সাইক্লোন-করোনাভাইরাস : সংক্রমণ এড়িয়ে কীভাবে মানুষকে আশ্রয় কেন্দ্রে নেয়া যাবে?
করোনাভাইরাস মহামারির মধ্যে ধেয়ে আসছে সুপার সাইক্লোন আম্পান। এবার এমন ভিন্ন এক পরিস্থিতিতে ঘূর্ণিঝড়ের আঘাত থেকে মানুষের জীবন রক্ষার প্রস্তুতিতে হিমশিম খাচ্ছেন উপকূলের জেলাগুলোর মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তা এবং স্বেচ্ছাসেবকরা।
সুপার সাইক্লোন আম্পানের আঘাত সামলাতে বাংলাদেশের উপকূলে লাখ লাখ মানুষকে আশ্রয় কেন্দ্রে নেয়ার ক্ষেত্রে করোনাভাইরাস সংক্রমণের ঝুঁকি এড়ানোর বিষয়টি বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
ঘূর্ণিঝড় আম্পান বুধবার বাংলাদেশের উপকূলে আঘাত করবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। বঙ্গোপসাগরে এরকম ঝড় এই শতাব্দীতে প্রথম বলে ভারতের আবহাওয়া বিভাগ হুঁশিয়ারি দিয়েছে।
কর্মকর্তারা বলেছেন, লোকজনকে আশ্রয় কেন্দ্রগুলোতে আনা এবং অনেক মানুষকে একসাথে রাখার ক্ষেত্রে সামাজিক দূরত্ব রক্ষার বিভিন্ন ব্যবস্থা নেয়া হলেও বাস্তবতা বেশ কঠিন।
উপকূলের ১৩ টি জেলায় ২০ লাখ মানুষকে আশ্রয় কেন্দ্রে নেয়ার টার্গেট করা হলেও শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত মাত্র কয়েক হাজার লোককে নেয়া সম্ভব হয়েছে বলে কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।
সরকারের ঘূর্ণিঝড় প্রস্তুতি কর্মসূচির অপারেশন বিভাগের পরিচালক নূর ইসলাম খান বলেছেন, আশ্রয় কেন্দ্রে মানুষকে নেয়া এবং সেখানে নেয়ার পর সামাজিক দূরত্ব রক্ষা করা কতটা সম্ভব হবে তা নিয়ে তাদেরই সন্দেহ রয়েছে। তবে কিছু ব্যবস্থা নেয়ার চেষ্টা তারা করছেন।
তিনি বলছেন, ”এইবার আমাদের কাছে খুবই কঠিন, কারণ করোনা সংক্রান্ত কারণে সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে তাদের আনা, শেল্টারে নিয়ে সেখানে রাখা এবং ব্যবস্থাপনা করা কঠিন হবে। আগে যেমন জোরাজুরি করতে পারতো, বৃদ্ধদের কোলে করে নিয়ে আসতে পারতো, ধরে নিয়ে আসতো – সেটা এবার হবে না হয়তো। কিন্তু আন্তরিকতার কোন ঘাটতি নেই। ”
”আর যে মানুষরা আসবে, তাদের মধ্যে দুই-একজন করোনা আক্রান্ত থাকতেও পারে। হয়তো তারা ঢাকা থেকে যেতে পারে, নারায়ণগঞ্জ থেকে যেতে পারে। তখন সে আসলে তাকে ঠিকমতো পরীক্ষা করা, তাপমাত্রা দেখা – এই বিষয়গুলো আমাদের কাছে ভীষণ চ্যালেঞ্জিং হয়ে দাঁড়াবে।”
তবে তারা সাধ্যমত সব ব্যবস্থা গ্রহণের চেষ্টা করছেন বলে জানিয়েছেন।
সুপার সাইক্লোনের আঘাতের জন্য উপকূলের যে এলাকাগুলোকে সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ হিসাবে চিহ্নিত করা হয়েছে, তার মধ্যে সুন্দরবন লাগোয়া সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার গাবুরা এবং পদ্মপুকুর ইউনিয়নে গতকাল থেকেই মানুষকে আশ্রয় কেন্দ্রে নেয়া শুরু হয়।
পদ্মপুকুর এলাকায় একটি কেন্দ্রে পরিবারের সদস্যদের নিয়ে আশ্রয় নেয়া ফরিদা আকতার বলেছেন, আশ্রয়কেন্দ্রে আগের ঘূর্ণিঝড়ের তুলনায় কম লোককে নেয়া হয়েছে।
