ছাত্রদের আন্দোলনের মুখে শেখ হাসিনার পদত্যাগ করে দেশ থেকে পালানোর পর নতুন নির্বাচনের আগ পর্যন্ত একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান হিসেবে ড. মুহাম্মাদ ইউনূসের নাম ঘোষণা করা হয়েছে।
শান্তিতে নোবেল পুরস্কারপ্রাপ্ত মুহাম্মদ ইউনূস ‘অতি দরিদ্রদের ব্যাংকার’ হিসাবে পরিচিত। একইসাথে তিনি শেখ হাসিনার দীর্ঘদিনের সমালোচক।
সরকারি চাকরিতে কোটা ব্যবস্থার সংস্কার চেয়ে গত কয়েক সপ্তাহ ধরে আন্দোলন চলাকালে পুলিশ এবং বিক্ষোভকারীদের সংঘর্ষ ক্রমশ সহিংস রূপ নেয়। বিক্ষোভকারীরা একপর্যায়ে শেখ হাসিনার পদত্যাগের দাবিতে কঠোর অবস্থান নেয়।
শেখ হাসিনাকে পদত্যাগ এবং দেশত্যাগ করতে হয়।
হাসিনার অবর্তমানে দেশ এক রাজনৈতিক সংকটে পড়ে। সেনাবাহিনী সাময়িকভাবে দেশের নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে, তবে সংসদ ভেঙ্গে দেয়ার পর অন্তর্বর্তীকালীন সরকারে তাদের ভূমিকা কী হবে তা স্পষ্ট নয়।
আন্দোলনের ছাত্র নেতারা অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান হিসিবে ড. ইউনূসের নাম প্রস্তাব করে। ইউনূস বর্তমানে অলিম্পিকে উপদেষ্টা হিসেবে প্যারিস রয়েছেন।
ছাত্রদের অন্যতম নেতা নাহিদ ইসলাম জানান, ৮৩ বছর বয়সী ইউনূস অন্তর্বর্তীকালীন সরকার প্রধানের দায়িত্ব নিতে রাজী হয়েছেন।
ড. ইউনূস হাসিনার একজন সমালোচক ও রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ।
তিনি হাসিনার পদত্যাগকে দেশের ‘দ্বিতীয় স্বাধীনতা দিবস’ বলে অভিহিত করেছেন। হাসিনা একবার তাকে ‘রক্তচোষা’ বলেছিলেন।
পেশায় অর্থনীতিবিদ এবং ব্যাংকার, ইউনূসকে দরিদ্র মানুষদের, বিশেষ করে নারীদের সাহায্য করার জন্য ক্ষুদ্রঋণ ব্যবহারে অগ্রণী ভূমিকা পালন করার জন্য ২০০৬ সালে নোবেল শান্তি পুরস্কারে ভূষিত করা হয়।
নোবেল শান্তি পুরস্কার কমিটি ইউনূস এবং তার গ্রামীণ ব্যাংককে ‘গোড়া থেকে অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নে তাদের প্রচেষ্টার জন্য কৃতিত্ব দিয়েছে।’
ইউনূস ১৯৮৩ সালে গ্রামীণ ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করেন যাতে এমন উদ্যোক্তাদের ক্ষুদ্র ঋণ প্রদান করা হয় যারা সাধারণত ঋণ পাওয়ার যোগ্যতা রাখে না।
দেশের জনগণকে দারিদ্র্য থেকে বের করে আনতে গ্রামীণ ব্যাংকের সাফল্য অন্যান্য দেশে একই ধরনের ক্ষুদ্রঋণ উদ্যোগ চালুর দিকে পরিচালিত করে।
