উপমহাদেশশিরোনাম

একজন বৃটিশ বিরোধী বিপ্লবী সৈয়দ আলিমুদ্দিন আহমেদ

ক্যালিম্পং থেকে শিলা চৌধুরী
যার নামে কলকাতার বিখ্যাত আলিমুদ্দিন স্ট্রিট , জানেন কি কে ছিলেন এই আলিমুদ্দিন ?
মধ্য কলকাতার একটি অতি পরিচিত রাস্তা আলিমুদ্দিন স্ট্রিটের নাম কার না জানা। কিন্তু কার নামে এই আলিমুদ্দিন স্ট্রিট?
কে ছিলেন এই আলিমুদ্দিন?
এর উত্তর আমাদের কারোই জানা নেই। যদিও তিনি একজন বরণীয় স্বাধীনতা সংগ্রামী কিন্তু ইতিহাসের পাতায় তাঁর নাম স্থান পায়নি। তাই সৈয়দ আলিমুদ্দিন আহমেদ ওরফে মাষ্টার সাহেব বাঙালি তথা ভারতবাসীদের কাছে খুবই অপরিচিত নাম।
ব্রিটিশ সরকারের শোষণ ও নিপীড়নের বিরুদ্ধে অগণিত বিপ্লবীদলের সশস্ত্র বিপ্লবাত্মক কার্যক্রমের মাধ্যমে ভারতের স্বাধীনতা অর্জিত হয়েছে। শক্তিশালী ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে শোষিত ভারতীয়দের লড়াই সংগ্রাম অব্যাহত রাখা বড়ই দূরহ ছিল। কারণ বিপ্লবীদের অস্ত্রশস্ত্র ও আর্থিক সঙ্কট ছিল প্রকট। বাংলার এমনই এক বিপ্লবীদলের মধ্যে অর্থ সঙ্কট দেখা দেয়। কিন্তু দেশীয় জমিদার ও বিত্তশালী মানুষেরা বিপ্লবীদের সাহায্য বিমুখ ছিল। বাধ্য হয়ে রসদ জোগানের পন্থা হিসেবে লুঠ তরাজ করার উদ্দেশ্যে “স্বদেশী ডাকাত” দল গঠন করে।
স্বদেশী ডাকাতদের ঐকান্তিক আকাঙ্খা ছিল ইংরেজ সরকারের টাকা পয়সা লুঠ করা। কিন্তু বিপ্লবীদের সেই শক্তি ছিল না। তাই তাঁরা স্থির করেন, যে সকল মানুষ দেশদ্রোহী, যারা সরকারের গুপ্তচর, দেশের মানুষদের ওপর অত্যাচার করে অর্থ উপার্জন করে ও মহাজনী কারবার করে সুদের নামে গরিবদের রক্ত শোষন করে , কেবল তাদেরই বাড়িতে ডাকাতি করা হবে। স্বদেশী ডাকাতদের নেতা ছিলেন পুলিনবিহারী দাস, শচীন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়, ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত, সৈয়দ আলিমুদ্দিন আহমেদ প্রমুখ। স্বদেশী ডাকাতির ইতিহাস অনুসন্ধান করলে আরো অনেক নাম পাওয়া যাবে কিন্তু সৈয়দ আলিমুদ্দিন আহমেদ ওরফে মাষ্টার সাহেব এর নাম পাওয়া যায়না। তাই তিনি ভারতীয়দের অগোচরে রয়েছেন।
