sliderস্থানীয়

সমাজ বদলের লড়াকু সৈনিক একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা ডা: চিত্ত রঞ্জন সাহা

মো. নজরুল ইসলাম, মানিকগঞ্জ প্রতিনিধি : আমরা জানি বাংলাদেশ জন্মের রাজনৈতিক ও সামাজিক ইতিহাসের মাইল ফলক হয়ে আছে গেল শতকরে ষাটের দশকটি। এই দশকেই এদেশের ছাত্র সমাজ গণবিরোধী শিক্ষা কমিশনের বিলটি বাতিলের দাবিতে আন্দালন গড়ে তোলে, এই দশকেই ধর্মবাদি পাকিস্তানি রাষ্ট্র ব্যাবস্থার বিপরীতে ভাষাভিত্তিক বাঙালী জাতীয়তবাদের উন্মেষ ঘটে। এই দশকেই আঞ্চলিক স্বায়ত্বশাসনের ’ম্যাগনাকার্ট’ হিসেবে পরিচিত ৬ দফা কর্মসূচি ঘোষিত হয়। এই দশকেই গণঅভুথ্থানের মুখে প্রবল প্রতাপশালী শাসক আউব খান বিদায় নিতে বাধ্য হন। বাংলাদেশের প্রগতিশীল রাজনৈতিক ও ছাত্র আন্দোলনও বিস্তৃতি পায় এই দশকটিতে। সেই সময় কমিউনিস্ট পার্টি ছিলো নিষিদ্ধ। তাই ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ) ও ছাত্র ইউনিয়ন হয়ে ওঠে রাজনীতির অন্যতম নিয়ামক শক্তি।
সেই অগ্নিগর্ভের সময়কালে মানিকগঞ্জের বামপন্থি আন্দোলনের ঐতিহ্যবাহী বেতিলা অঞ্চলের বাংগরা গ্রামের ঐতিহ্যবাহী সাহা পরিবারে কীর্তিমান পুরুষ একজন ডা: চিত্ত রঞ্জন সাহ। তার পিতা মৃত ওপেন্দ্র মোহন সাহা, মাতা মৃত গৌড়ী দাসী সাহা। তিনি বৃটিশ আমলে ০৭ জুলাই-১৯২৮ সালে জন্মগ্রহন করেন। পাকিস্তান আমলেই তারা ৮৬ গঙ্গাধরপট্টি দেবেন্দ্র কলেজ সংলগ্ন, মানিকগঞ্জের বাসায় বসবাস করেন। তার স্ত্রী প্রতিমা রানী সাহা (প্রয়াত)। তিনি সংসার জীবনে তিন পুত্র ও এক কন্যা। রেখে পরলোকগমন করেন। বড় পুত্র ডা: সমীর সাহা (প্রয়াত), ২য় পুত্র ডা: সুবীর সাহা, তৃতীয় পুত্র ডা: প্রবীর সাহা ও একমাত্র কন্যা স্কুল শিক্ষক মালা সাহা।
তার ছোট পুত্র প্রবীর সাহা বলেন-তিনি ছোটবেলা থেকেই ডানপিটে সাংগঠনিক ও পরোপকারি স্বভাবের ছিলেন। প্রাথমিক শিক্ষার হাতেখড়ি বেতিলা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকেই গ্রহন করেন। তারপর ১৯৫৫ সালে মানিকগঞ্জ মডেল হাই স্কুল থেকে এসএসসি পাশ করেন। মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষাকাল থেকেই তিনি প্রগতিশীল ছাত্র সংগঠন ছাত্র ইউনিয়নের সাথে যুক্ত হয়ে রাজনীতির হাতেখড়ি গ্রহন করেন। রাজনৈতিকভাবে সৈয়দ আনোয়ার আলী চেধুরী ও কমরেড প্রমথ নাথ সরকারদেও সাথে ছিল তার আদর্শিক বন্ধুত্ব। তারপর চট্রগ্রাম সরকারি কলেজ থেকে এইএসসি ও চট্রগ্রাম ডেন্টাল কলেজ থেকে দন্ত চিকিৎসায় ডিপ্লোমা ডিগ্রী অর্জন করেন। তিনি ১৯৭০ সালের আগ পর্যন্ত চট্রগ্রাম অঞ্চলে এন্টর্নি ও সিনিয়র ডাক্তারদেও সাথে দন্ত চিকিৎসা সেবা দেন। তারপর ১৯৭০ সাল থেকে মানিকগঞ্জ শহরে চিত্ত সাহা দাত ঘর নাম দিয়ে চেম্বার শুরু করেন। সেই থেকেই তিনি মানিকগঞ্জে দন্ত চিকিৎসায় একচ্ছত্র আধিপাত্য বিস্তার লাভ করেন এবং তার পরিবারে প্রায় সকলেই দন্ত চিকিৎসা পেশায় আসীন থাকায় ”ডা: চিত্ত সাহা দাত ঘর” এর ঐতিহ্য বাজায় রাখতে নিরলসভাবে দন্ত চিকিৎসা সেবা দিয়ে যাচ্ছেন।