ইউনূস ২০০৯ সালে হাসিনার সাথে ঝামেলায় পড়েন যখন হাসিনার প্রশাসন তার বিরুদ্ধে একাধিক তদন্ত শুরু করে।
ইউনূস ঘোষণা করেন, তিনি ২০০৭ সালে একটি রাজনৈতিক দল গঠন করবেন যখন সামরিক-সমর্থিত সরকার দেশটি পরিচালনা করছিল। যদিও তিনি তা বাস্তবায়ন করতে পারেননি।
তদন্ত চলাকালীন, হাসিনা গ্রামীণ ব্যাংকের প্রধান হিসাবে দরিদ্র গ্রামীণ নারীদের কাছ থেকে ঋণ আদায়ের জন্য ইউনূসের বিরুদ্ধে বলপ্রয়োগ ও অন্যান্য উপায় ব্যবহার করার অভিযোগ তোলেন। ইউনূস এই অভিযোগ অস্বীকার করেন।
হাসিনার সরকার ২০১১ সালে গ্রামীণ ব্যাংকের কার্যক্রম পর্যালোচনা শুরু করে এবং ইউনূসকে সরকারি অবসর বিধি লঙ্ঘনের অভিযোগে ব্যবস্থাপনা পরিচালকের পদ থেকে বরখাস্ত করা হয়।
তার নোবেল পুরস্কার এবং একটি বই থেকে রয়্যালটিসহ সরকারি অনুমতি ছাড়া অর্থ গ্রহণের অভিযোগে ২০১৩ সালে তাকে বিচারের মুখোমুখি করা হয়।
পরে তিনি গ্রামীণ টেলিকমসহ তার তৈরি অন্যান্য কোম্পানির সাথে জড়িত থাকার অভিযোগের সম্মুখীন হন। গ্রামীণ টেলিকম হলো দেশের বৃহত্তম মোবাইল ফোন কোম্পানি গ্রামীণ ফোনের অংশ, যা কিনা নরওয়ের টেলিকম জায়ান্ট টেলিনরের সহযোগী প্রতিষ্ঠান।
কয়েকজন সাবেক গ্রামীণ টেলিকম কর্মকর্তা ২০২৩ সালে ইউনূসের বিরুদ্ধে তাদের চাকরির সুবিধা ছিনিয়ে নেয়ার অভিযোগে একটি মামলা করেন। তিনি এই অভিযোগ অস্বীকার করেন।
এই বছরের শুরুর দিকে, বাংলাদেশের একটি বিশেষ জজ আদালত ২০ লাখ ডলার আত্মসাতের অভিযোগে ইউনূস এবং আরো ১৩ জনকে অভিযুক্ত করে। ইউনূস নিজেকে নির্দোষ দাবি করেন এবং আপাতত জামিনে আছেন।
ইউনূসের সমর্থকরা বলেন, হাসিনার সাথে তার শীতল সম্পর্কের কারণে তাকে লক্ষ্য বানানো হয়েছে।
ইউনূস ১৯৪০ সালে বাংলাদেশের চট্টগ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি যুক্তরাষ্ট্রের ভ্যান্ডারবিল্ট ইউনিভার্সিটি থেকে পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেন এবং বাংলাদেশে ফিরে যাবার আগে সেখানে অল্প সময়ের জন্য শিক্ষকতা করেন।
দ্য অ্যাসোসিয়েটেড প্রেসের সাথে ২০০৪ সালে দেয়া একটি সাক্ষাৎকারে ইউনুস বলেন, তিনি গ্রামীণ ব্যাংক প্রতিষ্ঠার জন্য একটি ‘ইউরেকা মুহূর্ত’ অনুভব করেন যখন তিনি বাঁশের তৈরী আসন বুনছিল এমন এক দরিদ্র নারীর সাথে দেখা করেন। তিনি তার ঋণ পরিশোধ করতে সংগ্রাম করছিলেন।
তিনি সাক্ষাত্কারে বলেন, ‘আমি বুঝতে পারছিলাম না যে তিনি যখন এত সুন্দর জিনিস তৈরি করছিলেন তখন তিনি কিভাবে এত দরিদ্র হতে পারেন।’
সূত্র : ভয়েস অব আমেরিকা