সৈয়দ আলিমুদ্দিন আহমেদ ১৮৮৪ সালে ঢাকার আকাশ জমাদার লেনে জন্ম। তিনি বিপ্লবী হেমচন্দ্র ঘোষের সতীর্থ ছিলেন। ঢাকার আব্দুল গণি সাহেবের ফ্রি স্কুলে তাঁদের প্রাথমিক পাঠ শুরু হয়। তৃতীয় শ্রেণি পাঠান্তে হেমচন্দ্র অন্যত্র পড়তে চলে যান। আর আলিমুদ্দিন স্থানীয় মাদ্রাসাতে ভরতি হন। মাদ্রাসার পাঠ শেষ করে ১৯০৬ সালে ঢাকা কলেজে ভর্তি হন। আর্থিক দূর্দশার কারণে এফ এ পরীক্ষা দিতে পারেন নি। মাঝপথে পড়া বন্ধ করে দিয়ে ঢাকা কালেক্টরেটের চাকরিতে যোগ দেন। চাকরি করতে করতে অবসর সময়ে বাড়িতে কিছু ছাত্র পড়াতেন। তারপর থেকেই তিনি “মাষ্টার সাহেব।” ছাত্র অবস্থা থেকেই আলিমুদ্দিন বিপ্লবী মানসিকতার ছিলেন। তিনি ও হেমচন্দ্র দুজনে ১৯০২ সাল থেকে শ্যামাকান্ত ও পরেশনাথের আখড়ায় নিয়মিত শরীর চর্চা করতেন। সুঠাম শরীরের অধিকারী আলিমুদ্দিন সুদক্ষ কুস্তিগীর হয়ে ওঠেন। এর পাশাপাশি লাঠি ও ছোরা চালনায়ও পারদর্শিতা অর্জন করেন।
আলিমুদ্দিন নিজে শরীর চর্চা, লাঠি চালনা ইত্যাদি প্রশিক্ষণের উদ্দেশ্যে একটি আখড়া তৈরি করেন। তাঁর আখড়ায় হিন্দু, মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের যুবকদের অবাধ বিচরণ ছিল। ওই এলাকার সকলেই তাঁকে পরম শ্রদ্ধার সাথে গ্রহণ করেছিলেন। আখড়ায় প্রশিক্ষিত যুবকদের নিয়ে এমন ভাবে ব্রিটিশদের বোকা বানিয়ে অতি সংগোপনে ব্রিটিশ বিরোধী ধ্বংসাত্মক সংগ্রাম পরিচালনা করতেন যা সরকার কোনভাবেই বুঝতে পারেনি। আলিমুদ্দিন প্রতিষ্ঠিত সংগঠন ‘মুক্তিসংঘ’ ও ‘ভলান্টিয়ার ক্লাব’ বহুবিধ দুঃসাহসিক বৈপ্লবিক কাজ কর্ম চালিয়ে যেত। ধর্মনিষ্ঠ মাষ্টার সাহেবকে পুলিশ কোনওদিনই বিপ্লবী বলে আন্দাজ করতে পারেনি। সেটাই ছিল তাঁর জন্য মস্ত সুবিধা। কোরান, গীতা, বাইবেল নিয়ে যেমন মশগুল থাকতেন, তেমনই গোপনে পরিচালনা করতেন সশস্ত্র সংগ্রাম। সংগ্রাম চালিয়ে যেতে অস্ত্রশস্ত্র ও আর্থিক চাহিদা পূরণার্থে পুলিনবিহারী দাসদের পদাঙ্ক অনুসরণ করে স্বদেশী ডাকাত দল গঠন করেন তিনি ।
আলিমুদ্দিনের নেতৃত্বে ডাকাত দল জমিদার, মহাজন, মদ ও মহিলাদের পিছনে যারা টাকা ওড়ায়, কেবল তাদের বাড়িতে ডাকাতি লুণ্ঠন ইত্যাদি চালিয়ে তাঁদের বিপ্লবের তহবিল পুষ্ট করতেন। তবে তিনি অতি মানবিক ছিলেন। কখনই তাঁর ডাকাতি দলের দ্বারা কোন গৃহকর্তা বা সদস্য হেনস্থা কিংবা লাঞ্চিত এমনকী নির্দয়তার শিকার হয়নি।
