
মানিকগঞ্জ প্রতিনিধি: ‘লোক সংগীত আর হাজারী গুড়, মানিকগঞ্জের প্রাণের সুর’। ঐতিহ্যবাহী এই গুড়ের নামেই ব্র্যান্ডিং করা হয়েছে মানিকগঞ্জের। পদ্মা-যমুনা, ইছামতি, কালিগঙ্গা, ধলেশ্বরীসহ বেশ কয়েকটি নদীবেষ্টিত এই জেলার ঐতিহ্যের মধ্যে অন্যতম হাজারি গুড়।
গুড় উৎপাদনের মূল উপদান রস আর খেজুর গাছ। গাছের সংখ্যা দিন দিন কমে যাওয়ায় রস সংগ্রহ হচ্ছে কম। এতে হাজারী গুড়ের উৎপাদনও কমছে। গত ১০ বছরে ১৮ হাজারের বেশি খেজুর গাছ কমে যাওয়ার পাশাপাশি কমেছে রসের পরিমাণও। ফলে চলতি বছর হাজারি গুড় উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের শঙ্কাও করছেন গাছিরা।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্যমতে, জেলায় খেজুর গাছের সংখ্যা ৩৩ হাজার ২৭৫টি। এর মধ্যে ১৯ হাজার ২২৩টি গাছ থেকে রস সংগ্রহ করা যায়। ১০ বছর আগে খেজুর গাছের সংখ্যা ছিল ৫১ হাজার ৫৬০টি। গত ১০ বছরে গাছ কমেছে ১৮ হাজার ২৮৫টি। গড়ে প্রতিবছর ১ হাজার ৮২৯টি করে খেজুর গাছ কাটা পড়েছে। এ বছর জেলায় লাল গুড় উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ১ হাজার ৪৪২ মণ আর বিশেষ প্রক্রিয়ায় তৈরি করা শতবছরের ঐতিহ্যবাহী হাজারী গুড়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ২৩৮ মণ।
জেলার শতাধিক পরিবার এই গুড় তৈরির সঙ্গে প্রত্যেক্ষভাবে জড়িত থাকলেও হরিরামপুর উপজেলার ঝিটকা এলাকার শিকদার পাড়াসহ আশপাশের মাত্র ২৫টি পরিবার তৈরি করে হাজারী গুড়। বাকিরা তৈরি করেন নাম্বারী গুড় যা বাজারে লাল গুড় নামে পরিচিতি। মান ভেদে লাল বা নাম্বারি গুড় বিক্রি হয় কেজি প্রতি ২০০ টাকা থেকে ৩০০ টাকায়। আর হাজারী গুড় বিক্রি হয় প্রতি কেজি ১ হাজার ৬০০ টাকা থেকে ২ হাজার টাকা পর্যন্ত। দাম চড়া থাকায় নিম্ন বা নিম্নমধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষের কাছে হাজারি গুড় কেনাও কষ্টসাধ্য বিষয়। তবে হাজারী গুড় কিনতে হলে গাছ পরিবারকে অগ্রিম অর্ডার দিতে হয়। না হলে কাঙ্খিত পরিমাণ গুড় পাওয়া সম্ভব নয় বলে জানান গুড় উৎপাদনকারীরা। উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে শঙ্কা মূলত শীতের আগমনের পর পর অর্থাৎ অগ্রহায়ণ, পৌষ, মাঘ ও ফাল্গুনের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত খেজুর গাছ থেকে রস সংগ্রহ করতে পারেন গাছিরা। এর মধ্যে পৌষ, মাঘ ও ফাল্গুনের মধ্য সময় পর্যন্ত রস থেকে বিশেষ পক্রিয়ায় হাজারী গুড় তৈরি করা যায়। কিন্তু চলতি বছরের শুরুতেই অনাবৃষ্টি ও অনুকূল আবহাওয়া না থাকায় অগ্রহায়নের শেষের দিকে খেজুর গাছ থেকে রস সংগ্রহ শুরু হয়। যা পরিমাণেও অনেক কম। এতে বিগত বছরগুলোর তুলনায় প্রায় এক মাস পিছিয়ে পড়েছেন গাছিরা। আর এ জন্যই এ বছর হাজারী গুড়ের উৎপাদন কম হওয়ার শঙ্কা করছেন গাছিরা।
দিন দিন কমছে খেজুর গাছ
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর বলছে, প্রতিবছর গড়ে জেলায় খেজুর গাছের সংখ্যা কমছে ১ হাজার ৮২৯টি করে। আর গত ১০ বছরে কমেছে ১৮ হাজার ২৮৫টি খেজুর গাছ।
স্থানীয় গাছিরা মনে করছেন, জমি কেনা-বেচা, বসতবাড়ি নির্মাণ, বেশি বয়স হওয়ায় খেজুর গাছ থেকে কাঙ্ক্ষিত উৎপাদন সক্ষমতা কমে যাওয়া এবং প্রয়োজন ছাড়া খেজুর গাছ নিধন করায় আশঙ্কাজনক হারে জেলায় কমছে খেজুর গাছের সংখ্যা। এ ছাড়া মানবসৃষ্ট নানা কারণে জলবায়ু ও পরিবেশের বিপর্যয়ের জন্যেও খেজুর গাছ কমে যাওয়ার অন্যতম কারণ হিসেবে দেখছেন পরিবেশবাদীরা।
আলোর মুখ দেখেনি জেলা প্রশাসকের প্রকল্প
