এম এ কাইয়ুম চৌধুরী,শিবালয় পতিনিধি: শীতের দিন মানেই খাঁটি খেজুরের রসের তৈরি গুড় দিয়ে পিঠা পায়েস খাওয়ার ধুম। আর সেটি যদি মানিকগঞ্জের “হাজারী গুড়”-এর হয় তাহলে তো আর কথাই নেই! লোভনীয় স্বাদ আর মনমাতানো সুগন্ধে অতুলনীয় “হাজারী গুড়ের” পরিধি এখন দেশের গণ্ডি পেড়িয়ে লন্ডন, ইতালি, ভারতসহ নানান দেশে সমাদৃত।
মানিকগঞ্জের এই “হাজারী গুড়” শত বছরের ঐতিহ্য ধরে রেখেছে। এই গুড়কে সরকার জেলার ব্যান্ডিং করেছে। স্বাদে গন্ধে মন মাতানো ওই গুড় উৎপাদনের সঙ্গে বংশ পরম্পরায় যুক্ত রয়েছে হাজারী পরিবার। কিন্তু কালের বিবর্তে খেজুর গাছের ও গুড় তৈরি কারিগর কমে যাওয়ায় খাঁটি গুড়টি পাওয়া এখন চ্যালেঞ্জ হয়ে পরেছে। এই গুড়টি বিশ্ব পরিচিতি পাওয়ায় একটি দুষ্টু চক্র ভেজাল দেওয়া শুরু করেছে।
আগে যেখানে শত শত পরিবার এই গুড় তৈরির কাজ করতো, এখন হাতে গোনা ২০ থেকে ২৫টি আদি হাজারী পরিবার বংশ পরম্পরায় যুক্ত রয়েছে গুড় উৎপাদনের সঙ্গে। তাদেরও রয়েছে জ্বালানী সংকট আর গুড় উৎপাদনের সঙ্গে খেজুর গাছও ক্রমান্বয়ে কমে যাচ্ছে।
হাজারী পরিবারদের দাবী এই গুড়ের ঐতিহ্য ধরে রাখতে হলে খেজুর গাছ রোপণ করতে হবে। এই অঞ্চলের “হাজারী গুড়”-এর পরিচিত, সুনাম ও ঘ্রাণ দেশের গণ্ডি পেরিয়ে বিদেশেও ছড়িয়েছে। একদা ইংল্যান্ডর রাণী এলিজাবেথও এই গুড় খেয়ে ভূয়সী প্রশংসা করেছিলেন।
ঐতিহ্যবাহী “হাজারী গুড়”-কে সরকারীভাবে স্বীকৃতি স্বরূপ জেলার ব্র্যান্ডিং নামকরণ করা হয়েছে “ঝিটকার হাজারী গুড়”। বর্তমানে প্রায় ২০ থেকে ২৫টি গাছি পরিবার “হাজারী গুড়” তৈরি করে তাদের জীবিকা নির্বাহ করে আসছেন। তবে জ্বালানীর মূল্য বৃদ্ধি, শীত কম ও মাত্রাতিরিক্ত কুয়াশায় গুড়ের উৎপাদন কম হচ্ছে বলে সেখানকার গাছিরা জানিয়েছেন। ১২ কেজি গুড় জাল করে পাওয়া যায় এই “হাজারী গুড়”। এ বছর বর্তমানে কেজি প্রতি এই গুড়ের দাম দেড় হাজার টাকার ওপরে। মনে হতে পারে ব্যতিক্রম কোনো প্রাকৃতিক উৎসের রস থেকে তৈরি হয় “হাজারি গুড়”! আসলে তা নয়, সাধারণ খেজুরের রসই এই “হাজারী গুড়”-এর উৎস। কিন্তু গাছীর রস নামানো থেকে শুরু করে গুড় তৈরির মধ্যে রয়েছে আদি এক প্রক্রিয়া। কাল থেকে কালান্তরে অনেক কিছুর পরিবর্তন হলেও “হাজারি গুড়” তৈরির এই প্রক্রিয়ার কোনো পরিবর্তন নেই জানালেন গাছিরা।
মানিকগঞ্জের গুড়ের বাজারে খেজুরের গুড়ের বিশাল পসরা বসলেও “হাজারি গুড়” সেখানে অনন্য। তাই এর দাম প্রচলিত পাটালির গুড়ের দামের তুলনায় অনেকগুণ বেশী দাম এই “হাজারী গুড়”-এর। মানিকগঞ্জর হরিরামপুর উপজেলার ঝিটকা, বাল্লা, গোপীনাথপুরসহ তার আশপাশের গ্রামে সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, তীব্র শীত উপেক্ষা করে কাক ডাকা ভোর থেকে শুরু হয় সেখানকার গাছিদের কর্মযজ্ঞ।
খেজুর রসের তৈরি “হাজারী গুড়”-এর জন্য বিখ্যাত এই অঞ্চলের বাড়ি আঙ্গিনা এবং বিভিন্ন কাচা পাকা রাস্তার পথ প্রান্তে শোভা পাচ্ছে সারি সারি খেজুর গাছ। আর খেজুর গাছ এই অঞ্চলের অসংখ্য পরিবার জীবন জীবিকা নির্বাহ করে আসছে।
