জাকজমকপূর্ণ আর চোখ ধাঁধানো অফিস। জাতীয় পত্রিকার মাধ্যমে চাকরির বিজ্ঞাপন প্রচার। ঢাকায় দুটি অফিসে আর গাজীপুরে ট্রেনিং সেন্টারের বিবরণে বেকার চাকরিপ্রত্যাশীদের ভিড় লেগে যায় অফিসে। চাকরিপ্রার্থীকে হাসপাতালের ওয়ার্ড বয়, স্বাস্থ্য সহকারী, স্বাস্থ্য সেবিকা, তাদের অফিসের আঞ্চলিক ম্যানেজার হিসেবে নিয়োগের জন্য নেয়া হয় ইন্টারভিউ। এরপর মোটা অঙ্কের টাকা নিয়ে কাউকে চুক্তিভিত্তিক, কাউকে অস্থায়ী আবার কাউকে মাস্টাররোলে নিয়োগপত্র ধরিয়ে দেয়। কিন্তু চাকরিতে যোগদান করতে গিয়ে স্পষ্ট হয় এর সবই ছিল প্রতারণা।
কখনো কখনো অনেকেই দু-এক মাসের জন্য নিয়োগপত্র দেয়, বেতনও প্রদান করে। ‘এপি ইন্টারন্যাশনাল প্রাইভেট লিমিটেডের আদলে গড়ে উঠেছে একটি ভুয়া প্রতারকচক্র।
বৃহস্পতিবার (১৭ অক্টোবর) সন্ধ্যা থেকে শুক্রবার সকাল পর্যন্ত রাজধানীর উত্তরায় সেক্টর-৪-এ অভিযান চালিয়ে একটি ভবন থেকে আটজনকে আটক করে র্যাব-৪ এর একটি দল।
র্যাব বলছে, ভুয়া নিয়োগপত্র প্রদান ও লোক দেখানো ভুয়া চাকরি প্রদানের মাধ্যমে প্রতারণা করে প্রায় তিন কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে প্রতারকচক্রটি।
আটকরা হলেন-গিয়াসউদ্দিন পিন্টু ওরফে আকাশ (৩৭), মো. হাসান গাজী (৩১), বিল্লাল শেখ (৩০), শেখ শের আলী রাজু (৩০), গণেশ প্রসাদ সাধন (৪১), মো. সোহাগ (৩১), আজাদুল ইসলাম (১৯) ও রশি আক্তার (২১)।
এ সময় তাদের কাছ থেকে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অধীনে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের আওতাধীন শূন্যপদে অফিস সহকারী পদে এবং অন্যান্য প্রতিষ্ঠানে যোগদানের ভুয়া নিয়োগপত্র, এপি ফাউন্ডেশনের মানি রিসিপ্ট, গোল্ডেন লাইন মেডিকেল সেন্টারের সিলযুক্ত খালি মেডিকেল চেকআপ ফরম, এপি ইন্টারন্যাশনাল প্রাইভেট লিমিটেডের বাঁধাই করা প্রজেক্ট প্রাফাইল, এপি ফাউন্ডেশনের টাইপকৃত প্যাডে চেয়ারম্যান, পুলিশ সুপার, জেলা প্রশাসক এবং উপজেলা নিবার্হী কর্মকর্তা বরাবর প্রদত্ত চিঠির কপি, এপি ফাউন্ডেশনের বিভিন্ন কর্মকর্তা-কর্মচারীর নামযুক্ত পদবির সিলসহ কম্পিউটার ও ল্যাপটপ জব্দ করা হয়।
র্যাব সদর দপ্তরের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের সিনিয়র সহকারী পরিচালক সিনিয়র এএসপি মিজানুর রহমান বলেন, ‘র্যাবের জিজ্ঞাসাবাদে গ্রেপ্তাররা প্রতারণার কথা স্বীকার করে প্রতারণার কলাকৌশল, তাদের সংগঠন ও প্রতারণা চক্রের অভিনব তথ্য দিয়েছে। সেগুলো যাচাই করা হচ্ছে এবং প্রতারকচক্রে জড়িত অন্যান্যদের গ্রেপ্তারে অভিযান চলছে।’
