বিশ্বকাপ ফুটবলের ইতিহাসে এই পর্যন্ত ২০টি আসর অনুষ্ঠিত হয়েছে। এবার ১৪ জুন থেকে রাশিয়ায় শুরু হচ্ছে ২১তম আসর। এর মধ্যে অসংখ্য ম্যাচ রয়েছে, যেগুলো উত্তেজনার তুঙ্গে ছিল। এর মধ্যে স্মরণীয় ১০টি ম্যাচ এখানে তুলে দেয়া হলো।
পশ্চিম জার্মানি বনাম ফ্রান্স ৩-৩ (৫-৪)
(সেমিফাইনাল) স্পেন, ১৯৮২
অনেকের মতে, শুধু বিশ্বকাপেই নয় এ ম্যাচটি হলো ফুটবল ইতিহাসের সবচেয়ে উত্তেজনাপূর্ণ ও জমজমাট ম্যাচ। খেলার প্রতিটি মুহূর্তেই ছিল টান টান উত্তেজনা। ফ্রান্স ছিল শিরোপা জয়ের টপ ফেভারিট। কিন্তু তারা এখানেই ধরা পড়ে।
খেলার ধারা অনুযায়ী ফ্রান্সেরই এগিয়ে যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু পিয়েরে লিটবারস্কি জার্মানিকে এগিয়ে দেন। তবে ২৬ মিনিটের সময়ে পেনাল্টি থেকে মাইকেল প্লাতিনি সমতা প্রতিষ্ঠা করেন। প্রথমার্ধ ১-১ থাকে। দ্বিতীয়ার্ধেও কোনো গোল হয়নি। তবে এসময়ে জার্মান গোলরক্ষক হ্যারাল্ড টনি শুমেকার আগুয়ান প্যাট্টিক ব্যাটিস্টনকে মারাত্মক একটি ফাউল করলেও ডাচ রেফারি চার্লস করভার এমনকি ফ্রিকিক পর্যন্ত দেননি। অতিরিক্ত সময়ের দুই মিনিটেই ম্যারিয়াস ট্রেসর গোল করেন।
তারপর অ্যালেন গিরেসে যখন আরেকটি গোল করলেন, তখন সবাই ধরে নিয়েছিল, খেলার ফলাফল হয়ে গেছে এবং ফ্রান্স ফাইনালে উঠে পড়েছে। কিন্তু জার্মানি যে দমের জন্য পরিচিত, তা আরেকবার দেখা দেয়। কার্ল-হেইঞ্জ রুমেনিগে অতিরিক্ত সময়ের প্রথমার্ধেই ব্যবধান কমিয়ে আনেন। তারপর ক্লাউস ফিশার সমতা প্রতিষ্ঠা করেন। ফলে পেনাল্টিতে গড়ায় ম্যাচটি।
আর এতে ফ্রান্সের সমস্ত স্বপ্ন ধূলোয় মিশিয়ে দিয়ে জার্মানি ৫-৪ গোলে জয়ী হয়ে ফাইনালে উঠে। জার্মান গোলরক্ষক শুমেকার সিদ্ধান্তসূচক সেভ করেন। কিন্তু ফাইনালে জার্মানির স্বপ্ন ভেঙ্গে দেয় ইটালি ৩-১ গোলে চ্যাম্পিয়ন হয়ে।
ইটালি বনাম পশ্চিম জার্মানি (৪-৩)
(সেমিফাইনাল), মেক্সিকো, ১৯৭০
১৯৭০ সালের মেক্সিকো বিশ্বকাপের, ইটালি-পশ্চিম জার্মানির মধ্যকার সেমিফাইনাল ম্যাচটি বিশ্বকাপ ফুটবলের আরেক দর্শনীয় ম্যাচ। ম্যাচটিতে এতোই প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয়েছে যে, শেষ মুহূর্তেও ধারণা করা যায়নি, কোন দল জিতবে। কোয়ার্টার ফাইনালে জার্মানি দুই গোলে পিছিয়ে পড়েও শেষ পর্যন্ত ৩-২ গোলে জিতে যায়।
কিন্তু সেমিফাইনালে ইটালি বেশ সহজে জয় পাবে বলে মনে হচ্ছিল। রবার্তো বনিনসেগনার গোলে এগিয়ে যায় ইটালি। তবে ৯০তম মিনিটে কাল-হেইঞ্জ সেলেঞ্জার সমতা ফিরিয়ে আনেন। ফলে অতিরিক্ত সময়ে গড়ায় ম্যাচটি। অতিরিক্ত সময়ে ম্যাচটি আরো জমে ওঠে। অতিরিক্ত ৩০ মিনিটে (সিলভার গোল) একের পর একে গোল হয় মোট ৫টি। জার্মানির গার্ড মুলার দলকে এগিয়ে নেন। কিন্তু টারসিসিও বার্গারিস ও গিগি রিভা দুটি গোল করে ইটালির সম্ভাবনা বাড়িয়ে দেন। ভাঙ্গা পা নিয়ে বেকেনবাওয়ার দারুণ একটি পাস দেন এবং তা থেকে মুলার আবার সমতা ফেরালে জার্মানির সম্ভাবনা বেড়ে যায়। কিন্তু গিয়ানি রিভেরার ভিন্ন একটি ভাবনা ছিল এবং সাইড থেকে গোল করে ইটালিকে ফাইনালে পৌঁছে দেন।
অবশ্য ফাইনালে ইটালি বিন্দুমাত্রও প্রতিদ্বন্দ্বিতা গড়তে পারেনি পেলের ব্রাজিলের কাছে।
