বিবিধশিরোনাম

গুম হওয়া পরিবারের অকুতি : ‘ওদের ফিরিয়ে দিন’

এক হাত দিয়ে স্বামীর ছবি সংবলিত একটি প্লেকার্ড বুকে জড়িয়ে আর অন্য হাত দিয়ে ছোট্ট ছেলে সন্তানকে কোলের কাছে নিয়ে অপলক তাকিয়ে আছেন নিখোঁজ মফিজুল ইসলাম রাশেদের স্ত্রী। তার চোখে মুখে অনিশ্চয়তার ছাপ। ছোট্ট শিশুটিও মুখটা মলিন করে বসে আছে বাবার খোঁজে। আসলেই কি ওর বাবা ফিরে আসবে, নাকি আসবে না? সেই হিসেব কসছে ছোট্ট শিশুটিও। নিখোঁজ ড্রাইভার কাওসারের শিশু কন্যা লামিয়া আক্তার মীম বলছে আমার বাবাকে ফিরিয়ে দিন। আমি বাবাকে ফেরত চাই।
অন্যদের মতো বাবার হাত ধরে আমিও হাঁটতে চাই। আমার বাবাকে ফিরিয়ে দিন, না হলে আমাদেরও নিয়ে নিন। শুধু রাশেদের পরিবার আর বাবা হারানো ছোট্ট মীমই নয় কেউ সন্তান হারিয়ে, কেউবা স্বামী হারিয়ে, কেউ কেউ ভাই হারিয়ে স্বজন হারিয়ে তাদের ফিরে পেতে আকুতি জানাতে প্রেসক্লাবের কনফারেন্স লাউঞ্জে জড়ো হয়েছেন নিখোঁজ হওয়া-গুম হওয়া স্বজনের ছবি বুকে নিয়ে।
স্বজনদের ফিরে পেতে ওপরের আর্তনাদগুলো কোন নাটিকা মঞ্চের ঝোলানো প্লাকার্ড নয়। বুকের ভেতরে তীর বিদ্ধকারী হৃদয় হন্তারক এ সব আর্তনাদ ছিল স্বজনহারা অসহায় পরিবারের। গতকাল রাজধানীর জাতীয় প্রেসক্লাবে বাংলাদেশে গুম হওয়া ব্যক্তিদের পরিবারগুলোর সংগঠন ‘মায়েদের ডাক’ আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে গুম হওয়া স্বজনদের ফেরত পেতে এমন আর্তনাদ ছিল স্বজনহারা শিশু, কিশোর ও বৃদ্ধ পিতা-মাতার। গতকাল বিশ্বজুরে পালিত হয়েছে জাতিসংঘ ঘোষিত ‘ইন্টারন্যাশনাল ডে অফ দ্যা ভিকটিমস অব এনফোসর্ড ডিসঅ্যাপিয়ারেনসেস।’ বাংলাদেশেও প্রতিবছর এই দিনে গুম হওয়া ব্যক্তিদের পরিবারগুলোর সংগঠন ‘মায়েদের ডাক’ জাতীয় প্রেসক্লাবে এ দিবসটি পালন করে। আন্তর্জাতিক গুম দিবস উপলক্ষ্যে প্রেসক্লাবে আসা স্বজনহারা পরিবারগুলো বলেন, আমাদের কারও প্রতি কোন অনুযোগ, অভিযোগ নাই। শুধু আমাদের পরিবারের সদস্যদের ফিরিয়ে দিন। গুম হওয়া স্বজনদের ফিরে পেতে সরকারের কাছে এ ভাবেই আকুতি জানিয়েছেন তাদের পরিবারের সদস্যরা।
গুম হওয়া সুমনের বোন আফরোজা ইসলাম বলেন, স্বজন হারানোর বেদনা বড় কষ্টের। দীর্ঘদিন নিখোঁজ থাকা আরও কষ্টের। আমরা সরকারের কাছে আহবান জানাই, আমার ভাইকে ফিরিয়ে দিতে ব্যবস্থা নিন।
গুমের শিকার সাজেদুল ইসলাম সুমনের মা হাজেরা খাতুন বলেন, মায়ের সন্তান ফিরে আসুক মায়ের কোলে। গুম হওয়া সব সন্তানদের তাদের মায়ের কোলে ফিরিয়ে দিন। আমাদের কারও প্রতি কোন অভিযোগ নেই। শুধু চাই সন্তান ফিরে আসুক। সন্তান ফিরে আসবে এই আশায় পথ চেয়ে বসে আছি।
