
আমির হোসেন সজিব : নারায়ণগঞ্জ শহরের সাম্প্রতিক এক ঘটনায় উদ্বেগ ও ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়েছে সাধারণ মানুষের মধ্যে। চিহ্নিত সন্ত্রাসী, মাদক কারবারি ও চাঁদাবাজ হিসেবে পরিচিত জাকির হোসেন যখন জেল হাজত থেকে মুক্তি পেয়ে এলাকায় ফেরেন, তখন তাকে দেওয়া হয় ফুলেল সংবর্ধনা ও মোটরসাইকেল শোভাযাত্রাসহ বিভিন্ন আয়োজন। এই সংবর্ধনার আয়োজন ছিল এমনভাবে জমকালো, যেন তিনি কোনো সমাজসেবক কিংবা জাতীয় বীর। অথচ এলাকাবাসী জানেন, এই মানুষটির নামেই কেঁপে উঠে নারায়ণগঞ্জের বিভিন্ন অঞ্চল।
জেল থেকে মুক্তি, তারপর সংবর্ধনা
জাকির হোসেন দীর্ঘদিন যাবৎ নারায়ণগঞ্জের একটি কুখ্যাত নাম। তার বিরুদ্ধে একাধিক মামলা রয়েছে—যার মধ্যে রয়েছে খুন, চাঁদাবাজি, অস্ত্র রাখা, মাদক পাচার ইত্যাদি গুরুতর অভিযোগ। এসব অপরাধের কারণে তিনি বেশ কিছুদিন জেল হেফাজতে ছিলেন। কিন্তু জামিনে মুক্তি পাওয়ার পরেই তার অনুসারীরা যে সংবর্ধনার আয়োজন করেন, তা দেখে অনেকেই বিস্মিত ও আতঙ্কিত হয়ে পড়েছেন।
আতঙ্ক সৃষ্টির পরিকল্পিত কৌশলঃ
স্থানীয় সূত্রগুলো বলছে, এই সংবর্ধনার পেছনে মূল উদ্দেশ্য ছিল এলাকা দখলের বার্তা দেওয়া এবং মাদক ব্যবসাসহ অন্যান্য অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের জন্য একটি সুরক্ষিত পরিবেশ তৈরি করা। সংবর্ধনার মাধ্যমে মূলত জাকির হোসেনের ‘পুনরুত্থান’ দেখানো হয়েছে-যাতে সাধারণ মানুষ ভীত সন্ত্রস্ত থাকে এবং তার বিরুদ্ধে কেউ মুখ না খোলে।
জাকির হোসেনের অনুসারীরা মোটরসাইকেল শোভাযাত্রা বের করে, ব্যানার-ফেস্টুন টানায় এবং তাকে ‘অপরাধবিহীন’ মানুষ হিসেবে উপস্থাপনের চেষ্টা করে। তারা এমন পরিবেশ তৈরি করে যেন জাকির হোসেন কোনো ‘বিরূপ রাজনৈতিক ষড়যন্ত্রের শিকার’।
সমাজ ও আইনশৃঙ্খলার প্রতি চ্যালেঞ্জঃ
এই ধরনের সংবর্ধনা শুধু নৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে নয়, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির দিক থেকেও অত্যন্ত চিন্তাজনক। একজন চিহ্নিত অপরাধীকে জনসম্মুখে এইভাবে গৌরবান্বিত করা মানে হলো অপরাধকে উৎসাহ দেওয়া, এবং সমাজে একটি ভুল বার্তা প্রেরণ করা যে অপরাধ করেও সম্মান পাওয়া যায়। এতে করে তরুণ সমাজও বিভ্রান্ত হতে পারে এবং অপরাধে জড়িয়ে পড়ার ঝুঁকি বাড়ে।
স্থানীয় বাসিন্দারা বলছেন, এই সংবর্ধনার ফলে আবারও এলাকায় ভয় এবং অস্থিরতা ফিরে এসেছে। অনেকে ইতিমধ্যে চাঁদাবাজি ও মাদকের নতুন করে সক্রিয় হওয়ার আলামত পাচ্ছেন। বিশেষ করে যারা আগে জাকির হোসেনের বিরুদ্ধে গিয়েছিলেন, তারা এখন চরম নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন।
প্রশাসনের নিরবতা প্রশ্নবিদ্ধঃ
সবচেয়ে দুঃখজনক বিষয় হলো, এই পুরো ঘটনার সময় আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কার্যকর কোনো ভূমিকা দেখা যায়নি। বরং তারা যেন নীরব দর্শকের ভূমিকায় ছিলেন। এর ফলে সাধারণ মানুষ মনে করছেন যে, হয়তো প্রশাসনের একটি অংশ এই অপরাধীচক্রের সঙ্গে সমন্বয় করেই চলছে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, যদি এভাবে চিহ্নিত অপরাধীরা জনসম্মুখে সংবর্ধনা পায়, তবে তা দেশের বিচারব্যবস্থাকেও প্রশ্নের মুখে ফেলে দেয়। এতে জনগণের মধ্যে বিচারহীনতার সংস্কৃতি বিস্তার লাভ করে।
সামাজিক সচেতনতা ও প্রতিরোধের প্রয়োজনঃ
এই পরিস্থিতিতে সমাজের সচেতন অংশ, নাগরিক সংগঠন, স্থানীয় সাংবাদিক ও মানবাধিকার কর্মীদের আরও দায়িত্ববান ভূমিকা পালন করতে হবে। অপরাধী যেই হোক না কেন, তার বিরুদ্ধে সামাজিকভাবে রুখে দাঁড়াতে হবে। সংবর্ধনার নামে অপরাধীদের সম্মানিত করার যে প্রবণতা দেখা দিয়েছে, তা থামাতে হলে জনমত গঠন ও প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে।
এছাড়া প্রশাসনের উচিত এমন ঘটনায় কঠোর অবস্থান নেওয়া, যারা এই সংবর্ধনার আয়োজন করেছে তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করা, এবং ভবিষ্যতে যাতে এধরনের ঘটনা আর না ঘটে, সে ব্যবস্থা নিশ্চিত করা।
জাকির হোসেনের মতো একজন চিহ্নিত সন্ত্রাসীকে সংবর্ধনা দেওয়া কেবল হাস্যকর নয়, এটি ভয়ংকরও বটে। এটি সমাজে একটি ভুল বার্তা পাঠায়-যেখানে অপরাধের কোনো পরিণতি নেই, বরং তা গৌরবের বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। এই ধারা বন্ধ করতে হলে প্রশাসন, গণমাধ্যম ও সমাজের সর্বস্তরের মানুষকে একযোগে রুখে দাঁড়াতে হবে। নয়তো ভবিষ্যতে এমন ‘সংবর্ধনা’ কেবল আরও ভয়াবহ অপরাধীদের জন্ম দেবে।