আলিমুদ্দিনের নেতৃত্বে ডাকাতি দলের একটি মানবিকতাপূর্ণ কাহিনি এমন আছে- মাষ্টার সাহেবের নেতৃত্বে জনা দশেক যুবকের এক ডাকাত দল ১৯১০ সালের কোন এক অন্ধকার রাতে দুটি নৌকায় করে বুড়িগঙ্গা পেরিয়ে ঢাকা শহরের অন্য পারে জিয়াগঞ্জের শুভাঢ্যা গ্রামের এক বনেদি বাড়িতে ডাকাতি করতে গেলেন। গৃহস্তবাড়ির সদরে একজনকে পাহারায় রেখে বাকিরা ভিতরে প্রবেশ করেন। তাঁরা বাড়ির পুরুষদের বুকে রিভালবার ধরে টাকা পয়সা, গয়না-গাঁটি বার করে দেওয়ার জন্যে হুঙ্কার দিতেই পরিবারের টাকাকড়ি ডাকাতদের কাছে হুড়হুড় করে জমা পড়তে থাকে। মহিলাদের উদ্দেশ্যে শরীরের গহনা খুলে দিতে নির্দেশ দিতে মায়েরা টপাটপ গহনা খুলে দিতে লাগলেন। কিন্তু সর্বশরীরে অলঙ্কারে পূর্ণ এক তরুণী বধু অবিচল রইলেন। তরুণীটি তাঁর কোলের দুধে শিশুটিকে নিয়ে নির্ভিক উপবিষ্টা অবস্থায় মাষ্টার সাহেবের দৃষ্টিতে আসতে লাগলেন। মাষ্টার সাহেব হরিদাস দত্ত নামের এক যুবককে মায়ের কোল থেকে বাচ্চাটাকে ছিনিয়ে নিতে নির্দেশ দেন। নির্দেশ পেয়ে শিশুকে নিয়ে অন্ধকারে বেরিয়ে চলে যায়। এরপরেও সেই তরুণী নিরুদ্বিগ্ন দৃষ্টিতে দলনেতা মাষ্টার সাহেবের দিকে তাকিয়ে রইলেন। তরুণীর শরীর ভর্তি অলঙ্কারের ঝলকানি যেন স্বদেশী ডাকাতদের নিষ্ঠুর আদেশকে উপহাস করছে। তরুণীর চোখের ভাষা আলিমুদ্দিন কিছু একটা বুঝতে পারছিলেন। তাই তিনি শিশুটিকে ফিরিয়ে দিতে আদেশ দিলেন। তরুণী মা শিশুটিকে কোলে নিয়ে বললেন – ‘আমি জানি আপনাদের হাতে আমার ছেলের কোনও ক্ষতি হবেনা। আপনারা কারা তা আমি আগেই বুঝেছিলাম। আমি আমার শ্বশুরবাড়ি থেকে আজই মায়ের কাছে এসেছি। আমার মা আমাকে তাঁর কুঁড়ে ঘরে রাখতে সাহস পাননি। তাই এই নিরাপদ ও শক্তপোক্ত বাড়ির আশ্রয়ে পাঠিয়েছেন। অর্থ ও গহনা আপনাদের কতটা প্রয়োজন সেটাও আমি ভাল করে জানি। আমার স্বামী বিরাট ধনী। স্বামীর ঘরে হলে আপনাদের হাতে আমি সব তুলে দিতাম। কিন্তু এখানে আমি কিছুই দিতে পারবোনা। কারণ আমার শ্বশুরবাড়ির কেউ এই ডাকাতির কথা বিশ্বাস করবেনা। তাঁরা ভাববে আমি আমার গরিব মাকে দিয়েছি আর মিথ্যা গল্প সাজিয়েছি। আমার জীবনের একটা বড় ক্ষতি হয়ে যাবে।’
তরুণীর এই বক্তব্য শুনে দলনেতা মাষ্টার সাহেব, হস্তগত হওয়া সমস্ত অর্থ সম্পদ রেখে শূন্যহস্তে প্রতাবর্তণের নির্দেশ দিলেন।
১৯৩০ সালে সৈয়দ আলিমুদ্দিন আহমেদ ওরফে মাষ্টার সাহেব শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button