
মানিকগঞ্জ প্রতিনিধি: মানিকগঞ্জ জেলা কারাগারে বন্দি হাজতিদের চিকিৎসার জন্য ২০ শয্যাবিশিষ্ট কারা হাসপাতাল ও একজন ফার্মাসিস্ট রয়েছে। তবে বন্দিদের চিকিৎসা সেবায় নির্মিত এই হাসপাতালে অসুস্থ বন্দিদের চিকিৎসা না হলেও টাকার বিনিময়ে কারা হাসপাতালের বেডে আয়েশি জীবনযাপন করেন অনেক বন্দিরা। জেলা কারাগারের সরকারি হিসাব অনুযায়ী বন্দিদের ধারণ ক্ষমতা ২৪০ জনের থাকলেও সেখানে সোমবার (২৬ জানুয়ারি) বেলা সোয়া ২টা পর্যন্ত রয়েছে ৪৫৮ জন। কারা কর্তৃপক্ষ বলছে, কারাগারে যতজন বন্দি থাকবে সেই অনুযায়ী তিনবেলা খাবার পরিবেশন করা হয়।
সম্প্রতি জেলা কারাগারের নানা অনিয়ম ও দুর্নীতির বিষয়ে বন্দিদের স্বজন ও জামিনে বের হওয়া হাজতিদের অভিযোগের সতত্যা যাচাইয়ে আদালত প্রাঙ্গণ ও কারাগার এলাকায় পরিচয় গোপন করে অনুসন্ধান করে এই প্রতিবেদক। অনুসন্ধানে কারাগারের ভেতরের নানা অনিয়ম, দুর্নীতি ও দুর্বিষহ স্মৃতির কথা, নিম্নমানের খাবার পরিবেশন, টাকার বিনিময়ে কারা হাসপাতালে বেড পাওয়া, বিছানার জন্য বন্দিদের কাছ থেকে টাকা নেওয়াসহ নানা অনিয়মরে চিত্র উঠে আসে। কারাগারের প্রতিটি ওয়ার্ডে রাইটারসহ কয়েকজন দায়িত্বে থাকেন।
দায়িত্বরত ব্যক্তিরাই কারাগারের বন্দিদের কাছ থেকে বিছানার জন্য টাকা নিয়ে থাকেন। তবে বিছানার জন্য নির্দিষ্ট টাকার পরিমাণ না থাকলেও যার (বন্দি) কাছ থেকে যেভাবে পারেন টাকা নেওয়া হয়। গত বছরের ১৮ ডিসেম্বর জামিনে কারাগার থেকে বের হন আবু তালেব।
তিনি বলেন, ‘গত বছরের নভেম্বরের ৩ তারিখ থেকে ৪৬ দিন কারাগারে ছিলাম।’ এই সময়ের একাধিক দুঃসহ স্মৃতি চারণ করে বলেন, ‘জেলহাজতের প্রতিটি ওয়ার্ডের বাইটারসহ যারা দায়িত্বে থাকেন, তারাই বন্দিদের কাছ থেকে বিছানার জন্য টাকা নেন। তখন এক বন্দির কাছে বিছানার জন্য ১ হাজার ৫০০ টাকা দাবি করেন। টাকা না দিলে টয়লেটে থাকতে হবে বলেও বন্দিদের ভয়ভীতি দেখানো হয়।
আসামি নজরুল ব্যাপারি বলেন, দেড় মাসের বেশি সময় কারাগারে ছিলাম। টাকা ছাড়া কোনো কিছুই দেয় না। টাকা না দিলে মেঝেতে ছালা বা ফাইলে ঘুমাতে হয়। ওদের কাছে টাকাই সব।
জেলা কারাগারের জেল সুপার হিসেবে যোগদানের পর মোহাম্মদ হুমায়ুন কবীর খান (জেল সুপার) জেলহাজতে বন্দি ও কারাগার পরিদর্শন করেন। এ সময় আনোয়ার নামের এক বন্দি কারাগারের নানা অনিয়ম, দুর্নীতি ও খাবারের বিষয়টি জানান এবং বন্দিদের খাবারের পরিমাণ কম দেওয়ায় অসন্তোষ প্রকাশ করেন। এরপর জেল সুপারের নির্দেশের পর বেশ কয়েকদিন খাবারের পরিমাণ বাড়লেও তা পরে আগের জায়গাই ফিরে যায়। অর্থাৎ জেল সুপারের নির্দেশের পরেও বন্দিদের নিন্মমানের খাবার পরিবশেন করা হচ্ছে।
দেড় মাসের বেশি সময় জেলে থেকে গত বছরের ১৮ ডিসেম্বর জামিনে বের হয়েছেন শিবালয়ের হারেজ। তিনি বলেন, ‘নতুন জেল সুপার এক দিন পরিদর্শনে আসার পর যারা রান্না-বান্না করেন তাদের ডেকে আনছিলেন। ওই সময় তাদের বলেছিলেন, বন্দিদের খাবার কম কেন দেওয়া হয়। এরপর কয়েকদিন খাবারের পরিমাণ বাড়ছিল, আর আমরা তো জানি না কতটুক পরিমাণ খাবার আমাদের দেবে বা নিয়মটা কি? তবে সপ্তাহে দুইবার মাংস পেয়েছি, কিন্তু কয়বার মাংস পাবো সেই নিয়ম তো আমাদের জানা নাই।আসামি নজরুল বলেন, ‘জেলখানার খাবারের মান ভালো হলে ক্যান্টিন চলবে কীভাবে? ওদের খাবার যদি ভালো হতো তাহলে তো বন্দিদের আর ক্যান্টিনের খাবার কিনে খেতে হতো না। আসলে কি পরিমাণ বরাদ্দ থাকে তা বন্দিদের জানা সম্ভব না।’
