
আহমেদ জহুর : আল মাহমুদকে সবাই কবি-সাহিত্যিক হিসেবে চিনেন। কিন্তু তিনি একজন নামকরা সাংবাদিক ও মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। ১৯৭১ সালে তিনি মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন এবং যুদ্ধের পরে দৈনিক গণকণ্ঠ-এ সম্পাদক হিসেবে যোগ দেন। সম্পাদক থাকাকালে সরকারের বিরুদ্ধে লেখার কারণে তিনি এক বছরের জন্য কারাবরণ করেন।
আধুনিক বাংলা সাহিত্যের অন্যতম সাধক কবি আল মাহমুদের আজ ৮৬তম জন্মবার্ষিকী। তিনি ১৯৩৬ সালের ১১ জুলাই ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার মোড়াইল গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন এবং ২০১৯ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি তিনি মৃত্যুবরণ করেন। তাঁকে শ্রদ্ধাঞ্জলি।
আল মাহমুদের পুরো নাম মীর আবদুস শুকুর আল মাহমুদ। তিনি একাধারে কবি, ঔপন্যাসিক, প্রাবন্ধিক, ছোটগল্প লেখক, শিশু-সাহিত্যিক এবং সাংবাদিক ছিলেন। বিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয়াংশে সক্রিয় থেকে তিনি আধুনিক বাংলা কবিতাকে নতুন আঙ্গিকে, চেতনায় ও বাক্ভঙ্গীতে বিশেষ ভাবে সমৃদ্ধ করেছেন। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে সম্মুখ সমরেও অংশ নিয়েছেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পরে প্রতিষ্ঠিত সরকার বিরোধী হিসেবে পরিচিত দৈনিক গণকণ্ঠ পত্রিকার সম্পাদক (১৯৭২-১৯৭৪) ছিলেন। ১৯৫০-এর দশকে যে ক’জন লেখক বাংলা ভাষা আন্দোলন, জাতীয়তাবাদ, রাজনীতি, অর্থনৈতিক নিপীড়ন এবং পশ্চিম পাকিস্তানি সরকার বিরোধী আন্দোলন নিয়ে লিখেছেন তাদের মধ্যে আল মাহমুদ ছিলেন অন্যতম।
শিক্ষাজীবন….
আল মাহমুদ কুমিল্লা জেলার দাউদকান্দির সাধনা হাই স্কুল ও পরে চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড হাইস্কুলে পড়ালেখা করেন। মূলত এ সময় থেকেই তাঁর লেখালেখির শুরু। বেড়ে উঠেছেন ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়। তিনি মধ্যযুগীয় প্রণয়োপাখ্যান, বৈষ্ণব পদাবলি, রবীন্দ্রনাথ ও নজরুল প্রমুখের সাহিত্য পাঠ করে ঢাকায় আসার পর কাব্য সাধনা শুরু করেন এবং সাফল্য লাভ করেন।
কর্মজীবন….
সংবাদপত্রে লেখালেখির সূত্র ধরে ১৯৫৪ সালে আল মাহমুদ ঢাকায় আসেন। সমকালীন বাংলা সাপ্তাহিক পত্র-পত্রিকার মধ্যে কবি আব্দুর রশীদ ওয়াসেকপুরী সম্পাদিত ও নাজমুল হক প্রকাশিত সাপ্তাহিক ‘কাফেলা’য় লেখালেখি শুরু করেন। পাশাপাশি দৈনিক মিল্লাত-এ প্রুফ রিডার হিসেবে তিনি সাংবাদিকতা জগতে প্রবেশ করেন। ১৯৫৫ সাল কবি আব্দুর রশীদ ওয়াসেকপুরী কাফেলার চাকরি ছেড়ে দিলে সেখানে সম্পাদক হিসেবে যোগ দেন।
আল মাহমুদ ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন এবং যুদ্ধের পরে দৈনিক গণকণ্ঠ-এ সম্পাদক হিসেবে যোগ দেন। সম্পাদক থাকাকালে তিনি সরকারের বিরুদ্ধে লেখার কারণে এক বছরের জন্য কারাবরণ করেন। ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের পর গল্প লেখার দিকে মনোযোগী হন। ১৯৭৫ সালে তাঁর প্রথম ছোটগল্প গ্রন্থ ‘পানকৌড়ির রক্ত’ প্রকাশিত হয়। পরে ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু তাঁকে শিল্পকলা একাডেমীর গবেষণা ও প্রকাশনা বিভাগের সহপরিচালক পদে নিয়োগ দেন। দীর্ঘদিন দায়িত্ব পালনের পর পরিচালক হন এবং পরিচালক হিসেবেই ১৯৯৩ সালে অবসর গ্রহণ করেন।
সাহিত্যজীবন….