১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধে অব: ক্যাপ্টিন আব্দুল হালিম চৌধুরীর নেতৃত্বে স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশগ্রহন করেন। তিনি বেতিলা হাই স্কুল প্রতিষ্ঠায় জীবনের মূল্যবান সময় ব্যায় করেন। তিনি বাংলাদেশ ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ মোজাফফর) এর প্রতিষ্ঠাকালীন সময় থেকে ন্যাপের একজন একনিষ্ঠকর্মী হিসেবে কাজ করেছেন। তিনি দীর্ঘ সময় ন্যাপ মানিকগঞ্জ জেলা কমিটির সাধারন সম্পাদক এর দায়িত্ব পালন করেন। তার বাংগরা গ্রামের প্রতিবেশী অধ্যাপক মনোয়র হোসেন বলেন- বৃটিশ আমল থেকেই তাদের পরিবার ছিল প্রগতিশীল ও বিপ্লবী। বাংলাদেশের অনেক বামপন্থী জাতীয় নেতারা এই বাড়িতে পদচারণা করেছেন। বিশেষ করে স্বাধীনতার আগে ও পরে কমিউনিস্ট পার্টি যখন নিষিদ্ধ ছিল তখন তাার বাসবভনই ছিল ন্যাপ কমিউনিস্ট পার্টি ও ছাত্র ইউনিয়নের গোপন আশ্রয়স্থল ও রাজনৈতিক চর্চা কেন্দ্র। তাদের বাড়িতে সমাজ পরিবর্তনের রাজনৈতিক এই আড্ডায় মিলিত হওয়া জাতীয় নেতৃত্বের মধ্যে কমরেড মনি সিংহ, অধ্যাপক মোজাফফর আহমেদ, কমরেড বারিণ দত্ত, জ্ঞান চক্রবর্তী, জিতেন ঘোষ, পংকজ ভট্রাচার্য্য, মতিয়া চৌধুরী, সাইফুদ্দিন আহমেদ মানিক, কমরেড নূহ উল আলম লেনিনসহ আরো অসংখ্য নেতাকর্মীরা তার বড়ীসহ এই জনপদে আগমন করেছেন।
সাবেক ন্যাপ নেতা ও বিশিষ্ট সমাজকর্মী কমরেড ইকবাল হোসেন কচি বলেন আমাদের শ্রদ্ধাভাজন নেতা সৈয়দ আনোয়ার আলী চৌধুরীর মৃত্যুর পর বামপন্তি রাজনৈতিক চর্চার ভরসা ছিলেন ডা: চিত্ত সাহা ও কমরেড প্রমথ নাথ সরকার। প্রমথ নাথ সরকার অনেক বেদনা নিয়ে ভারতে গিয়ে চিরবিদায় নিলেন এবং ডা: চিত্ত সাহা দীর্ঘদিন দূরারোগ্য ব্যাধিতে ভুগে চিরবিদায় নিলেন। সত্যিকার অর্থে তারা ঋষিতুল্য মানুষ ছিলেন। তাদের আদর্শের ও স্বপ্নের সমাজতন্ত্রের পথ ধরে এই পজন্ম হাটবে এই প্রত্যঅশা করি। বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি মানিকগঞ্জ জেলা শাখার সাবেক সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা এ্যাড. আজাহারুল ইসলাম আরজু বলেন স্বাধীনতার পরও আমাদের পার্টি নিষিদ্ধ হয় এবং কমরেড মনি সিংহসহ অসংখ্য নেতাকর্মীদের জেলে যেতে হয়। মনি সিংহসহ নেতাকর্মীদের মুক্তির দাবিতে সারাদেশ থেকে নেতাকর্মীরা লংমার্চ করে ঢাকায় আসবেন। জেলার উত্তারাঞ্চল থেকে জেলের তালা ভাঙব মনি সিংহকে আনবো এই রকম স্লোগানে মুখরিত হয়ে পায়ে হেটে ছাত্র যুবক কৃষক জনতা লং মার্চ নিয়ে আসছেন। তখন নেতাকর্মীদের জন্য বেতিলাতে ডা: চিত্ত রঞ্জন সাহার বাড়িতে একদিনের বিরতির জন্য তাদের থাকা খাওয়াসহ যাবতীয় ব্যাবস্থাপনার দায় দয়িত্বের নেতৃত্ব দেন ডা: চিত্ত রঞ্জন সাহা ও কমরেড সৈয়দ আনোয়ার আলী চৌধুরী। লং মার্চের নেতা কর্মীদের আপ্যায়নের জন্য স্থানীয় নেতারা এক সম্পাহ ধরে গ্রামে গ্রামে চাল ডাল সবজি সংগ্রহ করেন। এটি এক বিরাট কর্মযজ্ঞ না দেখলে বোঝার উপায় নেই।
সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত ইউনিয়ন রাশিয়ার পতনের পর রাজনৈতিকভাবে তিনি বেশ আহত হন। তাই জীবনের শেষ দিকে তিনি ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি ন্যাপ এর রাজনীতি ছেড়ে ড.কামাল হোসেন নেতৃত্বাধীন গণফোরামে যোগদান করেন। তিনি ২০০৬ সালে মানিকগঞ্জ মুক্তিযুদ্ধের বিজয় মেলায় বক্তৃতাকালে স্ট্রোক করেন। তারপর দীর্ঘদিন প্যারালাইসি রোগের সাথে যুদ্ধ করে ১৭ ফেব্রæয়ারী ২০১৬ সালে শেষ নি:শ্বা ত্যাগ করেন। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি গণফোরামের রাজনীতি করলেও মণে প্রাণে সমাজতান্ত্রিক চেতনা ধারণ ও লালন করতেন। [লেখকঃ মো.নজরুল ইসলাম,সাধারন সম্পাদক,বাংলাদেশ প্রগতি লেখক সংঘ, মানিকগঞ্জ জেলা শাখা]

Related Articles

Leave a Reply

Back to top button