স্বৈরাচার সরকারের দোসররা তাদের কুচক্রী পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য দেশের রফতানি আয়ের প্রধান সেক্টর পোশাক শিল্পের ওপর ভর করেছে বলে মন্তব্য করেছে জাতীয় শ্রমিক ঐক্য।
শুক্রবার সকাল ১০টায় ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির সাগর-রুনী মিলনায়তনে গার্মেন্টস শিল্পে বর্তমান পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে আয়োজিত জাতীয় ঐক্যের সংবাদ সম্মেলনে এ মন্তব্য করা হয়।
সংবাদ সম্মেলনে সভাপতিত্ব করেন শ্রমিক ঐক্যের সভাপতি এ এ এম ফয়েজ হোসেন এবং লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন ঐক্যের সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট আতিকুর রহমান।
লিখিত বক্তব্য বলা হয়, ‘স্বৈরাচার শেখ হাসিনার সরকার পতনের কারিগর বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনে বিপ্লবী ছাত্রদের অভিনন্দন জানাচ্ছি। অভিনন্দন জানাচ্ছি এদেশের খেটে খাওয়া শ্রমিক-জনতাকে যারা শিক্ষার্থীদের আহ্বানে রাজপথে স্বৈরাচার পতনের জন্য নিজেদের জীবন উৎসর্গ করতে দ্বিধাবোধ করেননি। আজকের এই দিনে আমরা গভীর শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করছি শহীদ আবু সাঈদ-গার্মেন্টসকর্মী আব্দুল আজিজসহ এ আন্দোলনে শাহাদাতবরণকারী অসংখ্য ছাত্র-জনতাকে। আহতদের দ্রুত সুস্থতা কামনা করছি ও সুচিকিৎসা নিশ্চিতের দাবি জানাচ্ছি। শহীদ ও পঙ্গুত্বদের পরিবারকে উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ দেয়ার জন্য সরকারের কাছে জোর দাবি জানাচ্ছি।’
অ্যাডভোকেট আতিকুর রহমান লিখিত বক্তব্য বলেন, ‘স্বৈরাচার সরকারের পতনের আজ এক মাস অতিক্রান্ত হয়েছে। বিগত এক মাসে পতিত স্বৈরাচার সরকারের দোসররা ক্ষমতা ফিরে পেতে ব্যাকুল হয়ে উঠেছে। তারা জুডিশিয়াল ক্যু, সনাতন ধর্মালম্বীদের উসকে দিয়ে অরাজকতা সৃষ্টির পায়তারা, আনসার বিদ্রোহসহ বিভিন্ন ইস্যু সৃষ্টি করে ছাত্র-জনতার বিপ্লবকে প্রতিবিপ্লবে রূপ দেয়ার নানামুখী ষড়যন্ত্রে মেতে উঠেছে।’
তিনি বলেন, ‘স্বৈরাচারের দোসররা তাদের কুচক্রী পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য এখন দেশের রফতানি আয়ের প্রধান সেক্টর পোশাক শিল্পের ওপর ভর করেছে। পোশাক শিল্প এই মুহূর্তে বাংলাদেশের অর্থনীতির প্রাণশক্তি। রফতানি আয়ের ৮৪ শতাংশ আসে এই খাত থেকে। জিডিপিতে পোশাক শিল্পের অবদান প্রায় ১১ ভাগ। পোশাক শিল্পে প্রায় ৪৪ লাখ শ্রমিক সরাসরি সম্পৃক্ত যার মধ্যে ৬০ শতাংশ নারী শ্রমিক এবং পোশাক শিল্পকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠা অন্যান্য বাণিজ্য মিলিয়ে প্রায় তিন কোটি মানুষের জীবিকা নির্ভর করছে এই খাতের ওপর। এক সময় পোশাক শিল্প ছিল এক মিলিয়ন ডলারের শিল্প। যা আজকে দাঁড়িয়েছে ৪৬ মিলিয়নে। বাংলাদেশ এখন বিশ্বে চীনের পর দ্বিতীয় বৃহত্তম তৈরি পোশাক রফতানিকারক দেশ। অর্থনীতিবান্ধব এ শিল্প আরেকটু পরিকল্পিতভাবে গোছানো সম্ভব হলে খুব তাড়াতাড়ি আমেরিকা ও ইউরোপের বাজারে শীর্ষস্থান অধিকার করবে।’