এদিকে ছোট্ট শিশু হৃদি। বাবাকে দেখে না বহুকাল। একদিন উধাও হয়ে যায় হঠাৎ করেই। বন্ধু, সহপাঠী আর পরিচিতজনরা বাবার সঙ্গে স্কুলে আসে, ঘুরতে যায় দেখে কান্না পায় হৃদির। শিশুটির বাবা পারভেজ রাজনীতিতে জড়িত ছিলেন। ছিলেন বংশাল থানা ছাত্রদলের নেতা। তার হঠাৎ উধাও হয়ে যাওয়া নিয়ে প্রশ্ন আছে, কিন্তু জবাব নেই। হৃদি মঞ্চে উঠে বাবার ছবি হাতে নিয়ে। কণ্ঠে কান্না। তার কাঁপুনি ভরা কণ্ঠ আর্ত করে দেয় মঞ্চে এবং সামনের শ্রোতার আসনে থাকা অন্যদেরও।
]বাবাকে খুঁজে দিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে আকুতি জানায় হৃদি। বলে, আমার বাবাকে খুঁজে দিন হাসিনা আন্টি। প্লিজ আন্টি আমার বাবাকে ফিরিয়ে দেন। আমার বাবার সাথে ঘুরতে যাবো, বাবা আমাকে নিয়ে স্কুলে নিয়ে যাবে, ঈদ করবো বাবার সাথে। কিন্তু বাবাকে পাই না।
হৃদি বলে, আঙ্কেল তোমরা তো জানো আমার বাবা কোথায়। বাবাকে তোমরা ফিরিয়ে দাও। আমি বাবাকে চাই। বলেই বাবার ছবিটা জড়িয়ে ধরে কান্নায় ভেঙে পড়ে হৃদি। তখনও মঞ্চে থাকা বিএনপির শীর্ষ নেতাসহ সামনে বসা অনেক নেতাকর্মী ডুকরে কেঁদে উঠেন। হৃদির মতোই বাবার জন্য আরিয়ানের আকুতি কাঁদিয়েছে অন্যদের। তার বাবা খালেদ হোসেনের দেখা নেই পাঁচ বছর ধরে।
আরিয়ান চতুর্থ শ্রেণিতে পড়ে। ঢাকা কলেজিয়েট স্কুলে। মাত্র এক মিনিটের বক্তব্য। তাতেই হৃদয় ছুঁয়ে গেল সবার। বয়সে অনেক ছোট হওয়ায় বড় ডায়াসে সামনে থেকে দেখা যায় না আরিয়ানকে। তাই ছোট একটি চেয়ারে দাঁড় করানো হলো তাকে। শিশুটি বলে, আমি পাঁচ বছর ধরে বাবাকে ডাকতে পারি না, দেখি না। আমি বাবাকে ফিরে পেতে চাই। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, আপনি আমার বাবাকে আমাদের কাছে ফিরিয়ে দেন। সবাই বাবাকে নিয়ে ঘুরতে যায়, ঈদের নামাজ পড়ে আমি তো ঘুরতে যেতে পারি না। এ কথা বলেই কান্নায় ভেঙে পড়ে আরিয়ান। মুহূর্তের মধ্যে হল রুমের বড়রাও ধরে রাখতে পারেনি আবেগ। শোনা যায় ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কান্নার শব্দ।
এমন দৃশ্য অবতারণা হয়েছে গতকাল সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির মিলনায়তনে বিএনপির উদ্যোগে আন্তর্জাতিক গুম দিবস উপলক্ষে এক আলোচনা সভায়।
জাতীয় প্রেসক্লাবের মায়ের ডাক প্রতিবাদ সমাবেশে বিভিন্ন সময় যাদের সন্তানকে গুম করা হয়েছে, তাদের পরিবার যেন গুমকারীদের ভোট না দেয় সেই আহ্বান জানিয়েছেন নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্না। তিনি বলেন, প্রতিবারই একই কথা শুনি। পাঁচ বছর ধরে একটা মানুষকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। তাদের পরিবারের সদস্যরা যে কেঁদে কেঁদে আকুতি জানাচ্ছে, এই কান্না সরকারের কানে যাবে না। অনেকেই যে গুম হয়ে গেছে একথা তারা জানে। তবে নির্বাচনের আগে আপনাদের কান্নার পাত্তা এই সরকার দেবে না।
