
বিশেষ প্রতিবেদক: সিলেট সীমান্তের অপরাধের একটা অলিখিত‘রেওয়াজ’ হচ্ছে, চোরাচালান বন্ধ হলে বালু পাথর উত্তোলন শুরু হয়, আর বালু-পাথর তান্ডব বন্ধ হলে ফের চোরাচালান শুরু করে চোরাকারবারিরা।
এর প্রধান কারণ হলো, সীমান্তের জনপদেও শ্রমজীবী মানুষের আয়ের উৎস এ দুটোই। আর এসব শ্রমজীবী মানুষকে আয়ের প্রলোভন দেখিয়ে অন্ধকার জগতের কিছু মাফিয়ারা কিছুদিন পাথর তান্ডব,আবার কিছুদিন চোরাচালান করে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। সাদাপাথর লুটের ঘটনার পর ফের সিলেট সীমান্তে চোরাচালান শুরু করেছে নেপথ্যের মাফিয়ারা। আগে এসব নিয়ন্ত্রণ করতো আওয়ামী লীগের ডেভিলরা, আর এখন নিয়ন্ত্রণ করছে বিএনপি ও যুবদলের নেতারা।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, হরিপুরে সেনাবাহিনীর অভিযানের কারণে গোয়াইনঘাট উপজেলার জাফলং সীমান্তের চোরাচালান কিছুদিন বন্ধ ছিল। জুলাই আন্দোলনের আগে সিলেটের প্রভাবশালী এক আওয়ামী লীগ নেতার শেল্টারে গোটা সিলেট ছিলো চোরাচালানের স্বর্গরাজ্য। আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর বিজিবির উপর চাপ থাকায় চোরাচালান কিছুটা কমে এসেছিল। জাফলং সীমান্তে শুরু হয় বালু–পাথর লুট। নতুন জেলা প্রশাসক সারওয়ার আলম এসে সিলেটের বালু-পাথর উত্তোলন পুরোটাই বন্ধ করে দেন। জীবিকার ‘বিকল্প অপশন’ চোরাচালানে ফিরেছে সিলেটের জাফলং সীমান্তের বিএনপি ও যুবদলের মাফিয়ারা। তারা ইতোমধ্যে বিজিবি, জেলা ডিবি, থানা পুলিশ ও বিট পুলিশ ম্যানেজ করেছে। এখন প্রতিরাতেই সিলেট সীমান্তে বিজিবির সামনেই নামছে চোরাচালান। এসব চোরাচালানে শুধু ভারতীয় পণ্যই থাকছে না, আসছে অস্ত্র ও নিষিদ্ধ মাদক।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, একটি ‘লাইনম্যান গ্রুপ’ নিয়ন্ত্রণ করছে ভারতীয় চোরাচালান। ওই গ্রুপের সদস্যরা বিজিবি, বিট পুলিশ ও জেলা ডিবিকে প্রতিরাতে টাকার ভাগ দিয়ে পাচার করছে চালান। জেলা পুলিশের গোয়াইনঘাট থানাকে ম্যানেজ করে সিলেটসহ দেশের চট্টগ্রামে যাচ্ছে ভারতীয় নানা চোরাই পণ্য। গোয়াইনঘাটের পূর্ব জাফলংয়ের জিরোপয়েন্ট, তামাবিল, সোনাটিলা, স্থলবন্দর, নলজুড়ি, আমস্বপ্ন ও তালতলা সীমান্তে প্রতিরাতে প্রবেশ করছে বড়-বড় ভারতীয় পণ্যের চোরাচালান। এসব চোরাচালান প্রবেশের নেপথ্য লাইনম্যানরা হলেন, যুবদল নেতা কাশেম, সাহেদুর রহমান লিটন ওরফে বাবলা। তারা বিজিবি, জেলা ডিবি ও পূর্ব জাফলং বিট পুলিশকে ম্যানেজ করে এসব ভারতীয় চোরাচালান প্রবেশ করছে। ভারত থেকে সীমান্তের বিভিন্ন গুদামঘরে এসব চালান মজুদ হচ্ছে। তারপর দিনের বেলা ডিআই পিকআপ, ট্রাক ও কাভার্ডভ্যানে লোড করা হচ্ছে চোরাচালানের পণ্য। বিজিবির তামাবিল ক্যাম্প ইনচার্জ, সংগ্রাম ক্যাম্প কমান্ডার ও প্রতাপপুর ক্যাম্প কমান্ডারকে ম্যানেজ করেই ভারত থেকে বাংলাদেশে প্রবেশ করছে ভারতীয় চোরাচালান।
