
নাটোর প্রতিনিধি : দীর্ঘ ১২ বছর ধরে ঘরে লোহার শিকলে বন্দী ৩২ বছরের মানসিক ভারসাম্যহীন মো. একরাম আলীকে দেখতে ছুটে গেলেন সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) সারমিনা সাত্তার। এসময় তিনি এমরাম আলীর বাবার কাছে তার শারীরিক অবস্থার খোঁজ-খবর নেন। বুধবার(৯ আগস্ট) দুপুরে সদর উপজেলার তেবাড়িয়া ইউনিয়নের ভাটপাড়া গ্রামে মানসিক ভারসাম্যহীন একরাম আলীর বাড়িতে দেখতে যান ইউএনও।এসময় উপস্থিত ছিলেন- তেবাড়িয়া ইউনিয়ন পরিষদের ইউপি চেয়ারম্যান ওমর আলী প্রধান, স্থানীয় ইউপি সদস্য সাহাবুদ্দিন, ডাসকো ফাউন্ডেশনেরএফএফ সুনীল কুমার রায় ও সাংবাদিকসহ স্থানীয় গন্যমান্য ব্যক্তিবর্গ।মানসিক ভারসাম্যহীন মো. একরাম আলী (৩২) নাটোর সদর উপজেলার তেবাড়িয়া ইউনিয়নের ভাটপাড়া গ্রামের মো. ইব্রাহিম আলীর ছেলে।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, স্যাঁতস্যাঁতে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে ঘরে মাটিতে শিকল বাঁধা অবস্থায় সুয়ে আছেন একরাম। পাশের ঘরেই থাকেন বৃদ্ধ বাবা। কেউ ডাকলে সাড়া দেন শুকুর। তবে হেঁসে হেঁসে কথার উত্তর দেন।
পরিবার সূত্রে জানা গেছে, ছোটবেলায়আট-দশজন ছেলেদের মতোই স্বাভাবিক ভাবে পড়াশোনা করতো একরাম আলী। ২০০৯ সালে ১৮ বছর বয়সে হঠ্যৎ একরাম অসুস্থ্য হয়ে পড়েন। পরে পরিবারের লোকজন রাজশাহীতে মানসিক ডাক্তার দিয়ে চিকিৎসা করেন।কিছুদিন সুস্থ্য হলে একরাম এসএসসি পরীক্ষার আগে আবার মানসিক ভারসাম্য হরায়। পরে একরাম আলীকে পাবনা মানসিক হাসপাতালে নিয়ে যায় পরিবার। সেখানে দীর্ঘদিন চিকিৎসা করিয়েও কোনো উপকার না পেয়ে বাড়িতে নিয়ে আসেন। এরপর ১০ বছর আগে পরিবার থেকে একরামকে বিয়ে দেয়। বিয়ের কয়েক মাস পর তার স্ত্রী তাকে ছেড়ে বাবার বাড়িতে চলে যায়। এরপর একরামের মানসিক ভারসাম্যহীন অবস্থান দিন কাটছিল। মাঝে মাঝে বাড়ির জিনিসপত্রসহ বিভিন্ন আসবাপত্র ভাংচুরসহ এলাকার মানুষের মারধর করতে থাকে। পরে এলাকার মানুষের পরামর্শে একরামকে ঘরে শিকল দিয়ে বন্দী করে রাখা হয়। ঘরবন্দী একরাম আলীকে তার মা দেখভাল করতেন। কিন্তু গত দুই বছর আগে তার মায়ের মৃত্যু হলে বর্তমানে তার বাবা তাকে দেখাশোনা করেছেন। বাবা ইব্রাহীম আলী মানুষের জমিতে সারাদিন দিনমজুরের কাজ করেন। সন্ধায় বাড়িতে এসে নিজে রান্না করে সন্তানকে খাওয়ান। বয়স বেড়ে যাওয়ায় বৃদ্ধ বাবা আর কাজ করতে পারে না। ফলে ছেলেকে নিয়ে দুচিন্তায় দিন কাটছে বাবার।