র্যাব-৪ সূত্রে জানা যায়, প্রতারণার প্রথমে ধাপে প্রতারকচক্রটি রাজধানীর উত্তরা ও বিভিন্ন এলাকায় অফিস ভাড়া করে জাঁকজমকপূর্ণ চোখ ধাঁধানো ডেকোরেশন করে, যা বেকার চাকরিপ্রত্যাশীদের সহজেই আকৃষ্ট করে। চক্রটি বিভিন্ন পত্রিকার মাধ্যমে বিজ্ঞাপন দিয়ে প্রথমে অফিসের বিভিন্ন পদের লোক নিয়োগ করে থাকে।
দ্বিতীয় ধাপে চাকরিপ্রত্যাশীদের সংশ্লিষ্ট কাগজপত্রসহ ঊর্ধ্বতন ভুয়া কর্মকর্তার সঙ্গে সাক্ষাতের ব্যবস্থা করে এবং তাদের যাবতীয় কাগজপত্র লোক দেখানো যাচাই-বাছাই করে চাকরি-সংক্রান্ত বিভিন্ন শর্ত আরোপ করে। চাকরিপ্রত্যাশীদের মধ্যে অনেকেই শর্ত মেনে নিলে চাকরি প্রদানের বিনিময়ে মোটা অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নেয়ার জন্য মৌখিক অথবা লিখিত চুক্তি সম্পন্ন করে। প্রতারকচক্রের এ পর্যায়ের সদস্যরা সংশ্লিষ্ট চাকরিপ্রার্থীকে সচিবালয়ের ভেতরে নিয়ে মৌখিক পরীক্ষা সম্পন্নের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের কথাও জানায়।
তৃতীয়ত, চাকরিপ্রত্যাশীদের মৌখিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণসহ ভুয়া নিয়োগপত্র প্রাপ্তির বিষয়টি নিশ্চিত করে নিয়োগপত্র প্রদান করে এবং চুক্তি মোতাবেক মোটা অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নেয়। হাসপাতালের ওয়ার্ড বয়, স্বাস্থ্য সহকারী, স্বাস্থ্য সেবিকা, তাদের অফিসের আঞ্চলিক ম্যানেজার হিসেবে চুক্তিভিত্তিক, অস্থায়ী ও মাস্টাররোলে ভুয়া নিয়োগপত্র প্রদান করে। অনেককে দু-এক মাসের জন্য নিয়োগ দিয়ে বেতনও দিয়ে দেয়। পরে চাকরিপ্রার্থীরা জানতে পারেন, তাদের নিয়োগপত্র এবং চাকরি উভয়ই ভুয়া এবং তারা প্রতারণার স্বীকার হয়েছেন।
প্রতারকচক্রটি এপি ইন্টারন্যাশনাল প্রাইভেট লিমিটেডের নকল লোগো ব্যবহার করে এপি ইন্টারন্যাশনাল প্রাইভেট লিমিটেডের অধীনে এপি এক্সপোর্ট অ্যান্ড ইমপোর্ট, এপি ফিশারিজ অ্যান্ড এগ্রিকালচার, এপি ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট, এপি সিকিউরিটি ফোর্স অ্যান্ড ক্লিনার সার্ভিস, এপি ফাউন্ডেশন, এপি ফ্যাশন নামক বিভিন্ন ভুয়া প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করে আসছিল।
রাজধানীর উত্তরায় প্রতারণা কাজে ব্যবহারের জন্য তাদের দুটি অফিস এবং জামালপুরে লোক দেখানো ভুয়া ট্রেনিং সেন্টারও রয়েছে। প্রতারকচক্রটি গত ৩-৪ বছর ধরে এভাবে প্রতারণা করে প্রায় তিন কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। দেশের বিভিন্ন প্রত্যন্ত এলাকার চেয়ারম্যান, মেম্বারের কাছে বিভিন্ন চিঠি প্রদান করেও প্রতারণার মাধ্যমে টাকা হাতিয়ে নিয়েছে চক্রটি।