১৯৫৪ সালে ১৮ বছর বয়স থেকে তাঁর কবিতা প্রকাশ পেতে থাকে। ঢাকা থেকে প্রকাশিত সিকান্দার আবু জাফর সম্পাদিত সমকাল পত্রিকা এবং কলকাতার নতুন সাহিত্য, চতুষ্কোণ, ময়ূখ, কৃত্তিবাস ও বুদ্ধদেব বসু সম্পাদিত ‘কবিতা’ পত্রিকায় লেখালেখির সুবাদে ঢাকা-কলকাতার পাঠকদের কাছে তাঁর নাম ছড়িয়ে পড়ে এবং তাঁকে নিয়ে আলোচনার সূত্রপাত হয়। কাব্যগ্রন্থ লোক লোকান্তর (১৯৬৩) সর্বপ্রথম তাঁকে স্বনামধন্য কবিদের সারিতে জায়গা করে দেয়। এরপর কালের কলস (১৯৬৬), সোনালি কাবিন (১৯৬৬), মায়াবী পর্দা দুলে উঠো (১৯৬৯) কাব্যগ্রন্থগুলো তাঁকে প্রথম সারির কবি হিসেবে সুপ্রতিষ্ঠিত করে। ১৯৯৩ সালে বের হয় তাঁর প্রথম উপন্যাস কবি ও কোলাহল।
আধুনিক বাংলা কবিতার শহরমুখি প্রবণতার মধ্যেই তিনি ভাটি অঞ্চলের জনজীবন, গ্রামীণ আবহ, নদীনির্ভর জনপদ, চরাঞ্চলের জীবনপ্রবাহ এবং নরনারীর চিরন্তন প্রেম-বিরহকে কবিতায় অবলম্বন করেন। নারী ও প্রেমের বিষয়টি তাঁর কবিতায় ব্যাপকভাবে এসেছে। উদ্দীপনা সৃষ্টিকারী হিসেবে নারীর যৌনতা, আকাঙ্ক্ষা ও ভোগ-লালসাকে শিল্পের অংশ হিসেবেই দেখিয়েছেন। আধুনিক বাংলা ভাষার প্রচলিত কাঠামোর মধ্যে স্বাভাবিক স্বতঃস্ফূর্ততায় আঞ্চলিক শব্দের প্রয়োগ তাঁর অনন্য কীর্তি।
১৯৬৮ সালে ‘লোক লোকান্তর’ ও ‘কালের কলস’ নামে দুটি কাব্যগ্রন্থের জন্য তিনি বাংলা একাডেমি পুরস্কার লাভ করেন। তাঁর সবচেয়ে সাড়া জাগানো সাহিত্যকর্ম ‘সোনালি কাবিন’। ১৯৯০-এর দশক থেকে তাঁর কবিতায় বিশ্বস্রষ্টার প্রতি বিশ্বাস উৎকীর্ণ হতে থাকে। এজন্য তিনি অতি প্রগতিশীলদের সমালোচনার মুখোমুখি হন। ১৯৯৩ সালে বের হয় তাঁর প্রথম উপন্যাস কবি ও কোলাহল। কোনো কোনো তাত্ত্বিকের ব্যাখ্যা অনুযায়ী, বিশ্বাসগ্রস্ততার কারণে তাঁর বেশকিছু কবিতা লোকায়তিক সাহিত্যদর্শন দৃষ্টান্তবাদ দ্বারা অগ্রহণযোগ্য। তবে একথাও সত্য, কবিতায় দর্শন থাকে, কিন্তু দর্শন দ্বারা কবিতা নিয়ন্ত্রিত নয়, কবিতা আবেগের কারবার।
উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ….
লোক লোকান্তর (১৯৬৩), কালের কলস (১৯৬৬), সোনালী কাবিন (১৯৬৬), মায়াবী পর্দা দুলে ওঠো (১৯৭৬), আরব্য রজনীর রাজহাঁস, বখতিয়ারের ঘোড়া, অদৃশ্যবাদীদের রান্নাবান্না, Al Mahmud In English, দিনযাপন, দ্বিতীয় ভাঙ্গন, একটি পাখি লেজ ঝোলা, পাখির কাছে ফুলের কাছে, আল মাহমুদের গল্পসমগ্র, প্রেমের গল্প, যেভাবে বেড়ে উঠি, আল মাহমুদের কিশোর সমগ্র, গন্ধ বনিক, কবির আত্নবিশ্বাস, কবিতাসমগ্র, কবিতাসমগ্র-২, পানকৌড়ির রক্ত, সৌরভের কাছে পরাজিত, ময়ূরীর মুখ, না কোন শূন্যতা মানি না, নদীর ভেতরের নদী, পাখির কাছে , ফুলের কাছে, প্রেম ও ভালোবাসার কবিতা, প্রেম প্রকৃতির দ্রোহ আর প্রার্থনা, প্রেমের কবিতা সমগ্র, বিচূর্ণ আয়নায় কবির মুখ, উপন্যাস সমগ্র-১, উপন্যাস সমগ্র-২, উপন্যাস সমগ্র-৩, তোমার গন্ধে ফুল ফুটেছে (২০১৫), ছায়ায় ঢাকা মায়ার পাহাড় (রূপকথা), ত্রিশেরা, উড়াল কাব্য।
পুরস্কার, সম্মাননা….
বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার (১৯৬৮), জয় বাংলা পুরস্কার (১৯৭২), হুমায়ুন কবীর স্মৃতি পুরস্কার (১৯৭২), জীবনানন্দ স্মৃতি পুরস্কার (১৯৭২), কাজী মোতাহার হোসেন সাহিত্য পুরস্কার (১৯৭৬), কবি জসীম উদ্দিন পুরস্কার, ফিলিপস সাহিত্য পুরস্কার (১৯৮৬), মহান একুশে পদক (১৯৮৬), নাসির উদ্দিন স্বর্ণপদক (১৯৯০), ভানুসিংহ সম্মাননা পদক (২০০৪) এবং লালন পুরস্কার (২০১১)।
© আহমেদ জহুর, কবি, সাংবাদিক ও প্রাবন্ধিক