sliderবিবিধশিরোনাম

যে দেশে ষড়যন্ত্রের জাল বিছিয়ে রেখেছে বিদেশীরা

আউলিয়া আতরাফি
ষড়যন্ত্র তত্ত্বের ডালপালা কিংবা হাত-পা গজায় পৃথিবীর প্রায় সব দেশেই। কিন্তু কিছু কিছু দেশ আছে যেখানে এসব গল্প অত্যন্ত জনপ্রিয়তা অর্জন করে। কিন্তু বিবিসির আউলিয়া আতরাফি বলছেন- এমন একটি দেশ আছে যেখানে প্রায়শই সবকিছুর জন্যে বিদেশি শক্তি, বিশেষ করে ব্রিটিশদেরকে দায়ী করা হয়…
নানা ধরনের ষড়যন্ত্র তত্ত্বের ভেতরে আমি বেড়ে উঠেছি। তার কিছু কিছু আবার খুবই অদ্ভুত।
যেমন আমাকে বলা হয়েছে যে ব্রুস লির উপর তার স্ত্রী বিষ প্রয়োগ করেছিলো, এবং ব্রুস লি যখন বুঝতে পারল তার স্ত্রী কী করেছে তখন সে তার খালি হাতেই স্ত্রীকে ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করে ফেলে।
আমি এও জানতাম যে ব্রুস লি উড়তে পারে।
এ রকম আরো আছে- যেমন হিটলার এখনো বেঁচে আছেন। একটি জিপ গাড়িতে করে সে মিত্রদের হাত থেকে পালিয়ে এসেছে। ওই জিপ গাড়িটা একসময় বিমানে রূপ নেয়, তারপর পরিণত হয় একটি নৌকায়। তারপর একটি ডুবোজাহাজে। ওই সাবমেরিন থেকে তিনি এখনো মাঝে মাঝে বার্তা পাঠিয়ে যাচ্ছেন। ঘোষণা করছেন : “আমি আবার ফিরে আসব!”
তবে একটি তত্ত্ব টিকে আছে যুগ যুগ ধরে। আর সেটি হলো – আফগানিস্তানে সকল শয়তানির পেছনে আছে ব্রিটিশদের হাত।
যখন ছোট ছিলাম, আমি ভাবতাম এর পেছনে কী কারণ থাকতে পারে। কিন্তু আমার বয়স যখন ২০ পার হলো, আমি ব্রিটেনে চলে আসি। এখানে আসার পর আমি জানতে পারলাম এই সন্দেহের পেছনে ভালো ভালো কিছু কারণও আছে।
বহু শতাব্দী কাল ধরে আফগানিস্তান ছিলো রাশিয়া ও ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের দ্বন্দ্বের মাঝখানে (বাফার জোন)। এই দুই পরাশক্তি তাদের যুদ্ধের কৌশলে এই দেশটিকে ব্যবহার করেছে। আফগানিস্তানের ভেতরে দুটি দেশই লিপ্ত ছিলো নানা ধরনের ষড়যন্ত্র কিংবা চক্রান্তে। আধুনিক আফগানিস্তানের মানচিত্র যখন তৈরি হলো, বলা হয় যে তখন আফগান বাদশাহর মতামতকে কোনোভাবেই বিবেচনা করা হয়নি। আফগানিস্তান নিজেদের স্বাধীনতা ঘোষণা করে ১৯১৯ সালে। তখন ব্রিটিশরা সেখান থেকে চলে আসে চিরতরে। কিন্তু তার আগে তিন তিনবার ইঙ্গ-আফগান যুদ্ধ হয়েছে।
কিন্তু আসলেই কী ব্রিটিশরা আফগানিস্তান ছেড়ে চলে এসেছে?