শতবছরের ঐতিহ্যবাহী হাজারী গুড়ের সুনাম অক্ষুণ্ণ ও ঐতিহ্যকে ধরে রাখাসহ দেশ-বিদেশে এই গুড়ের সমৃদ্ধি প্রসার করার এবং পুরো জেলাকে সবুজায়ন করতে ৫ লাখ খেজুর গাছের চারা রোপণের লক্ষ্যে ‘শ্যামল নির্মল ঐতিহ্যে-মানিকগঞ্জ’ নামের একটি বিশেষ উদ্যোগ গ্রহণ করেছিলেন মানিকগঞ্জের তৎকালীন জেলা প্রশাসক রেহেনা আক্তার। জেলার ঝিটকা এলাকায় শিকদার পাড়া গ্রামের তৈরি করা হবে ‘হাজারী পল্লী।’
কিন্তু জুলাই-আগস্টের আন্দোলন ও গণ-অভূত্থ্যানে স্বৈরাচার সরকার পতনের পর ডিসির ওই প্রকল্পের নানা অনিয়ম ও দুর্নীতি নিয়ে গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশিত হয়। এরপর তৎকালীন জেলা প্রশাসক রেহেনা আকতারকে গত বছরের ১১ সেপ্টেম্বর মানিকগঞ্জ থেকে প্রত্যাহার করে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে সংযুক্ত করা হয়। যার কারণে প্রকল্পটি আর আলোর মুখ দেখেনি। প্রকল্পটিতে বরাদ্দ করা হয়েছিল প্রায় ৩ কোটি টাকা।
জেলার হরিরামপুর এলাকার সিদ্দিক গাছি বলেন, দীর্ঘদিন ধরে গুড় তৈরির কাজ করছি। প্রতিবছর অগ্রহায়ণের শুরুতেই রস সংগ্রহ করে থাকি। তবে এ বছর অনাবৃষ্টির কারণে দেরিতে খেজুর গাছ কাটতে হয় এবং রস সংগ্রহে একমাস পিছিয়ে পড়েছি। আগে চার মাস পরলেও এ বছর বৃষ্টির কারণে তিন মাস রস সংগ্রহ করতে পারব। ফলে গত বছরের তুলনায় এ বছর হাজারী গুড় উৎপাদন অনেক কমে আসবে।
রহিজ হাজারী বলেন, এবছর বৃষ্টির কারণে আমরা সময় মতো গাছ কাটতে পারিনি। আমাদের রস সংগ্রহ শুরু হয়েছে তবে হাজারী গুড়ের চাহিদা অনেক রয়েছে। আবহাওয়ার জন্য এবার পিছিয়ে পড়ার কারণে হাজারী গুড় উৎপাদন অন্যসব বছরের তুলনায় কমবে।
হাজারী পরিবারের সদস্য জাহিদ হাজারী বলেন, ঝিটকা এলাকার শতাধিক পরিবার এই হাজারী গুড় তৈরি করতো। কিন্তু এখন মাত্র ২৫টি পরিবার এ পেশার সঙ্গে সম্পৃক্ত আছে। আগে গাছও ছিল অনেক, মৌসুমে হাজার মন হাজারী গুড় উৎপাদন করা যেতো। খেজুর গাছ ও গাছির সংখ্যা কমে যাওয়ায় হাজারী গুড়েও উৎপাদন অনেক কমে গেছে। নতুন করে গাছ রোপণ, গাছি পরিবারের সদস্যদের প্রশিক্ষণ এবং সরকারি সহযোগিতার মাধ্যমে জেলার এই ঐতিহ্যবাহী শিল্পটি টিকিয়ে রাখা সম্ভব বলে তিনি জানান।
ঝিটকা বাজারের গুড় ব্যবসায়ী ওয়াসিম বলে, স্থানীয় গাছিদের কাছ থেকে লাল গুড় সংগ্রহ করে বিক্রি করি। মান ভেদে নাম্বারী গুড় ৩০০ টাকা থেকে ৫০০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে। তবে হাজারী গুড় উৎপাদনে এ বছর গাছিরা প্রায় একমাস পিছিয়ে পড়েছেন। চাহিদা অনুযায়ী গাছিরা এবার হাজারী গুড় উৎপাদন করতে পারছেন না। এ জন্য স্থানীয় বাজারে অন্যসব গুড় থাকলেও হাজারী গুড় কম থাকায় আমাদের ব্যবসাও কম।
ঝিটকা বাজারের গুড় ব্যবসায়ী শফিক বিশ্বাস বলেন, স্থানীয় বাজার ও সারা দেশ থেকেই অনেক ক্রেতা এই গুড়ের জন্য অগ্রীম অর্ডার দেন। আমরা ক্রেতাদের ১ হাজার ৬০০ টাকা থেকে ২ হাজার টাকায় প্রতি কেজি হাজারী গুড় বিক্রি করে থাকি। তবে এবার ক্রেতাদের চাহিদা অনেক থাকলেও হাজারী গুড়ের উৎপাদন গতবছরের তুলনায় অনেক কম।
হাজারী গুড় উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে জানতে চাইলে জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক ড. রবীআহ নূর আহমেদ বলেন, এবছর বৃষ্টিতে গাছিরা রস সংগ্রহে পিছিয়ে গেছে। তবে শীতের শেষ অংশে তারা এ ক্ষতি পুষিয়ে নিতে পারবে বলে আশা করছেন। যেহেতু হাজারী গুড় তৈরিতে শীতে প্রকোপ বেশি প্রয়োজন হয়, মৌসুমের শেষের দিকে যদি শীতে প্রকোপ কমে যায়,তাহলে উৎপাদনে কিছুটা প্রভাব পড়তে পারে। তবে হাজারী গুড়ের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন না হলেও লাল গুড় বা নাম্বারী গুড় লক্ষ্যমাত্রার অধিক উৎপাদন হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে বলে তিনি জানান।