্রাণের কথা শুনছেন সেখানেই ছুটে যাচ্ছেন পানি সাঁতরিয়ে।
ঘিওর সদর ইউনিয়নের কুস্তা গ্রামের ফরিদা বেগমের বাড়িতে কোমর পানি। ঘরে অসুস্থ স্বামীকে নিয়ে অর্ধাহারে দিন কাটাচ্ছেন ৬৫ বছরের এই নারী। মাটি কেটে সংসার চালালেও এখন কোনো কাজ নেই। ঘিওরের ডিএন হাই স্কুলে ত্রাণ দিচ্ছে এমন কথা শুনে সেখানে হাজির হন তিনি। প্রখর রৌদ্রে বসে আছেন ত্রাণের আশায়। জানালেন, কয়েক দিন ধরে ঘরের ভেতর কোমর পানি। কিন্তু কেউ খোঁজ নেয় না। খাবার নাই। অসুস্থ স্বামীর মুখেও দুই বেলা খাবার দিতে পারছেন না। একই ইউনিয়নের ঠাকুরকান্দি গ্রামের ময়না বেগম (৮০)।. স্বামী গেদু মিয়া কত বছর আগে মারা গেছে সেটা তার মনে পড়ছে না। ঘরে ৫ জন ছেলে ছিল। তাদের মধ্যে একে একে ৪ জনই বিভিন্ন রোগে মারা গেছে। একমাত্র ছেলে থাকলেও মায়ের ভরণ পোষণ না করে আলাদা সংসার করছে। ময়না বেগম আবেগাপ্লুত হয়ে বললেন, আমার কষ্টের সীমা নাই। আগে মাটি কাটতাম। এখন বয়স হওয়ায় তাও পারি না। বন্যায় বাড়িঘর সবকিছু তলিয়ে গেছে। সরকার যদি মাঝে মধ্যে চাল- ডাল দিতো তাহলে বন্যার এই সময় অন্তত দুই বেলা খেয়ে বাঁচতে পারতাম। বানভাসি এই মানুষগুলো যেখানেই রিলিফের কথা শোনেন সেখানেই ছুটে যাচ্ছেন উর্ধ্বশ্বাসে; এক মুঠো চালের আশায়।
এদিকে চারটি উপজেলার দুই লাখ মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন। বানভাসি মানুষের জন্য ৫৯টি আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়েছে। আশ্রয়কেন্দ্রে প্রায় চার হাজার পরিবার আশ্রয় নিয়েছে।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button