তিনি আরো বলেন, ‘গার্মেন্টস শিল্পের শ্রমিকরা প্রতিনিয়ত জুলুমের শিকার হচ্ছে। বছরের পর বছর তাদের বেতন ভাতা নামকাওয়াস্তে বাড়ানো হচ্ছে। শ্রমিকরা তাদের ন্যায্য দাবি নিয়ে কথা বলতে গেলে বিগত স্বৈরাচার সরকারের সময় তাদের ওপর পুলিশ ও দলীয় ক্যাডারদের লেলিয়ে দিয়ে সকল আন্দোলনকে স্তমিত করার অপচেষ্টা করা হয়েছে। বিগত দেড় দশকে গার্মেন্টস শ্রমিকের মজুরি যৎসামান্য বেড়েছে। করোনা মহামারী চলাকালীন সময়ে গার্মেন্টস মালিকগণ সরকারের পক্ষ থেকে প্রণোদনা পেলেও তার ভাগ শ্রমিকরা পায়নি। বরং ওই সময়ে চাকরি হারিয়ে হাজারো গার্মেন্টস শ্রমিকরা বেকার হয়েছে। ২০২৩ সালে নভেম্বর-ডিসেম্বর নূন্যতম মজুরির আন্দোলনে পুলিশের গুলিতে গাজীপুরে নারীসহ চারজন শ্রমিককে জীবন দিতে হয়েছে। একই আন্দোলনে অসংখ্য শ্রমিক মারাত্মক আহত হয়ে কর্মশক্তি হারিয়ে ফেলেছে। মিথ্যা মামলার আসামি করা হয়েছে শত শত গার্মেন্টস শ্রমিককে। শ্রমিকদের যৌক্তিক দাবি উপেক্ষা করে ফ্যাসিবাদী সরকারের তল্পিবাহক ও আর্শীবাদপুষ্ট ন্যূনতম মজুরি বোর্ড গার্মেন্টস শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি ১২ হাজার ৫০০ টাকা নির্ধারণ করেছে। যা শ্রমিকরা প্রত্যাখান করেছে।’
তিনি অভিযোগ করেন, ‘গত ১ সপ্তাহ ধরে গার্মেন্টস শিল্পে অস্থিরতা চলছে। একের পর এক গার্মেন্টস কারখানা মালিকগণ বন্ধ করে দিতে বাধ্য হচ্ছেন। ইতোমধ্যে আশুলিয়া-সাভার-গাজীপুরের প্রায় দুই শতাধিক গার্মেন্টস কারখানা বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হওয়ায় বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। এক্ষেত্রে কিছু কারখানা শ্রমিকদের মজুরি-সংক্রান্ত আন্দোলনে বন্ধ হলেও বেশিভাগ কারখানা পরিকল্পিতভাবে দুস্কৃতিকারীদের হামলা-ভাঙচুরের কারণে বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। পরিকল্পিতভাবে গার্মেন্টস শিল্পে অস্থিরতা সৃষ্টি করে বাংলাদেশের শিল্পখাতকে ধ্বংস করার জন্য ফ্যাসিবাদের দোসররা উঠেপড়ে লেগেছে। তাদের প্রধান লক্ষ্য দুটি; এক- গার্মেন্টস শিল্প ধ্বংস করে বাংলাদেশের অর্থনীতিকে পঙ্গু করে দেয়া। দুই- পার্শ্ববর্তী দেশের পরিকল্পনা সফল করা। ফ্যাসিবাদের সরকারের দোসর বিজিএমইএ-এর বিগত নির্বাচনের ভোট ডাকাতির মাস্টার মাইন্ড কিছু নেতা ও তাদের দলীয় স্থানীয় নেতাদের নেতৃত্বে গার্মেন্টস শিল্পে অরাজকতা সৃষ্টি হচ্ছে বলে আমাদের প্রতীয়মান হয়। আওয়ামী লীগ ও শ্রমিক লীগের নেতাকর্মীরা জনরোষের ভয়ে আত্মগোপনে থেকে শ্রমিক নামধারী বহিরাগত সন্ত্রাসীদের দিয়ে গার্মেন্টস শিল্পে অরাজকতা সৃষ্টি করে রাজনৈতিকভাবে পুনর্বাসনের অপচেষ্টা লিপ্ত আছে। এর অংশ হিসেবে তারা কারখানাগুলোতে চাকরির দাবিতে বিভিন্ন বয়সের নারীপুরুষদের পাঠিয়ে চাকরি চাই স্লোগান দিয়ে কারখানাগুলোতে ব্যাপক ভাঙচুর চালিয়েছে।’