জাফলং সীমান্তের সূত্র জানায়, জেলা ডিবি ও বিট পুলিশকে টাকা দিলে ভারতীয় চোরাচালান লোড করা ট্রাক, পিকআপ ও কাভার্ডভ্যান সিলেটের দিকে রওনা হয়। সিলেট-তামাবিল সড়ক হয়ে জৈন্তাপুর থানার সামন দিয়ে প্রথমে সিলেটে প্রবেশ করছে ভারতীয় চোরাচালান। এসব ট্রাকে বোঝাই থাকে ভারতীয় গরু-মহিষ, চিনি, শাড়ি, ত্রিপিস, লেহেঙ্গা, কসমেটিকস, কীট ও মাদক। সিলেট মেট্রো এলাকায় ডিবির ডিউটিরত ওসির টহল টিমের সঙ্গে যোগসাজশ করে সিলেট শহরে প্রবেশ করে চোরাচালানের ট্রাক। আর বেশিরভাগ ট্রাক মুরাদপুর বাইপাস পয়েন্ট হয়ে মোগলাবাজার, দক্ষিণ সুরমা ঢাকা মহাসড়ক হয়ে দেশের চট্টগ্রামসহ বিভিন্ন জেলা শহরে চালান নিয়ে চলে যাচ্ছে। সিলেট সীমান্তে বিজিবির হাতে চোরাচালান ধরা পড়লেও এসব চালানের সঙ্গে চোরাকারবারি ধরা পড়ছে না। প্রতি অভিযানে মাল রেখে পালিয়ে যায় চোরাকারবারিরা! সিলেট-তামাবিল-ঢাকা মহাসড়কের ভিতরে গোয়াইনঘাট ও জৈন্তাপুর থানার ওসি টাকার ভাগ পাওয়ায় পুলিশের কোনো তৎপরতা নেই। জেলার থানা পুলিশ চোরাচালান আটকে নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করছে। বরং মাসিক কয়েক লাখ টাকার বিনিময়ে নিজস্ব লাইনম্যানের মাধ্যমে কয়েক লাখ টাকার বিনিময়ে লাইন বিক্রির অভিযোগ রয়েছে জেলার থানা পুলিশের বিরুদ্ধে। এদিকে, জেলার ডিবির ওসির নামে টাকা তুলেন নিজস্ব লাইনম্যান। অভিযোগ আছে, সিলেট জেলা ডিবি পুলিশের একজন ওসি গাড়ি নিয়ে হরিপুরে বসে থাকেন ভাগের টাকা আনার জন্য। চোরাচালান আটকে জেলা ডিবি পুলিশের তৎপরতা নেই।
এ বিষয়ে জানতে আবুল কাশেম মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে পাওয়া যায়নি তাই বক্তব্য নেওয়া যায়নি।
এ বিষয়ে জানতে সাহেদুর রহমান লিটন উরফে বাবলার মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন এপর্যন্ত বহু নিঊজ হয়েছে এতে কিছুই হয়নি, তোমরা যা পারো কর শত শত নিউজ করো কোনো সমস্যা নাই।
সহকারী পুলিশ সুপার (অপারেশন্স অ্যান্ড ট্রাফিক) ও অতিরিক্ত দায়িত্বে স্টাফ অফিসার টু ডিআইজি, সিলেট রেঞ্জ মোঃ রফিকুল ইসলাম খান বলেন, চোরাচালান প্রতিরোধ করা পুলিশের রুটিন ওয়ার্ক। চোরাচালান পণ্য আটকে কোনো থানার তৎপরতা নিষ্ক্রিয় পরিলক্ষিত হলে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
এ বিষয়ে সিলেট ব্যাটালিয়ন (৪৮ বিজিবি) এর অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল মোঃ নাজমুল হক প্রেস ব্রিফিংয়ে বলেন, সীমান্ত এলাকায় নিরাপত্তা রক্ষা, চোরাচালান, মাদক ও অস্ত্র পাচার প্রতিরোধে বিজিবির অভিযান এবং গোয়েন্দা তৎপরতা অব্যাহত রয়েছে।