টানা তিন দিনের বৃষ্টি ও উজান থেকে নেমে আসা ঢলে সিলেটে চলমান দ্বিতীয় দফা বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে। চলমান এ বন্যায় মহানগর ও জেলাজুড়ে প্রায় সাত লাখ মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন। এর মধ্যে শুধু সিলেট নগরীর ২১টি ওয়ার্ডেই অর্ধলক্ষাধিক মানুষ বন্যার কবলে পড়েছে।
মঙ্গলবার মধ্যরাতে জেলা প্রশাসনের দেয়া সর্বশেষ তথ্যে এসব জানানো হয়েছে।
২০ দিনের মাথায় দ্বিতীয় দফা বন্যায় আক্রান্ত হয়েছে সিলেট। গত ২৭ মে সিলেটে আগাম বন্যা পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। এতে জেলার সব উপজেলার সাড়ে সাত লাখ মানুষ আক্রান্ত হন। সেই বন্যার পানি পুরোপুরি নামার আগেই গত শনিবার (১৫ জুন) আবারো বন্যাকবলিত হয় সিলেট।
ঈদের দিন (১৭ জুন) ভোর থেকে সিলেটে শুরু হয় ভারী বর্ষণ, সাথে নামে পাহাড়ি ঢল। সকাল হতে না হতেই তলিয়ে যায় মহানগরের অনেক এলাকা। জেলার বিভিন্ন স্থানেও সৃষ্টি হয় বন্যা পরিস্থিতি। সোমবার বিকেলে বৃষ্টি থামলে ধীরে ধীরে পানি কিছুটা কমে, কিন্তু মঙ্গলবার ভোর থেকে আবারো শুরু হয় বৃষ্টি, উজানেও প্রচুর বৃষ্টিপাত হয়। ফলে হু হু করে বাড়তে থাকে সিলেটের সব নদ-নদীর পানি।
আজ বুধবার সকাল ৯টা পর্যন্ত তিনটি নদীর পানি ছয় পয়েন্টে বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।
মঙ্গলবার (১৮ জুন) মধ্যরাত পর্যন্ত জেলা প্রশাসনের তথ্যমতে, সিলেট মহানগরীসহ ১৩টি উপজেলায় ছয় লাখ ৭৫ হাজার ৯৩৭জন মানুষ পানিবন্দি রয়েছেন। এর মধ্যে সিলেট মহানগরীর ৪২টি ওয়ার্ডের মধ্যে ২১টি ওয়ার্ডের ৫০ হাজার মানুষ পানিবন্দি রয়েছেন। জেলা ও মহানগর মিলিয়ে ৬২৭টি আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়েছে। এর মধ্যে মহানগরে ৮০টি। এসব আশ্রয়কেন্দ্রে ১৭ হাজার ২৮৫ জন মানুষ আশ্রয় নিয়েছেন। তবে, বেশিরভাগ মানুষ নিজের ঘরবাড়ি ছেড়ে আশ্রয়কেন্দ্রে যেতে ইচ্ছুক নন। অনেকেই আশ্রয় নিয়েছেন প্রতিবেশীদের উঁচু বাসাবাড়ি বা আত্মীয়-স্বজনের ঘরে।
জেলার ১৩টি উপজেলায় এক হাজার ৩২৩টি গ্রাম বন্যার পানিতে প্লাবিত হয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হয়েছে গোয়াইনঘাট, জৈন্তাপুর, গোলাপগঞ্জ, কোম্পানীগঞ্জ, কানাইঘাট ,জকিগঞ্জ, বিশ্বনাথ ও ওসমানীনগর উপজেলা।
পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) সিলেট কার্যালয় সূত্র বুধবার সকাল ৯টায় জানিয়েছে, এ সময় সুরমা নদীর পানি কানাইঘাট পয়েন্টে বিপৎসীমার ৯১ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। একই নদীর পানি সিলেট পয়েন্টে বইছে বিপৎসীমার ৩৭ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে। কুশিয়ারা নদীর পানি আমলশীদ পয়েন্টে বিপৎসীমার ৪৬ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। একই নদীর পানি ফেঞ্চুগঞ্জ পয়েন্টে ৯২ ও শেরপুর পয়েন্টে বিপৎসীমার ১২ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে বইছে। এছাড়া সারি-গোয়াইন নদীর পানি সারিঘাট পয়েন্টে বিপৎসীমার ০.৯ সে.মি সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।
বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, সিলেটজুড়ে ২০২২ সালের মতো ভয়াবহ বন্যা পরিস্থিতির সৃষ্টি হতে যাচ্ছে। মহানগরের শাহজালাল উপশহর, যতরপুর, মেন্দিবাগ, শিবগঞ্জ, রায়নগর, সোবহানীঘাট, কালিঘাট, কামালগড়, মাছিমপুর, তালতলা, জামতলা, কাজিরবাজার, মদিনা মার্কেট, আখালিয়া, মেজরটিলা ও দক্ষিণ সুরমা এলাকার লাউয়াই, বরইকান্দি, আলমপুরসহ বিভিন্ন এলাকায় অনেকের বাসাবাড়িতে গলা পর্যন্ত পানি। নিচু এলাকাগুলোর কলোনি বা বাসাবাড়ি প্রায় পুরোটাই তলিয়ে গেছে বন্যার পানিতে। এতে চরম বিপাকে এসব এলাকার মানুষ। অনেকে গেছেন আশ্রয়কেন্দ্রে, আবার অনেকে নিজের বাসাবাড়ি ছেড়ে যেতে চাচ্ছেন না।
অপরদিকে, সিলেট সদর, গোয়াইনঘাট, কোম্পানীগঞ্জ ও জৈন্তাপুরসহ কয়েকটি উপজেলার গ্রামীণ অনেক রাস্তাঘাট তলিয়ে যাওয়ায় সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। অনেক কৃষিজমির ফসল তলিয়ে গেছে, ভেসে গেছে পুকুরের মাছ।
সিলেট আবহাওয়া অফিস জানিয়েছে, মঙ্গলবার সকাল ৬টা থেকে বুধবার ৬টা পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় সিলেটে এক শ’ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়েছে। এর মধ্যে বুধবার সকাল ৬টা থেকে ৯টা পর্যন্ত ৫৫ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে। আগামী কয়েকদিন সিলেটে টানা বৃষ্টির পূর্বাভাস দিয়েছে সংস্থাটি।
জেলা প্রশাসন সূত্র জানায়, সিলেটে বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হওয়ায় পানিবন্দি লোকদের উদ্ধারের লক্ষ্যে উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে প্রয়োজনীয় তৎপরতা চালানো হচ্ছে। বন্যার সার্বিক পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণের জন্য জেলা প্রশাসকের কার্যালয় এবং উপজেলা নির্বাহী অফিসারের কার্যালয়গুলোতে কন্ট্রোল রুম স্থাপন করা হয়েছে। প্রতিটি উপজেলায় ডেডিকেটেড অফিসার নিয়োগের পাশাপাশি প্রতিটি ইউনিয়নে ট্যাগ অফিসার নিয়োগ করা হয়েছে। বন্যার্তদের স্বাস্থ্যসেবা প্রদানের জন্য ইউনিয়নভিত্তিক মেডিক্যাল টিম গঠন করে কার্যক্রম চালানো হচ্ছে। আগামী তিন দিন সিলেট অঞ্চলে ভারী বর্ষণের পূর্বাভাস রয়েছে। এ অবস্থা চলমান থাকলে বন্যা পরিস্থিতির আরো অবনতি হবে।
এদিকে সিলেটের বন্যাকবলিত এলাকা পরিদর্শন করতে গিয়েছেন দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী মো: মহিববুর রহমান এমপি। আজ সকালে বিমানযোগে সিলেটে পৌঁছে বিভিন্ন উপজেলার বন্যাকবলিত এলাকা পরিদর্শন করেন।
মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের নিয়ে এক দিনের সফরে বন্যাকবলিত এলাকা পরিদর্শন ও আক্রান্তদের মাঝে ত্রাণ বিতরণ করার কথা রয়েছে প্রতিমন্ত্রীর। বুধবার রাতেই বিমানযোগে সিলেট ত্যাগ করবেন তিনি।
সূত্র : ইউএনবি