তিনি দাবি করেন, ‘আমাদের দেশের প্রকৃত গার্মেন্টস শ্রমিকরা কোনোভাবেই এ হামলার সাথে সম্পৃক্ত নয়। শ্রমিকরা কখনো তাদের কারখানা বন্ধ হোক তা চায় না। আমরা অবিলম্বে গার্মেন্টস শিল্পকে ধ্বংসের পেছনে যারা কলকাঠি নাড়ছে এবং যারা ভাঙচুরের সাথে জড়িত তাদেরকে চিহ্নিত করে আইনের আওতায় আনার জোর দাবি জানাচ্ছি। কারখানাগুলোতে উৎপাদন স্বাভাবিক রাখতে যথাযথ নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য সরকারের প্রতি জোর দাবি জানাচ্ছি। যেসব কারখানা বাস্তবিকভাবে শ্রমিকদের মজুরি নিয়ে অসন্তোষ চলছে তা অবিলম্বে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে সমাধানের জন্য মালিকদের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি। আমরা মনে করি শ্রমিকদের ন্যায্য দাবি আদায় হলে ষড়যন্ত্রকারীদের ঘৃণ্য পরিকল্পনা সফল হবে না। শ্রমিকদের সকল যৌক্তিক ও ন্যায্য দাবির আন্দোলনে জাতীয় শ্রমিক ঐক্য সর্বাত্মকভাবে পাশে থাকবে।’
জাতীয় শ্রমিক ঐক্য সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট আতিকুর রহমান বলেন, ‘জাতীয় শ্রমিক ঐক্য শ্রমিকদের স্বার্থে-দেশের স্বার্থে কাজ করে। এদেশ না থাকলে যেমন শ্রমিকদের বেঁচে অধিকার থাকবে না ঠিক অনুরূপভাবে শ্রমিকদের কর্ম না থাকলে এদেশের অস্তিত্ব বিলীন হয়ে যাবে। দেশপ্রেমিক ও শ্রমিকবান্ধব সংগঠন হিসাবে শ্রমজীবী মানুষ ও দেশের স্বার্থ রক্ষা আমাদের প্রধান দায়িত্ব। আমরা শ্রমিকদের অধিকার রক্ষায় অঙ্গীকারাবদ্ধ। তাই এই ক্রান্তিকালীন সময়ে শ্রমিকদের ন্যায্য দাবি নিয়ে প্রতিনিয়ত মালিকদের সাথে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে আলোচনা চালিয়ে আসছি। আগামী দিনেও শ্রমিকদের ন্যায্য দাবি আদায়ে মালিকদের সাথে আলোচনা করে আমরা ভূমিকা রাখব, ইনশাআল্লাহ।’
তিনি বলেন, ‘গার্মেন্টস শিল্প রক্ষায় সাভার-আশুলিয়া, মিরপুর, ইপিজেড অঞ্চলসহ দেশের সকল পোশাক শিল্প এলাকায় ইন্ডাস্ট্রিয়াল পুলিশ, স্থানীয় আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী এবং দেশপ্রেমিক সেনাবাহিনীকে শ্রমিক ও গার্মেন্টেসের নিরাপত্তা প্রদানের জন্য আমরা আহ্বান জানাচ্ছি এবং জড়িতদের খুঁজে দ্রুত সময়ে আইনের আওতায় আনার জোর দাবি জানাচ্ছি। একই সাথে শ্রমিক-জনতাকেও তাদের কর্মক্ষেত্রকে সুরক্ষিত রাখার আহ্বান জানাচ্ছি।’
সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ শ্রমিক কল্যাণ ফেডারেশনের সহ-সাধারণ সম্পাদক আব্দুস সালাম, জাতীয় গার্মেন্টস শ্রমিক জোট বাংলাদেশের সভাপতি মাহতাব উদ্দীন শহীদ, বাংলাদেশ রেলওয়ে এমপ্লয়ীজ লীগের সভাপতি আক্তারুজ্জামান, বাংলাদেশ অটোরিক্সা হালকাযান পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক মো: গোলাম ফারুক, ন্যাশনাল ওয়াকার্স ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক জয়নাল আবেদীন জনি, জাতীয় গার্মেন্টস শ্রমিক কল্যাণ ফেডারেশনের সভাপতি শফিকুল ইসলাম, বাংলাদেশ প্রগতিশীল গার্মেন্টস শ্রমিক ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক কামরুন নাহার, বাংলাদেশ দর্জি শ্রমিক ফেডারেশনের সহ-সভাপতি অ্যাডভোকেট আলমগীর হোসাইন, বাংলাদেশ প্রগতিশীল নির্মাণ শ্রমিক ফেডারেশনের সভাপতি সহ-সভাপতি নুরুল আমিন, বাংলাদেশ সংবাদপত্র কর্মচারী ফেডারেশনের যুগ্ম মহাসচিব তানভীর হোসাইন, বাংলাদেশ শ্রমিক অধিকার পরিষদের সাধারণ সম্পাদক সোহেল রানা ও লোকাল গার্মেন্টস শ্রমিক ইউনিয়নের সভাপতি মীর মো: জুলহাস প্রমুখ।
প্রেস বিজ্ঞপ্তি