আফগানরা মনে করে, ব্রিটিশরা এখনো তাদের দেশে ছায়ার মতো ওঁত পেতে আছে। তাদের উপর গোয়েন্দাগিরি করছে। করছে ষড়যন্ত্র। এবং এখনো আফগানিস্তানের বিষয়ে নাক গলাচ্ছে যাতে সেখানকার পরিস্থিতি দিনে দিনে আরো খারাপ হচ্ছে।
আফগানিস্তানে এমন কিছু গল্পও প্রচলিত আছে ব্রিটিশ গোয়েন্দারা গোপনে ইমামের ছদ্মবেশ ধরে ধার্মিক লোকজনদের বিভ্রান্ত করছে, কেউ কেউ কাজ করছে ভবিষ্যৎ বলতে পারে এমন মানুষ হিসেবেও। শুধু তাই নয়, আফগানিস্তানের মাজারে মাজারে এখনো নাকি বহু ধনসম্পদ লুকানো আছে যা ভিক্ষুকের ছদ্মবেশে ব্রিটিশরা সেখানে পাহারা দিচ্ছে।
ষড়যন্ত্র তত্ত্বের ব্যাপারে আফগান জাতির এই মাতামাতি একেবারে বিচিত্র কিছু নয়। এক কুর্দি বন্ধু আমাকে বলেছিল, সারা রাতের বৃষ্টির পর তাদের এলাকায় যদি কখনো কোনো দেয়াল ধ্বসে পড়ত তাহলে তার মা তার জন্যও ব্রিটিশদের দায়ী করতেন। ইরানি নাটকেও এ রকম ব্রিটিশ ষড়যন্ত্রের কথা রয়েছে। সেখানে বলা হয় যে ব্রিটিশরা নাকি সবসময় একটা চক্রান্ত করছে। আমার বন্ধুরা বলেছে, বাংলাদেশেও কেউ যদি চতুরতার সাথে কাজ করে তাহলে তাকে ইংলিশ বলে ডাকা হয়। কাবুলেও এরকম একটি শব্দ চালু আছে : চুচা ই ইংলিশ।
তবে যাই হোক, ১৯৮০-এর দশকে আফগান গৃহযুদ্ধ শুরু হওয়র পর থেকে, আমাদের দেশে এই ষড়যন্ত্রকারীদের তালিকা আরো দীর্ঘ হয়েছে। এখন এই তালিকায় যুক্ত হয়েছে পাকিস্তানের সামরিক গোয়েন্দা বাহিনী আইএসআই। তার সাথে আমেরিকানরাতো আছেই।
দেশটিতে বারবার বিদেশিদের হস্তক্ষেপের কারণে আফগানরা এ বিষয়ে আরো বেশি কল্পন-প্রবন হয়ে উঠেছে।
লন্ডনে একজন আফগান ট্যাক্সি-চালক বলেছিলেন, বিদেশিরা নাকি আমাদের তেল চুরি করতে চায় আর সেই তেল নাকি পাচার করা হবে যাত্রীবাহী বিমানে। আবার কেউ কেউ মনে করেন, বিদেশিরা নাকি আফগানিস্তান থেকে ইউরেনিয়াম আনতে চায়। আফগানিস্তানে একজন বিচারক একবার আমাকে বলেছিলেন, ওসামা বিন লাদেন আসলে একজন আমেরিকান গুপ্তচর এবং শেষ পর্যন্ত তাকে হত্যা করা হয় কারণ সে সবকিছু জেনে গিয়েছিল। আরো একদল লোক আছেন যারা মনে করেন ওসামা বিন লাদেন এখনো জীবিত আছেন। তিনি বসবাস করছেন অ্যামেরিকার কোনো না কোনো একটি দ্বীপে।
আফগান জেনারেলদের কেউ কেউ বলেন যে ন্যাটো তালেবান বাহিনীকে নগদ অর্থ আর অস্ত্র দিয়ে সহায়তা করছে। তারা এমন দাবিও করছেন যেসব দোভাষী এসব বিষয়ে কথা বলেছেন তাদেরকে নাকি হেলিকপ্টার থেকেও ফেলে দেয়া হয়েছে। এমন গল্পও আছে যে ন্যাটোর সৈন্যরা আফগান মাদক ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে ড্রাগ কিনে খাচ্ছে। এবং সেসব ড্রাগ নিহত সৈন্যদের লাশের পেটের ভেতরে লুকিয়ে পাচার করে নিয়ে যাচ্ছে পশ্চিমা দেশগুলোতে।