সরেজমিনে সোমবার ভোর সোয়া ৫টায় আযানের ধনী কানে ভেসে আসার আগেই নিত্যদিনের মতো ঘুম ভেঙ্গে গেছে গাছী রাসেলের। ঝিটকা বাজার পেড়িয়ে দুই কিলোমিটার পেরিয়ে তার সঙ্গে দেখা। একটা চাঁদর মুড়িয়ে খেজুর গাছে উঠছেন রসের হাড়ি নামাতে। একে একে বিশটি গাছ থেকে রসের হাঁড়ি নামার পর মিনিট খানেক বিশ্রামের পর আবারে রসের হাঁড়ি নামানোর শুরু। এভাবে একটানা ৪০ থেকে ৪৫টির মতো খেজুর গাছে উঠতে হয়েছে তাকে। তারপর রসের হাঁড়ি থেকে রস একটি পাত্রে জড়ো করে বাড়ীতে নেন। তারপর জ্বালানি দিয়ে রস জ্বাল দেওয়া প্রস্তুতি।
পার্শ্ববর্তী গোপীনাথপুর ইউনিয়নের উত্তর পাড়ায় শুকুর আলী মোল্লার ছেলে মোজাফফর মোল্লার (৪০) বাড়ীর। যিনি নানার বাড়ীর উত্তরাধিকার সূত্রে “হাজারী গুড়” তৈরির স্বীকৃতি পেয়েছেন। এই স্বীকৃতি নিয়ে তার নানা মকবুল হাজারীর কাছে গল্প শুনেছেন, একদা এক দরবেশ ঝিটকার এলাকার রাস্তার পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন। এ সময় ওই দরবেশ এক গাছির কাছে খেজুরের রস খাইতে চাইলো। কিন্তু তখন সবে গাছে রসের হাঁড়ি পাতা হয়েছে। কেমনে ওই দরবেশকে রস খাওয়াবে। এ সময় ওই দরবেশ ওই গাছিকে বললেন, “দেখো তোমার রসের হাঁড়ি ভরে গেছে।”
এরপর কৌতূহলী ওই গাছি খেজুর গাছে উঠে দেখেন সত্যিই রসের হাঁড়িতে রসের হাড়ি ভরে টইটুম্বুর। তারপর তাকে রস খাওয়ানো হলো। তারপর দরবেশ তাকে বললো, “এই দেখবি এই রস জ্বাল করে সুস্বাদু গুড় পাবি!” সেই থেকে এই গুড়ের নামকরণ “হাজারী গুড়”।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, গুড় তৈরির নানান কারিশমা। প্রতি এক হাড়ি রসের জন্য আলাদা আলাদা জ্বাল করতে হয়। এরপর তা একটি মাটির পাত্রে পরিষ্কার কাপড় দিয়ে ফুটন্ত রস ছেকে ঢেলে দেওয়া হয় আরেকটি খাড়া মাটির পাত্রে। যা জালা নামে পরিচিত। ওই জালার দু’পাশে দু’জন ব্যক্তি বসেন কাঠ কিংবা তালে লাঠি নিয়ে। এরপর ওই দুজনে মিলে অসংখ্যবার ঘুটা দিতে দিতে ধবধবে সাদা বাদামী রং তৈরি করে। তারপর তৈরি হয় সুস্বাদু “হাজারী গুড়”।
মোজাফফর হাজারী জানান, দাদা বেলায়েত মোল্লা থেকে তাদের বাড়ীতে “হাজারী গুড়” তৈরি হয়ে থাকে। বাবা শুকুর আলী বয়স জনিত কারণে এখন আর এই পেশায় না থাকলেও প্রতিদিন উঠানে বসে তাদের দেখাশোনা করেন। পরামর্শ দেন ঐতিহ্য ধরে রাখতে কোনো ধরনের ছলচাতুরী আশ্রয় যেন নেওয়া না হয়।
মোজাফফর জানালেন, এই গুড় তৈরি পেশায় তিনিসহ ভাই সুকচান মোল্লা ও মান্নান মোল্লা হাজারী নিয়োজিত।
গাছি পরিবারের গৃহিণী সুফিয়া বেগম বলেন, “ভোরবেলা আজানের সঙ্গে সঙ্গে ঘুম থেকে উঠি। তারপর তারা রস পারতে যায় আর আমি চুলা হাড়ি ঠিক করি। রস আসলে ছেকে হাড়িতে বসাই দেই। এরপর আগুন দিয়ে রাস জাল করতে হয়। গুড় তৈরির পর আবার সব হাড়ি গরম পানি দিয়ে ধুয়ে পরিষ্কার করতে হয়। তাছাড়া গাছের নাল পানিতে ফুটাতে হয়। গুড়ের সময়ে আমাগো ভোর থেকে সারাদিন কাজ করতে হয় গুড়ের পিছনে। ‘হাজারী গুড়’ তৈরি করতে খুব কষ্ট।”