এরপরও করোনাভাইরাসের সংক্রমণের ভয় কাজ করছে তাদের মাঝে।
”এহানে দুই তিনশো লোক এরি মধ্যে আসি গেছে, আরো লোক আসতিছে। তার মধ্যি আমরা থাকতিছি। একেক রুমে ৩০জন/৪০ জন করে থাকতিছি।” বলছিলেন ফরিদা আকতার।
ঝুঁকিপূর্ণ পদ্মপুকুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আতাউর রহমান বলেছেন, শেষ মুহূর্তে আশ্রয়কেন্দ্রে লোকজন আসছে। তাদের ইউনিয়নে আশ্রয় কেন্দ্রের সংখ্যা বাড়ানো হলেও অনেক মানুষের ভিড়ে করোনাভাইরাসের ঝুঁকি রয়েছে বলে তিনি মনে করেন।
”মানুষ যেভাবে আসা শুরু হইছে, তাতে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা আমাদের জন্য খুব কঠিন ব্যাপার। আটটা বড় বড় রুম আছে। অন্যান্য সময় সেখানে আমরা এক হাজার মানুষ রাখি। কিন্তু এবার তো অর্ধেকেরও কম হবে। এখানে তিনশো সাড়ে তিনশো মানুষ ওঠাবো, তার বেশি ওঠাতে চাচ্ছি না।”
তিনি জানান, পাশে একটি দোতলা মাদ্রাসা আছে, সেখানে অনেককে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে।
কর্মকর্তারা বলেছেন, মানুষ সহজে ঘর বাড়ি ছেড়ে আশ্রয়কেন্দ্রে আসতে চায়না। তারা শেষ সময় পর্যন্ত অপেক্ষা করে।
মানুষের এমন মানসিকতার সাথে এবার যোগ হয়েছে করোনাভাইরাসে সংক্রমণের ভয়।
সে কারণেও এবার স্বেচ্ছাসেবকরাও আগের মতো জোর জবরদস্ত না করে মানুষকে একটু সময় দিয়ে মূলত আজ থেকে আশ্রয়কেন্দ্রগুলোতে নেয়ার কাজ শুরু করা হয়।
উপকূলীয় একটি জেলা বাগেরহাটের জেলা প্রশাসক মামুনুর রশিদ বলেছেন, করোনাভাইরাসের ঝুঁকি এড়ানোর জন্য আশ্রয়কেন্দ্রে বিভিন্ন ব্যবস্থা সম্পর্কেও তারা লোকজনের কাছে দু’দিন ধরে তুলে ধরেছেন।
তিনি বলছেন, ”আমরা স্বাস্থ্য ব্যবস্থা নেয়ার বিষয়গুলো মানুষের কাছে তুলে ধরেছি, তাদের আশ্বস্ত করেছি। মানুষ আশ্রয় কেন্দ্রগুলোয় আসতে শুরু করেছে।”
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা এবং ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী ডা: এনামুর রহমান বলেছেন, উপকূলে সাড়ে পাঁচ হাজার আশ্রয় কেন্দ্র আছে। সেখানে সামাজিক দূরত্ব রক্ষার জন্য স্কুল-কলেজ মাদ্রাসার ভবন নিয়ে আশ্রয়কেন্দ্রের সংখ্যা বাড়িয়ে ১২০৭৮টি করা হয়েছে। এরপরও বাস্তবতা অনেক কঠিন বলে তিনিও উল্লেখ করেছেন।
তিনি বলছেন, ”এটা একেবারে বাস্তব সত্য কথা যে, বলা অনেক সহজ, কিন্তু দুইদিনের মধ্যে ২০ লক্ষ লোককে তাদের ঘরবাড়ি থেকে আশ্রয় কেন্দ্রে নেয়া, তাদের স্বাস্থ্য বিধি মেনে রাখা-আমরা সুন্দর সুন্দর পরিকল্পনা করি, কিন্তু মাঠ পর্যায়ে এটা বাস্তবায়ন করা খুব কঠিন কাজ।”
”তারপরে আজকেও আমরা আন্তঃমন্ত্রণালয় মিটিং করে, সমস্ত মন্ত্রণালয়ের মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। সেই সঙ্গে ভলান্টিয়ারদের বলা হয়েছে, তারা যেন এই স্বাস্থ্য বিধি মানার জন্য জনগণকে উদ্বুদ্ধ করেন।”
প্রতিমন্ত্রী দাবি করেছেন, শেষপর্যন্ত টার্গেট অনুযায়ী ২০ লাখ মানুষকে আশ্রয়কেন্দ্রে নেয়া সম্ভব হবে বলে তিনি মনে করছেন।