সিংগাইর উপজেলার হাজতি শিপলুর বাবা ইদ্রিস আলী বলেন, ‘একটি মামলায় আমার ছেলে দুই নম্বর আসামি ছিল। পরে ১৯ জানুয়ারি ছেলের সঙ্গে দেখা করি, তখন ছেলে আমাকে বলে, “বাবা জেলখানার খাবারের মান খুবই খারাপ।” গরিব হইলেও জেলখানার মতো খারাপ মানের খাবার কখনো আমার ছেলে খায় নাই। পরে কি করমু ছেলের খাবারের জন্য কারাগারের ক্যান্টিনে ৬০০ টাকা জমা দিছিলাম, যাতে একটু ভালোমানের খাবার খাইতে পারে। তবে জেলখানায় আগে দেখা করতে গেলে ২০০ টাকা লাগতো, এখন এই টাকা লাগে না। এইটা খুবই ভালো। টাকা দিলে কারা হাসপাতালে মিলে আয়েশি জীবন।
অনুসন্ধান বলছে, ৫ হাজার টাকা দিলে এক মাসের জন্য কারা হাসপাতালের শয্যা বরাদ্দ পাওয়া যায়। ব্যক্তি বিশেষে এই টাকা ওঠানামা করলেও ঘুষ ছাড়া কেউ শয্যা পায় না। আসামিকে প্রথম দিন ওয়ার্ডে কাটাতে হয়, আগের দিন ঘুষের টাকা দিলেই পরের দিন থেকে কারা হাসপাতালের বেডে আরাম-আয়েশে থাকতে পারেন হাজতি। এক মাসের আগে জামিন হয়ে গেলে ওই টাকা ফেরত দেওয়া হয় না। এক দিন থাকলেও পাঁচ হাজার, এক মাস থাকলেও পাঁচ হাজার। তবে কারাগারের কোনো কর্মকর্তা বা কর্মচারিরা অপরিচিত কারো সঙ্গে এই টাকার লেনদেন করেন না। ধরা ছোঁয়ার বাইরে থাকতে নির্দিষ্ট পরিচিত লোকজনের সঙ্গে তারা লেনদেন করেন।
মানবাধিকার কর্মী মো. নজরুল ইসলাম বলেন, আসামি হলেও তারা মানুষ। কোনো সাজাপ্রাপ্ত আসামিরও মৌলিক অধিকার আছে, যা খর্ব করা যাবে না। সরকার নির্ধারিত সুযোগ-সুবিধা অবশ্যই বন্দিদের নিশ্চিত করা কারা কর্তৃপক্ষের দায়িত্ব। কারাগারের অসাধু কর্মকর্তারা যদি বন্দিদের কাছ থেকে টাকা বা ঘুষ নিয়ে সুযোগ-সুবিধা দিয়ে থাকেন তাহলে এটি অন্যায়, মানবাধিকার লঙ্ঘন ও দুর্নীতি। সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) মানিকগঞ্জ জেলা শাখার সিনিয়র সহসভাপতি ইকবাল হোসেন কচি বলেন, ‘জেলা কারাগার এখন বাইরে ফিটফাট ভেতরে সদরঘাট। সাক্ষাত করতে আগে টাকা লাগতো এখন লাগে না -এমন দৃশ্য দেখিয়ে ভেতরে ঠিকই দুর্নীতি বিদ্যমান। জেলের ভেতরে টাকাওয়ালারা ঘুষ দিয়ে হাসপাতালে আরাম-আয়েশে থাকে আর গরিবরা টাকা না থাকায় প্রাপ্য তোষক-বালিশের অধিকারটুকুও পায় না। এমন অনিয়ম বন্ধে কারা পরিদর্শনকারীদের ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিত।’
এ বিষয়ে মানিকগঞ্জ জেলা কারাগারের জেল সুপার মোহাম্মদ হুমায়ুন কবির খান বলেন, ‘বন্দির খাবারের মান ভালো করার জন্য নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। আগের চেয়ে বর্তমানে খাবারের মান ভালো, আর সরকারি নিয়ম অনুযায়ী কারাগারের বন্দিরা বিছানা পাবেন। কেউ যদি বিছানার জন্য টাকা নিয়ে থাকলে অভিযোগ পেলে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
টাকা দিলেই কারা হাসপাতালের বেডে থাকা যায় কিনা—এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ‘টাকার বিনিময়ে কারা হাসপাতালে কোনো বন্দির থাকার সুযোগ নেই। তবে কেউ অভিযোগ দিলে বিষয়টি খতিয়ে দেখা হবে। বন্দিদের সেবা নিশ্চিত করতে আমরা কারা কর্তৃপক্ষ কাজ করে যাচ্ছি।’
জেলা প্রশাসক ড. মানোয়ার হোসেন মোল্লা বলেন, জেলা কারাগার পরিদর্শন করে নজরদারি বাড়ানো হয়েছে, তবে কোথাও কোনো অনিয়ম বা ঘাটতি থাকলে সেটা ঠিক করা হচ্ছে। অনিয়মের সঙ্গে কোনো অসাধু কর্মকর্তা জড়িত থাকলে তা খতিয়ে দেখা হবে। কোনো ধরনের অনিয়ম বা দুর্নীতি পাওয়া গেলে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে জানান তিনি।