sliderঅর্থনৈতিক সংবাদশিরোনাম

রেমিট্যান্স না পাঠানোর প্রচারণার প্রভাব কেমন হতে পারে

বাংলাদেশের চলমান আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ও প্রবাসীদের মধ্যে রেমিট্যান্স না পাঠানোর প্রচারণার কারণে রেমিট্যান্স বা প্রবাসী আয় নিয়ে এক ধরণের উদ্বেগ তৈরি হয়েছে অনেকের মধ্যে।

বিশ্লেষক এবং ব্যাংকিং খাত সংশ্লিষ্টদের মতে, পরিস্থিতির যথাযথ রাজনৈতিক সমাধানের মাধ্যমে আস্থা ফিরিয়ে না আনতে পারলে একদিকে রেমিট্যান্স যেমন কমবে, তেমনি দেশ থেকেও অবৈধ পথে বিদেশে অর্থ পাচারের আশঙ্কা বাড়বে।

মূলত কোটা সংস্কার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে দেশজুড়ে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি এবং এর জের ধরে কারফিউ জারি, ইন্টারনেট বন্ধ থাকা এবং কয়েকদিন ব্যাংক বন্ধ থাকায় গত ১৬ জুলাই থেকেই থমকে গেছে প্রবাসী আয়ের প্রবাহ।

অথচ মাত্র এক মাস আগেই অর্থাৎ জুন মাসে প্রায় চার বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ রেমিট্যান্স এসেছিল বাংলাদেশে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বলছে, ইন্টারনেট বন্ধ থাকা ও ব্যাংকিং চ্যানেল বন্ধ থাকায় ১৯ জুলাই থেকে ২৪ জুলাই সপ্তাহে দেশে রেমিট্যান্স এসেছে মাত্র সাত কোটি ৮০ লাখ ডলার। অথচ মাসের প্রথম ১৮ দিনে প্রতিদিন গড়ে সাত কোটি ৯০ লাখ ডলার রেমিট্যান্স এসেছিল।

১৬ জুলাই মঙ্গলবার কোটা আন্দোলন তীব্র আকার ধারণ করতে শুরু করে এবং ওইদিনই রংপুরের আবু সাঈদসহ ছয়জন মারা যান।

এরপর বৃহস্পতি ও শুক্রবার ব্যাপক সহিংসতায় শতাধিক মানুষ নিহত হওয়ার প্রেক্ষাপটে ১৯ জুলাই শুক্রবার রাতে কারফিউ জারি করে সেনা মোতায়েন করে সরকার। ওই সময় পরপর তিন দিন সাধারণ ছুটিও ঘোষণাও করা হয়।

ফলে ১৯ জুলাই থেকে ২৩ জুলাই পর্যন্ত কার্যত ব্যাংকিং কার্যক্রম বন্ধ থাকায় ব্যাংকিং চ্যানেলে রেমিট্যান্স বা প্রবাসী আয় আসা সম্ভব ছিল না।

এর মধ্যে ১৯ জুলাইয়ের পর থেকেই সামাজিক মাধ্যমে রেমিট্যান্স না পাঠানোর ক্যাম্পেইন শুরু হয়।

এ সময়ের মধ্যে বিভিন্ন দেশ থেকে প্রবাসীরা যে অর্থ পাঠিয়েছেন সেটি ২৪ জুলাই (বুধবার) ব্যাংক খোলা থাকলেও সেদিন খুব একটা জমা পড়েনি। যদিও ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই সংশ্লিষ্ট ব্যাংকগুলো রেমিট্যান্স বিতরণ করার কথা।

বিদেশ থেকে প্রবাসীদের পাঠানো অর্থ গ্রহণে শীর্ষ ব্যাংকগুলোর একটি সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক জাফর আলম বলছেন, প্রবাসী আয় নিয়ে এখনি উদ্বিগ্ন হওয়ার মতো হয়নি।

‘এবার কয়েকদিন ব্যাংক বন্ধ থাকায় প্রবাসীরা অর্থ পাঠাতে পারেনি হয়তো, যে কারণে প্রবাসী আয়ের প্রবাহ এখন কম। ধীরে ধীরে এটি ঠিক হয়ে আসবে,’ বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন বেসরকারি ব্যাংকটির এই শীর্ষ কর্মকর্তা।

