এম এ কাইয়ুম চৌধুরী,শিবালয় প্রতিনিধি: আঁকাবাঁকা মেঠোপথ ধরে একটু এগোতেই শতবর্ষী বিশাল বটগাছ। চাঁদের আলোয় ঝিরিঝিরি বাতাসে বটপাতায় ঢেউ খেলছে। এমনই মনোমুগ্ধকর পরিবেশে বটগাছটির নিচেই বসেছে বাঙালি সংস্কৃতির প্রাচীন ঐতিহ্য গাজির গানের আসর। গাছতলায় বসে উপভোগ করছেন কয়েকশ নারী-পুরুষ।
গত শুক্রবার রাতে মানিকগঞ্জের ঘিওর উপজেলার কাউটিয়া গ্রামে মঞ্চস্থ হয় গাজির গান। লোকসংস্কৃতির বিলুপ্তপ্রায় এই ধারা নতুন প্রজন্মের কাছে তুলে ধরতেই এ পালার আয়োজন করে স্থানীয় প্রাকৃতিক কৃষিকেন্দ্র।
গায়ে আলখাল্লা, পায়ে ঘুংঘুর, মাথায় পাগড়ি পরে আসরের চারদিকে ঘুরে ঘুরে গান গাইছেন গায়েন। ‘পুবেতে বন্দনা করি পুবের ভানুশ্বর। এদিকে উদয় রে ভানু চৌদিকে পশর …তার পরে বন্দনা করি গাজি দয়াবান। উদ্দেশে জানায় ছালাম হেন্দু মোছলমান।’ সঙ্গে ঢোলক, বাঁশিবাদক ছাড়াও চারজন দোহারের সম্মিলিত সুরের মূর্ছনা। গাঁয়ের মানুষের সঙ্গে বসে শহুরে আগন্তুকরাও মন্ত্রমুগ্ধের মতো উপভোগ করছেন গাজির গানের পালা।
রাজধানী থেকে আসা সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব মীর হুযাইফা আল-মামদূহ বলেন, লোকসংস্কৃতির এক ভিন্নধর্মী সমৃদ্ধ ধারা গাজির গান বা গাজির গীত। কালের প্রবাহে আকাশ সংস্কৃতির অতি প্রচারণায় ক্রমেই লোকচক্ষুর অন্তরালে হারিয়ে যাচ্ছে এই গাজির গান। গাজির গানের শিল্পরস আধুনিক শ্রোতাকেও মানবিকতায় আহ্বান করে। তাই শিকড়ের সন্ধানে এখানে এসেছেন তিনি।স্থানীয় বাসিন্দা প্রবীণ আয়নাল হোসেন বলেন, গ্রামবাংলার মানুষের সুখ-দুঃখ, আবেগ-অনুভূতি ছাড়াও জীবন ও জগতের অনেক গভীর তত্ত্বকথা উঠে আসে এই সংগীতে। দুই দশক আগেও মানিকগঞ্জের গ্রমেগঞ্জে ব্যাপক প্রচলন ছিল গাজির গানের।
প্রাকৃতিক কৃষিকেন্দ্রের পরিচালক দেলোয়ার জাহান বলেন, গাজির গান মূলত গাজি পীরের বন্দনা ও মাহাত্ম্য গীতি। মানুষের মধ্যে সম্প্রীতির বাণী ছড়িয়ে দেয় গাজির গান। ইন্টারনেটকেন্দ্রিক সংস্কৃতির দাপটে হারিয়ে যেতে বসেছে গাজির গান। লোকসংস্কৃতির এই ধারা নতুন প্রজন্মের কাছে তুলে ধরতেই এই আয়োজন।
প্রথমে আসর বন্দনা, এর পর গাজির জন্মবৃত্তান্ত, দৈত্য–রাক্ষসের সঙ্গে ভয়ংকর যুদ্ধের বর্ণনা, নানা বিপদ থেকে মুক্ত করে পুণ্যবান ভক্ত সওদাগরের নৌকা বহর রক্ষা– এসব বর্ণনা এমনভাবে উপস্থাপন করা হয় গাজির গানে যে, দর্শক-শ্রোতা মুগ্ধতায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়েন। কয়েকজন নারী-পুরুষকে ফুপিয়ে কেঁদে উঠতে দেখা যায়।
স্থানীয় কৃষক কালাচাঁন মিয়া বলেন, সন্তান লাভ, রোগব্যাধি থেকে মুক্তি, ফসল ভালো হওয়া– এসব মনবাসনা পূরণে গাজির গানের পালা হতো। আগে গ্রামের প্রায় বাড়িতেই এ গানের আসর বসত। এখন চোখে পড়ে না।
ঘিওর উপজেলা প্রশাসন সূত্র জানায়, গ্রামবাংলার ঐতিহ্য ধরে রাখতে গাজি-কালুর পালাগানের আয়োজন করা উচিত। শিল্পী ও কলাকুশলীদের পৃষ্ঠপোষকতা ও সহযোগিতা করার আশ্বাস দেন তিনি।
বয়স ষাট ছুঁইছুঁই আওলাত গায়েন এই আসরের মূল গায়েন। তিনি বলেন, অযত্ন-অবহেলায় হারিয়ে যাচ্ছে গাজির গানের পালা। এই গানের শিল্পীরা বেশির ভাগই দরিদ্র। আগে মানুষ খুশিমনে এই পালার আয়োজন করত। এখন তাদের কদর তলানিতে ঠেকেছে। তাই পৃষ্ঠপোষকতার পাশাপাশি বেশি বেশি গানের আয়োজন করলে গাজীর গীত টিকে থাকবে।