গত বছর আমি আমার এক বন্ধুকে দেখতে গিয়েছিলাম। তার পিতা একজন বৃদ্ধ খান। পূর্বাঞ্চলীয় এক গোত্রের প্রধান। চা খাওয়ার পর আমরা যখন গল্প গুজব করছিলাম তখন আমি তাকে তাদের এলাকায় তথাকথিত ইসলামিক স্টেটের উপস্থিতি নিয়ে প্রশ্ন করেছিলাম। তখন তিনি একটা লম্বা বক্তৃতা দিলেন। এর আগেও আমি হাজারবার এই বক্তৃতা শুনেছি : “এর সবই আইএসআই, আমেরিকান ও ব্রিটিশদের খেলা। তার মূল্য দিচ্ছে আফগানরা।”
কিছুটা বিস্মিত হয়ে আমি তাকে প্রশ্ন করলাম : “কিন্তু এটা করে তাদের কী লাভ?”
“তারা পরিকল্পনা করে ৫০ বছর আগে, আমরা সেটা বুঝতে পারি না,” তার জবাব।
“এটা যদি এতোই সহজ কিছু হয়, তাহলে তারা বোকা। আমরা শুধু তার কিছু ইঙ্গিত টের পাই। রাশিয়া, পাকিস্তান আর চীন মিলে নতুন একটি ব্লক তৈরি হচ্ছে।”
তিনি বলতে লাগলেন, “একবার ভেবে দেখুন। আমেরিকা তো তালেবান সরকারকে মাত্র এক সপ্তাহেই ধ্বংস করে দিতে পারত। কিন্তু এখন পাহাড়ে লুকিয়ে থাকা অল্প কিছু সন্ত্রাসীকে তারা নির্মূল করতে পারছে না কেন?”
সব সময়ই বাইরের কেউ না কেউ থাকে যাকে আফগানিস্তানের পরিস্থিতির জন্যে দায়ী করা হয়। সম্প্রতি কাবুলে, আমি শুক্রবারের জুম্মার নামাজ শেষ করছি, আমার সাথে আরো কিছু রিপোর্টার ছিলো, তখন আমরা একটা খবর পেলাম যে একজন আত্মঘাতী হামলাকারী একটি শিয়া মসজিদে হামলা চালিয়েছে।
“এটা কি ইসলামিক স্টেটের কাজ?” আমি জিজ্ঞেস করলাম।
আরেকজন সাংবাদিক তখন বললেন, “অথবা হতে পারে হয়তো ইহুদি ও খ্রিস্টানরা এর সাথে জড়িত।”
আমি তখন জানতে চাইলাম, “এতে তাদের কী লাভ হবে?”
“দুটি জিনিস। এর ফলে ধার্মিক লোকজন আর মসজিদে আসবে না এবং মুসলমানদেরকেও বিভক্ত করা যাবে,” তার উত্তর।
তারপর আমরা যখন গ্রিন জোনের ভেতরে পাকা রাস্তা ধরে হেঁটে যাচ্ছিলাম, আমাদের প্যান্ট তখনো পায়ের দিকে গোটানো ছিলো, জায়নামাজ ছিলো আমাদের হাতে, আমার মাথায় তখন একটা চিন্তা এলো। সেটা হলো – এমন একটা দেশ যেখানে এত মানুষের এতো ভাষা, এত জাতীয়তা এবং মতাদর্শ, তারপরও একটা জিনিস আছে যা সব আফগানকে ঐক্যবদ্ধ করে রেখেছে সেটা হলো – বিদেশির প্রতি তাদের অবিশ্বাস।
সুত্র: নয়া দিগন্ত

Related Articles

Leave a Reply

Back to top button