sliderবিবিধ

একজন সংগঠক, সমাজসেবক ও সাংবাদিক রণজিৎ কুমার সরকার

জাহাঞ্জীর আলম বিশ্বাস : ইট-কংক্রিটের মতো জমে যাওয়া শক্ত খোলসে চাপা পড়া ক্ষমতা, ভোগ দখলের পৈশাচিক দম্ভ আর মেকি আনন্দ কুড়িয়ে ফুটো থলে ভর্তি করার মত আজকের এই নিত্যনৈমিত্তিক জীবনের চেয়ে কিছুকাল পূর্বেও একসময়ের জীবনযাত্রা সহজ ছিল। সেকালে রবি ঠাকুরের সোনার বাংলা, জীবনানন্দের রূপসী বাংলা আর নজরুলের প্রিয় বাংলাদেশের আকাশে বাতাসে ধ্বনিত হতো লালন ফকির, হাসন রাজা, আব্বাস উদ্দীনের মর্মস্পর্শী সুরের ব্যঞ্জনা। তবে সেসময় আজকের তুলনায় কুসংস্কারের তীব্রতা বেশি ছিল। তৎকালীন সময়ে পুরুষেরা নারী সেজে নারী চরিত্র যে কী সুন্দর ফুটাতে পারতো তা স্বচক্ষে না দেখলে বুঝা যাবে না! তবে এখনো গ্রাম বাংলায় উন্নত মন-মানসিকতা ও আন্তরিকতার যথেষ্ট অভাব রয়েছে। শহরের বেশিরভাগ মানুষই সচেতন ও কুসংস্কারমুক্ত । কিন্তু বাংলাদেশ তো গ্রাম-প্রধান দেশ। অজপাড়াগাঁ’কে কে শোনাবে সভ্য সংস্কৃতির অঙ্গিকার? কে আহ্বান জানাবে সভ্য সংস্কৃতির সাথে সম্পৃক্ত হতে? আজ এমনই একজন ব্যক্তির জীবনযাত্রার উপর আলোকপাত করবো। নির্জনে-নিভৃতে কাজ করে যাওয়া এই বাতিঘর অপরিচিত, অবহেলিত, দরিদ্র এক গ্রামের বঞ্চিত এক মানব সন্তান। তিনি একাধারে একজন দক্ষ সংগঠক, সাংস্কৃতিক কর্মী, সমাজসেবক, কবি, সাহিত্যিক, শিক্ষক ও সাংবাদিক। এক কথায় সভ্য সমাজের সকল বৈশিষ্ট্যের সম্মিলন ঘটেছে এই মানুষটির কর্মতৎপরতার মধ্য দিয়ে। নাম-রণজিৎ কুমার সরকার। মানিকগঞ্জ জেলার অন্তর্গত শিবালয় থানায় আরুয়া ইউনিয়নের নালী গ্রামে ১৯৬৯ সালের ৯ জানুয়ারী মাতুলালয়ে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। শিক্ষাজীবন শুরু করেন তাঁর বড় মামা শ্রী সুধীর মজুমদারের কাছে। এরপর স্থানীয় নালী বড়রিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষালাভ শুরু করেন। পর্যায়ক্রমে নালী বড়রিয়া কৃষ্ণ চন্দ্র উচ্চ বিদ্যালয়, মানিকগঞ্জ দেবেন্দ্র কলেজ এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সর্বশেষ এম.কম. ডিগ্রি অর্জন করেন। পরবর্তীতে তিনি বি.এড. ডিগ্রিও অর্জন করেন। কিশোরবেলা থেকেই তাঁর প্রতিভার বিকাশ ঘটতে থাকে। সামাজিক কর্মকান্ডের মধ্য দিয়ে তিনি খুব অল্প সময়ে এলাকায় পরিচিতি লাভ করেন। তখনকার সময় এলাকার যতগুলো নাটক বা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন হয়েছিল সবগুলোতেই তাঁর উপস্থিতি ছিল উল্লেখ করবার মতো। তাঁর নিজের লেখা কবিতা, গল্প, সেই সব অনুষ্ঠানে পরিবেশন করে এলাকার মানুষের নিকট তিনি খ্যাতি লাভ করেন। সেই সাথে গ্রামের সকল শ্রেণীর লোকের কাছে প্রিয়পাত্র হিসেবে নিজেকে