স্থানীয় বাসিন্দা মঞ্জু হোসেন বলেন, একরাম ছোট বেলা শান্ত প্রকৃতির ছিল। স্কুলে যেত, পড়াশোনা করতো। কিস্তু হঠ্যৎ একদিন অসুস্থ্য হয়ে মানসিক ভারসাম্য হারায়। তা বাবা মা অনেক চিকিৎসা কররিয়েন। কিন্তু ভালো হবার কোন লক্ষন হয়নি। বর্তমানে বৃদ্ধ বাবা ছাড়া তাকে দেখার মতো কেউ নেই। অনেক বছর আগে তার বিয়ে দেয়া হয়েছি। কিন্তু পাগল দেখে স্ত্রী বাবার বাড়িতে চলে যায়। এরপর পাগলামি বেড়ে গেলে ঘরে শিকলবন্দী করে রাখা হয়।
বাবা মো. ইব্রাহিম আলী বলেন, ১৮ বছর বয়সে একরাম হঠ্যৎ অসুস্থ্য হয়ে পড়ে। পরে রাজশাহী ও পাবনায় অনেক ডাক্তার দিয়ে চিকিৎসা করিয়েছি। কোনো ভাল হবার লক্ষন দেখিনি। তার চিকিৎসায় অনেক টাকা খরচ করে আজ সর্বশান্ত। আমি ছাড়া সন্তানকে দেখার মতো কেউ নেই। আমার মৃত্যুর পর আমার পাগল সন্তানকে কে দেখবে এই চিন্তায় আছি। আগের মতো কাজ করতে পারি না। কোনো মতে খেয়ে না খেয়ে দিন পার করছি। ইউনিয়ন থেকে কিছু সহযোগিতা পাই, তা দিয়ে কোনো মতে চলে।
তিনি আরও বলেন, উপজেলা থেকে ইউএনও মহোদয় আমার ছেলেকে দেখতে বাড়িতে এসেছিল। তাকে সব রকম সহযোগিতা করবেন বলে আশ্বাস দিয়েছেন তিনি। আমার সন্তানকে যদি উন্নত চিকিৎসা করানো হয় তাহলে কিছুটা সুস্থ্য হতে পারে। আমি উপজেলা প্রশাসনের কাছে আমার ছেলের চিকিৎসার জন্য অনুরোধ করছি।
তেবাড়িয়া ইউনিয়ন পরিষদের ইউপি চেয়ারম্যান ওমর আলী প্রধান বলেন, একরাম আলী কিশোর অবস্থা থেকে মানসিক ভারসাম্যহীন। সে ছাড়া পেলে অস্বাভাবি আচরণ করেন। এ কারণে তার পরিবার ঘরেবন্দী করে তাকে দেখাশোনা করেন। এছাড়াও তাকে ও তার পরিবারকে ইউনিয়ন পরিষদ থেকে সরকারের সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা প্রদান করা হয়।
নাটোর সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) সারমিনা সাত্তার বলেন, ১২ বছর ধরে ঘরেবন্দী এমন খবর শুনে আমি একরাম আলীর বাড়িতে তাকে দেখতে যাই। সে মানসিক ভারসাম্যহীন। বাড়িতে দেখভাল করার মতো তার বৃদ্ধ বাবা ছাড়া তার কেউ নেই। আমি তার সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করেছি।
আমার মনে হয়েছে, তাকে চিকিৎসা দেয়া হলে কিছুটা সুস্থ্য হতে পারে। আমরা সবাই মিলে যদি একরাম আলীর পরিবারের পাশে দাড়াই, তাহলে সে কিছুটা হলেও উপকৃত হবে। বিশেষ করে তার চিকিৎসা হওয়া প্রয়োজন। উপজেলা প্রশাসন সব ধরনের তাকে সহযোগিতা দিয়ে পাশে থাকবে।