কথা হয় স্থানীয় গাছি আমজাদ হোসেনের (৫৫) সঙ্গে। তিনি দুই যুগ ধরে খেজুরের গাছ কাটছেন। গাছ ও রসের হাঁড়ি পরিচর্যা করতে হয় সতর্কতার সঙ্গে। তিনি জানান, প্রথমে রসের হাঁড়িগুলো নিম পাতা দিয়ে পানি গরম করে প্রতিটি রসের হাড়ি জীবাণুমুক্ত করে পরিষ্কার করতে হয়। পরে হাড়ি গুলো রোদে শুকাতে হয়। একটানা তিন দিন করে প্রতিটি খেজুর গাছ থেকে রস নামানো হয়। পরে পাঁচ দিন বিরতি দিয়ে গাছ শুকিয়ে আবারো তিনদিন করে রস বের করা হয়।
প্রতিদিন বিকেলে গাছ কেটে হাড়ি বেঁধে দেওয়া হয়। পরদিন ভোরে (সূর্য উঠার আগে) গাছ থেকে রসের হাঁড়ি নামিয়ে ছেকে ময়লা পরিষ্কার করে টিনের তৈরি তাফাল (পাত্র) বাইন (চুলা) জ্বালিয়ে গুড় তৈরি করতে হয়। জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করা হয় নাড়া ও কাশবন। এ গুড় দেখতে যেমনি সুন্দর, খেতেও তেমনি সুস্বাদু।
মায়ের ১৩ বিঘার জমির বিনিময়ে “হাজারী গুড়”-এর সিল
মোজাফফর মোল্লা জানালেন, তার মা মমতাজ বেগম বাবার ওয়ারিশের ১৩ বিঘা জমির বিনিময়ে “হাজারী গুড়”-এর সিলের উত্তরাধিকার হয়েছেন। নানার বাড়ী থেকে মায়ের ১৩ বিঘা সম্পত্তির বিনিময়ে ঐতিহ্যবাহী “হাজারী গুড়”-এর সিল পান তারা। তারা মুরব্বীদের কাছে শুনেছেন, ইংল্যান্ডর রাণী এলিজাবেথকেও এই গুড় উপহার দেওয়া হয়েছিল। তিনি এই গুড় খেয়ে অভিভূত হয়েছিলেন। বর্তমানে এই গুড় এখনো লন্ডন যায়। যায় ইতালি, ভারতসহ নানান দেশে।
জসীম মোল্লা নামের একজন গাছি জানালেন, “হাজারী গুড়”-এর চাহিদা এতোই বেশী যে, তৈরি করার কয়েক মাস আগেই অর্ডার থাকে। নামীদামী মানুষ গাড়ি নিয়ে আসেন গুড় নিতে। তবে আগের মতো এখন আর গুড় তৈরি করা যায় না। তার কারণ বর্তমান খেজুর গাছের সংকট দেখা দিয়েছে। পাশাপাশি রস জ্বাল করার জ্বালানির বড়ই অভাব। শীতের প্রায় তিন মাস গাছ কাটা যায়।১৩ বিঘা জমির বিনিময়ে “হাজারী গুড়”-এর সিলের উত্তরাধিকার হয়েছেন মোজাফফর মোল্লা।
এ ব্যাপারে হাজারী পরিবারে এক সদস্য সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান শামীম হাজারীর সঙ্গে কথা হলে তিনি জানান, খেজুর গাছের সংখ্যা ক্রমান্বয়ে কমে যাচ্ছে। আর জ্বালানীর দামও অনেক বেশি। আগে যেখানে কয়েকশ’ পরিবার এই গুড় তৈরির পেশায় ছিলেন, এখন কমতে কমতে ২০ থেকে ২৫টি পরিবারে এসে ঠেকেছে।
তিনি সরকারের কাছে দাবী জানান, খেজুর গাছ রোপণ করতে হবে। নইলে খুব অল্প সময়ে এই “হাজারী গুড়” ইতিহাসের পাতায়ই থেকে যাবে, বাস্তবে নয়।
জেলা প্রশাসন সূত্র জাসায়, “লোক সঙ্গীত আর হাজারী গুড়, মানিকগঞ্জের প্রাণের সুর। এই ব্র্যান্ডিং শ্লোগানকে সামনে রেখে হাজারী গুড়ের বিষয়টি প্রমোট করার চেষ্টা করছি। জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে খেজুর গাছ রক্ষা এবং খেজুর গাছ রোপণের বিষয়ে পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে।”
সূত্র জানায় “যারা হাজারী গুড়ের সঙ্গে জড়িত রয়েছেন। তাদের সাথে আলোচনা করা হয়েছে, কিভাবে এটিকে প্রমোট করা যায়। নিশ্চিই ব্র্যান্ডিংইয়ের সঙ্গে মিল রেখে বিশ্ব দরবারে কিভাবে প্রমোট করা যায়, সে ব্যাপারে পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে।”