নির্বাচনের পর নতুন সরকার আসবে নাকি পুরনো বোতলে নতুন মদ আসবে একথা কেউ জানে না। তারা কোনো ভুল মানুষকে গুম করেনি। বুঝে শুনে গুম করা হয়েছে। এসব গুম মূলত রাজনৈতিক। যারা গুম হয়েছে তারা হয় বিএনপি করে, আর না হয় অন্য দল করে। রাজনীতিতে ভয়ের ত্রাস কায়েম করে রাখার জন্য গুমকে জিইয়ে রাখা হয়েছে। এই অন্যায় অত্যাচারের প্রতিকার আছে। প্রতিজ্ঞা করুন, যারা আমার সন্তানকে নিয়ে গেছে তাদের কাউকে ভোট দেবেন না।
গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়ক জোনায়েদ সাকি বলেন, এমন একটি দেশে বাস করছি যে দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, প্রেমের কারণে কোথাও চলে যাচ্ছে। যদি চলে যেয়েই থাকে ধরে এনে বিচার করেন। আর না হলে পদত্যাগ করেন। এখন যে ব্যবস্থা চলছে এটা একটি লাগামহীন ব্যবস্থা, এই ব্যবস্থা দূর করতে হলে জনগণের ভোটাধিকার প্রতিষ্ঠা করতে হবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সি আর আবরার বলেন, এই যে পরিবারগুলোর চাওয়া, এটা কি অন্যায়? আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী উদ্ধার করতে পারছে না, মামলা দিলেও নিচ্ছে না, মামলা নিলেও তদন্ত হয় না। সুস্পষ্ট অভিযোগ থাকা সত্তে¡ও কেন উত্তর পাওয়া যায় না? কারণ, রাষ্ট্র এর সঙ্গে সম্পৃক্ত।
আলোচনা সভায় গুম হওয়া ব্যক্তিদের পরিবারের সদস্যরা উপস্থিত ছিলেন। উপস্থিত কারো সন্তান, কারো বাবা, কারো স্বামী গুমের শিকার হয়েছে। স্বজনদের হারিয়ে অপেক্ষার প্রহর গুনতে গুনতে নির্ঘুম রাতও পাড় করেছেন। তবুও পথ চেয়ে বসে আছেন প্রিয় মানুষটির আশায়। এ সময় স্বজনদের কান্নায় প্রেসক্লাবের বাতাস ভারী হয়ে উঠে। তারা সরকার ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে আকুতি জানান, যেন তাদের স্বজনদের খুঁজে বের করে দেয়া হয়।
বাংলাদেশের বিপ¬বী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারন সম্পাদক সাইফুল হক বলেন, গুমের অধিকাংশ ঘটনার সাথে সরকারের বাহিনী জড়িত। গুমসহ নানা ঘটনার বিচার না হলে ভবিষ্যতে ট্রাইবুনাল করে দোষীদের বিচারের আওতায় আনা হবে।
মানবাধিকার সংশ্লিষ্টদের তথ্য মতে, বাংলাদেশে গুম হওয়া ব্যক্তিদের তালিকা অনেক দীর্ঘ না হলেও খুব ছোট নয়। তাদের মতে, বাংলাদেশে গুমের তালিকায় সাবেক সংসদ সদস্য থেকে রয়েছে সাধারণ মানুষ। এই তালিকায় সাবেক সাংসদ ইলিয়াস আলী, সাবেক ওয়ার্ড কমিশনার চৌধুরী আলম, সাবেক রাষ্ট্রদূত মারুফ জামান ছাড়াও অনেক রাজনৈতিক কর্মীসহ নানা পেশার মানুষ।
‘মায়েদের ডাক’ এর দেওয়া তথ্য অনুযায়ী ২০১৩ সাল থেকে দেশে গত পাঁচ বছরে গুম, বিচার বহির্ভুত হত্যাকাণ্ড ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে নির্যাতনের শিকার হয়েছে ৭২৭ জন।এছাড়া এশিয়ান হিউম্যান রাইটস কমিশনের হিসেব মতে, গত ৯ বছরে গুম হয়েছে ৪৩২ জন, যার মধ্যে সন্ধান মিলেছে ২৫০ জনের।এসব সংগঠনের মতে, গুম হওয়া ব্যক্তিদের মধ্যে কেউ কেউ ফেরত এলেও তাদের অধিকাংশ এখনও নিখোঁজ। নয়া দিগন্ত।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button