তবে অর্থনীতিবিদ আহসান এইচ মনসুর বলছেন, রাজনৈতিক সঙ্কট অব্যাহত থাকলে এবং আস্থা ফিরে না আসলে ব্যাংকিং চ্যানেলে প্রবাসী আয় যেমন কমবে, তেমনি দেশ থেকে নন ব্যাংকিং চ্যানেলে অর্থ পাচারের আশঙ্কাও বেড়ে যেতে পারে।

উদ্বেগের কারণ কী
রেমিট্যান্স নিয়ে উদ্বেগের কারণ হিসেবে অনেকে বলছেন, বিদেশ থেকে বাংলাদেশে সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টির অংশ হিসেবে ব্যাংকিং চ্যানেলে রেমিট্যান্স না পাঠাতে সামাজিক মাধ্যমে ব্যাপক প্রচারণা চালানো হচ্ছে।

পরিস্থিতি মোকাবেলায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে অনানুষ্ঠানিকভাবে ব্যাংকগুলোকে বেশি মুনাফা অফারের পরামর্শ দেয়া হয়েছে বলে সংবাদ মাধ্যমে খবর এসেছে। যদিও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কেউ এ বিষয়ে মন্তব্য করতে রাজী হননি।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের জুন মাসে গত প্রায় চার বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ রেমিট্যান্স এসেছিল বাংলাদেশে, যার পরিমাণ ছিল দুই দশমিক ৫৪ বিলিয়ন ডলার।

এটি আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় প্রায় ১৬ শতাংশ বেশি।

এছাড়া গত অর্থবছরের তুলনাতেও বর্তমান অর্থবছরে রেমিট্যান্স বেশি আসছিল। যেখানে ২০২২-২৩ অর্থবছরে ২১ দশমিক ৬১ বিলিয়ন ডলার পাওয়া গিয়েছিল, সেখানে ২৩-২৪ অর্থবছরে এসেছে ২৩ দশমিক ৯১ বিলিয়ন ডলার।

বিশ্লেষকদের অনেকে মনে করেন, এখন দেশের অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতি ও নেতিবাচক ক্যাম্পেইনের কারণে রেমিট্যান্স প্রবাহ কিছুটা দুর্বল হলেও এটি ধীরে ধীরে ঠিক হয়ে আসবে।

বিশ্লেষকেরা কী বলছেন?
পলিসি রিসার্চ ইন্সটিটিউটের নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বলছেন, বাংলাদেশে রেমিট্যান্স আসে মূলত পরিবারকে সহায়তার জন্য এবং প্রবাসীদের পরিবারের প্রয়োজনে এ টাকা দেরিতে হলেও আসবে। তবে যারা বাড়িঘর কিংবা জমি কেনায় বিনিয়োগ করেন সেটি হয়তো কম আসতে পারে।

‘তবে উদ্বেগের জায়গা হলো হুন্ডি। এর মাধ্যমে টাকা পাচারেরও সম্ভাবনা বেড়ে যাবে সঙ্কটের রাজনৈতিক সমাধান দ্রুত না হলে। যে দলেরই হোক রাজনীতি সংশ্লিষ্টদের মধ্যে টাকা পাচারের প্রবণতা বাড়তে পারে,’ বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন এইচ মনসুর।

তিনি বলেন, ‘বিশেষভাবে যারা ভিন্ন পথে টাকা বানিয়েছে তারা দ্রুত টাকা বাইরে পাঠানোর চেষ্টা করতে পারে। আবার ব্যবসায়ীরা ভাবতে পারে যে পরিস্থিতি ভালো নয়, তাই বিদেশে বিনিয়োগ করি। রফতানিকারকরা আন্ডার ইনভয়েসিং আর আমদানিকারকরা ওভার ইনভয়েসিং করে টাকা বাইরে রাখবে। কাজেই সমাজের প্রতিটি ক্ষেত্রেই টাকা বাইরে পাঠানোর প্রবণতা বাড়বে।’

এদিকে সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক জাফর আলম বলছেন, রাজনৈতিক সহিংসতা বাংলাদেশে একেবারে নতুন কিছু নয় এবং সে কারণে প্রবাসী আয়ে খুব একটা হেরফের হবে বলে তিনি মনে করেন না।

‘সঙ্কটকালেই বরং প্রবাসীরা বেশি অর্থ পাঠায় পরিবারে। করোনার সময় আমরা এটি দেখেছি। ব্যাংকিং সেবা নিরবচ্ছিন্ন থাকলে ধীরে ধীরে প্রবাসী আয় স্বাভাবিক হয়ে আসবে। কারণ এ আয় বাড়াতে বেশ কিছু পদক্ষেপ ইতোমধ্যেই নেয়া হয়েছে,’ বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন তিনি।