আবির্ভূত করেন। সমাজে শোষিত বঞ্চিত মানুষের সাথে তাঁর যেন আত্মীয়তার সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল খুব অল্প সময়ের মধ্যে। তিনি খুব অল্প বয়সে রাজনৈতিক জীবনে পা রাখেন। তার রাজনীতির হাতে খড়ি খেলাঘর দিয়ে। তার গুরু মানিকগঞ্জের ইকবাল হোসেন কচি ভাই। ছাত্র ইউনিয়নে প্রবেশ কমরেড আজাহারুল ইসলাম আরজু ভাইয়ের হাত ধরে। সিপিবি শহর শাখার সদস্য ছিলেন। তারপর রাজনৈতিক পালাবদলে আওয়ামী ধারার সাথে যুক্ত হলেও মনে প্রাণে সম্য স্বাধীনতা ও সমাজতন্ত্রের লড়াকু সৈনিক ছিলেন তিনি।
একজন রাজনীতিবিদের প্রধান বৈশিষ্ট্যই হচ্ছে মানুষের সুখে-দুঃখে পাশে দাঁড়ানো। তিনি অকাতরে নিজের সবকিছু বিলিয়ে দিতেন মানুষের মাঝে। তাঁর জীবনে ছিলো না কোনো আড়ম্বর, কোনো চাকচিক্য।তিনি ছিলেন একজন আলোকিত মানুষ। যার আলোয় আলোকিত হাজারো মানুষ। ছাত্রজীবনে ১৯৮৫ সাল থেকে নিজেকে সংবাদপত্রের সাথে সম্পৃক্ত করেন। প্রথমে তিনি মানিকগঞ্জ জেলা সদর থেকে প্রকাশিত সাপ্তাহিক পতাকার স্থানীয় সংবাদদাতা হিসেবে কাজ করেন। এরপর সংবাদ প্রতিক্ষণ, লাল-সবুজ, আল-আযান পত্রিকায় কাজ করেন। তিনি ভোরের ডাক পত্রিকার জেলা সংবাদদাতা ও সাপ্তাহিক আবাবিলের স্টাফ রিপোর্টার হিসেবেও কাজ করেছেন। সর্বশেষ ভোরের কাগজ পত্রিকায় দীর্ঘদিন কাজ করেন। উল্লেখ্য পত্রিকাগুলো ছাড়াও তিনি তাঁর কর্মব্যস্ত জীবনে বহু পত্রিকায় কাজ করেছেন। তিনি “মুক্তাঙ্গন” নামক একটি ম্যাগাজিনের সম্পাদকও ছিলেন। চাহিদা অনুযায়ী সুদমুক্ত ঋণ প্রদানের মাধ্যমে তিনি সমাজে তথা দেশের বেকার সমস্যা লাঘবের জন্য ব্যাপক ভূমিকা পালন করেছেন। অপসংস্কৃতির বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেছেন তিনি। আর এই জন্যেই অপসংস্কৃতির আগ্রাসনের হাত থেকে দেশীয় সংস্কৃতিকে রক্ষা করার জন্য তিনি সৃষ্টি করেছিলেন “আদর্শ লোকগীতি শিল্প গোষ্ঠী”। এই সংস্থার মাধ্যমে গ্রামের অপরিচিত এবং অবহেলিত শিল্পীদেরকে একত্রিত করে তাদের মানসিক শান্তি দেওয়ার প্রয়াসে কাজ করেছেন প্রতিনিয়ত। এছাড়া তিনি এলাকার যুব সমাজকে সাথে নিয়ে বিনোদন এবং আনন্দমূলক অনুষ্ঠান যেমন- নাটক, বিভিন্ন সঙ্গীতানুষ্ঠান, মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক অনুষ্ঠান এবং এলাকায় বিভিন্ন সময় নিরক্ষরতা দূর করার জন্য গণশিক্ষা কার্যক্রমসহ প্রভৃতি কার্যক্রম অত্র অঞ্চলের “রক্তরাগ খেলাঘর আসর”-এর মাধ্যমে সম্পন্ন করতেন। ধর্মীয় চেতনাতেও তিনি ছিলেন প্রখর। তাই বহুকাল শিবালয় উপজেলা পূজা উদযাপন কমিটির সহ-সভাপতির দায়িত্ব পালন করেছেন। ভবিষ্যৎ বংশধর অর্থাৎ শিশুদের কোমল মনকে সুস্থভাবে গড়ে তোলার ভূমিকা উল্লেখযোগ্য। তিনি