তবে অন্য একটি ব্যাংকের উচ্চপদস্থ একজন কর্মকর্তা, যিনি নিজের পরিচয় প্রকাশ করতে চাননি, বলছেন যে প্রবাসী আয় নিয়ে নেতিবাচক প্রচারণার প্রভাব বুঝতে আরও কয়েক সপ্তাহ পর্যবেক্ষণ করতে হবে।

বিবিসি বাংলাকে তিনি বলেছেন, ‘বিষয়টি উদ্বেগের ও গুরুত্বপূর্ণ কিন্তু। বিভিন্ন দেশের হুন্ডি চক্রগুলোর সাথে জড়িতদের ক্যাম্পেইনও হতে পারে এটি। তবে যারাই করুক, এর আদৌ কোনো প্রভাব পড়ে কি না তা বোঝা যাবে আগামী মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকে।’

চলতি বছর কোন মাসে কেমন আয়
জুন মাসে ঈদুল আযহা উদযাপিত হয়েছে। সাধারণভাবে পরিবারগুলোতে উৎসবকেন্দ্রিক অর্থ পাঠানোর প্রবণতা থাকে।

চলতি বছর জুন মাসে দেশে রেমিট্যান্স বাড়ার সেটি একটি কারণ বলে ধারণা করা হয়।

এর বাইরে, জুনে প্রবাসী আয় বেড়ে যাওয়ার অন্যতম কারণ হিসেবে অনেকে ডলারের বিনিময় হার নির্ধারণের পদ্ধতি পরিবর্তনের ‘সুফল’ বলেও আখ্যায়িত করে থাকেন।

চলতি বছর মে মাসে কেন্দ্রীয় ব্যাংক আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের বা আইএমএফ- এর পরামর্শ মেনে মার্কিন ডলারের বিনিময় হার নির্ধারণে ‘ক্রলিং পেগ’ পদ্ধতি চালু করে।

এতে দেশের প্রধান বৈদেশিক মুদ্রাটির দাম একদিনের ব্যবধানে এক লাফে সাত টাকা বেড়ে ১১৭ টাকা হয়েছিল।

কোন কোন ব্যাংক আরো বেশি দাম দিয়েও প্রবাসীদের কাছ থেকে ডলার কিনেছে বলে ধারণা করা হয়। এর ফলে প্রবাসী আয়ও বেড়ে যায় কারণ ডলারের বিপরীতে বেশি টাকা পাওয়া যাচ্ছিল।

মূলত কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরামর্শে ব্যাংকগুলো আড়াই শতাংশ পর্যন্ত প্রণোদনা দেয়ায় হুন্ডির মতো অনানুষ্ঠানিক চ্যানেলগুলোর দরের পার্থক্য অনেক কমে যাওয়ায় প্রবাসীরা ব্যাংকিং চ্যানেলেই বেশি অর্থ পাঠিয়েছেন।

ডলারের দর বাড়ানোর পর গত মে মাসে ২২৫ কোটি ডলার এবং জুন মাসে ২৫৪ কোটি ডলারের রেমিট্যান্স আসে।

যদিও সহিংসতা, ইন্টারনেট বন্ধ থাকা ও ব্যাংকিং চ্যানেল বন্ধ থাকায় গত সপ্তাহে ১৯-২৪ জুলাই দেশে রেমিট্যান্স এসেছে মাত্র সাত কোটি আশি লাখ ডলার।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের জানুয়ারিতে ২১১ কোটি ৩৮ লাখ, ফেব্রুয়ারিতে ২১৬ কোটি ৪৫ লাখ, মার্চে ১৯৯ কোটি ৭০ লাখ ডলার রেমিট্যান্স এসেছে বাংলাদেশে।

এরপর এপ্রিলে ২০৪ কোটি ৪২ লাখ, মে মাসে ২২৫ কোটি ৪৯ লাখ এবং জুনে ২৫৪ কোটি ১৬ লাখ।

সর্বশেষ চলতি জুলাই মাসের ২৪ তারিখ পর্যন্ত ১৫০ কোটি ডলারের প্রবাসী আয় পেয়েছে বাংলাদেশ।

সূত্র : বিবিসি

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button