নিজ বাসগৃহে বলা চলে একাই শুধু মানুষের কল্যাণ করার সুতীব্র ইচ্ছাশক্তিকে পুঁজি করে ১৯৯৪ সনের ২৭শে এপ্রিল বুধবার প্রতিষ্ঠা করেন শিবালয় উপজেলার সর্বপ্রথম শিশুশিক্ষানিলয়। যার নাম ‘আদর্শ শিশু বিদ্যা নিকেতন, নালী। দীর্ঘ ২৭ বছর ধরে এই প্রতিষ্ঠানটি সগৌরবে হাজারো সুসন্তান গড়ার কাজ অব্যাহত রেখেছেন। বর্তমানে তাঁর স্ত্রী সংগীতা সরকার ও একমাত্র সন্তান পুষ্পিতা সরকারের তত্ত্বাবধানেই পরিচালিত হচ্ছে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটি। তিনি ছাত্রজীবন থেকেই শিক্ষকতা পেশার সঙ্গে জড়িত ছিলেন। তৎকালীন সময়ে গ্রামে অসুস্থ মানুষের চিকিৎসার প্রাথমিক ব্যবস্থা কিংবা ঔষুধ-পত্রের সংকুলান ছিল খুবই কষ্টসাধ্য। সেই অবস্থায় তিনি সরকার ফার্মেসী নামে একটি ফার্মেসী প্রতিষ্ঠা করেন। যেখানে অল্পমূল্যে, কখনও কখনও বিনামূল্যে ঔষধ সরবরাহ করতেন গ্রামের অসহায় মানুষদের মাঝে। এরপর তিনি দীর্ঘদিন স্থানীয় হাই স্কুল “নালী বড়রিয়া কৃষ্ণ চন্দ্র উচ্চ বিদ্যালয়” এ সহকারী শিক্ষক হিসেবে কর্মরত ছিলেন। সর্বশেষ প্রধানশিক্ষক হিসেবে কর্মরত ছিলেন “মোকসেদ আলী একাডেমী” তে। ২০১৫ সালের ডিসেম্বর মাসের মাঝামাঝিতে তিনি ব্রেইন স্ট্রোক করেন। সেসময় তাঁর চোখের রেটিনায় রক্তক্ষরণ হয়। এতে করে তিনি আস্তে আস্তে দৃষ্টিশক্তি হারাতে থাকেন। এমনকি স্মৃতিশক্তি হারিয়ে ফেলারও ভয় ছিল। দীর্ঘদিন চিকিৎসার পর তিনি সুস্থ হন। তিনি আরুয়া ইউনিয়ন আওয়ামী লীগ ও শিবালয় উপজেলা সাংবাদিক সমিতির সভাপতি ছিলেন। এক কথায় তাঁর জীবনপরিক্রমা ছিল স্নিগ্ধ, সুন্দর, পরার্থে উৎসর্গীকৃত কর্মব্যস্ত। তিনি সারাজীবন শুধু মানুষের জন্য করে গেছেন বিনিময়ে নিজেকে নিঃস্ব করেছেন। খেয়ে না খেয়ে, না ঘুমিয়ে, আরাম-আয়েশ ভুলে শুধু মানুষের জন্য কাজ করে গেছেন। নিজের প্রতি এমন অনাদর, অবিচার তাঁর মন মেনে নিলেও শরীর কিন্তু মেনে নেয়নি। তাই মাত্র ৫১ বছর বয়সে ২০২০ সালের ২০ অক্টোবর ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, কিডনি বিকলে আক্রান্ত হয়ে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুতেই কি সব শেষ? তিনি যে কল্যাণধারা বর্ষণ করে গেছেন তা আজও প্রবাহমান। হয়তো বা বড় বড় সমাজ সেবকদের মত ইতিহাসের পাতায় তাঁর নাম এবং কর্মকান্ড স্থান না পেলেও এলাকার মানুষের মনে স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে তাঁর নাম। এমন মানুষের জন্ম যুগ-যুগ ধরে সাধনা করলেও হয় না। এঁরা আসে সুন্দরের গায়ে জমা অসুন্দরের কালো মেঘের ছায়া দূর করে নিজেকে জ্বালিয়ে বাতিঘর হতে। এঁরা অবিনশ্বর, এঁরা অমর।

Related Articles

Leave a Reply

Back to top button