ইটালি বনাম ব্রাজিল (৩-২)
দ্বিতীয় রাউন্ড, স্পেন, ১৯৮২
১৯৮২ সালে স্পেন বিশ্বকাপ ফুটবলের আরো একটি ম্যাচ সেরা ১০ এ স্থান পায়। গ্রুপ’ সি’র শেষ ম্যাচে মুখোমুখি হয় বিশ্ব ফুটবলের দুই পরাশক্তি ইটালি ও ব্রাজিল। তুমুল প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ এ ম্যাচে পাওলো রসি’র দুর্দান্ত এক হ্যাটট্টিকে ব্রাজিলিয়ান কোচ পরাজয়ের সম্পর্কে বলেন, ব্রাজিল ইটালির কাছে হারেনি, হেরেছে পাওলো রসি’র কাছে। জুয়া কেলেঙ্কারীর খলনায়ক এই বিশ্বকাপে মহানায়ক বনে গিয়েছিলেন।
টুর্নামেন্টে ইটালির শুরুটা তেমন ভাল হয়নি। গ্রুপ পর্যায়ে তিনটি ম্যাচের সবগুলোতেই ড্র করে দ্বিতীয় রাউন্ডে ওঠে। এখানেই রসির নিজেকে মেলে ধরা শুরু হয়। ব্রাজিলের বিরুদ্ধে তিনিই দলকে এগিয়ে দেন। তবে সক্রেটিসের গোলে দক্ষিণ আমেরিকানরা ফিরে আসে। এরপর রসি আবার ইটালিকে এগিয়ে নেন। কিন্তু ফ্যালকাও আবার সমতা ফেরান। তবে রসিই শেষ গোল করে ইটালিকে সেমিফাইনালে পৌঁছে দেন।
ফ্রান্স বনাম ব্রাজিল ১-১ (৪-৩)
কোয়ার্টার ফাইনাল, মেক্সিকো ১৯৮৬
১৯৮৬ সালের মেক্সিকো বিশ্বকাপটিকে বলা হয়, এক ম্যারাডোনার বিশ্বকাপ। এই বিশ্বকাপের আসরে কোয়ার্টার ফাইনালে দেখা হয় মিশেল প্লাতিনির, ফ্রান্সের সাথে ব্রাজিলের। ফ্রান্স ১৯৮২ সালের হতাশা কাটিয়ে ১৯৮৪’র ইউরো জিতে বিশ্বকাপেও ভাল খেলার সম্ভাবনা জোরদার করেছিল। কিন্তু কোয়ার্টার ফাইনালে পড়ে তারকা সমৃদ্ধ আরেক দল ব্রাজিলের।
ব্রাজিল এগিয়ে গিয়েছিল কারেকার গোলে। কিন্তু ফ্রান্স সমতা ফেরায় দারুণভাবে। রশাটেউ’র ক্রসে প্রলুব্ধ হয়ে ফরাসি স্ট্রাইকার স্টপিয়া ও ব্রাজিলের গোলরক্ষক ক্যারিয়স উভয়েই ছুটে যান আর ফাঁকায় প্লাতিনি গোল করে বসেন। জিকো পেনাল্টি থেকে ব্রাজিলকে জয়ী করার সুযোগ পেয়েছিলেন। কিন্তু ফরাসি গোলরক্ষক জোয়েল ব্যাটস তা রক্ষা করেন। এই ব্যর্থতার ফলে পেনাল্টিতে গড়ায় ম্যাচটি। পেনাল্টিতে প্লাতিটি মিস করলেও তারা সেমিফাইনালে পৌছে যায়। তবে তাদের দৌড় সেখানেই শেষ হয়ে যায় পশ্চিম জার্মানির কাছে হেরে।
আর্জেন্টিনা বনাম ইংল্যান্ড ২-২ (৪-৩)
ফ্রান্স, ১৯৯৮
গত শতাব্দীর শেষ বিশ্বকাপের আসর বসেছিল ফ্রান্সে। দ্বিতীয় রাউন্ডের আর্জেন্টিনা বনাম ইংল্যান্ডের ম্যাচটি বিশ্বকাপ ফুটবলের আরেকটি মনে রাখার মতো ম্যাচ। এ ম্যাচে ইংল্যান্ড ২-১ গোলে এগিয়ে থাকা অবস্থায় ডিয়েগো সিমিওনিকে ফাউল করার অপরাধে ইংল্যান্ডের ডেভিড বেকহ্যামকে লাল কার্ড দেখানো হয়। পেনাল্টি থেকে আার্জেন্টিনা খেলায় সমতা ফিরিয়ে আনে। অতিরিক্ত সময়ে ইংল্যান্ড ১০ জন নিয়ে খেলে, আর তাতে আর্জেন্টিনা কোন গোল করতে পারেনি। ওই ৩০ মিনিটেও খেলা নির্ধারিত সময়ের ২-২ গোলে সমতায় থাকে। কিন্তু টাইব্রেকারে ইংল্যান্ড ৪-৩ গোলে পরাজিত হয়ে বিশ্বকাপ থেকে বিদায় নেয়। ইংল্যান্ডের সোনার ছেলে বেকহ্যাম রীতিমতো খলনায়কে পরিণত হন।
ইংল্যান্ড বনাম পশ্চিম জার্মানি, ৪-২
ফাইনাল, ইংল্যান্ড, ১৯৬৬
বিশ্বকাপের বিগত ১৭টি ফাইনালের মধ্যে সবচেয়ে জমজমাট ও আকর্ষণীয় ফাইনাল ম্যাচটি অনুষ্ঠিত হয় ১৯৬৬ সালে ইংল্যান্ড বনাম প. জার্মানির মধ্যকার ফাইনাল ম্যাচটি। যদিও প. জার্মানরা ফেবারিটের আসনে ছিল। তবে কমও ছিল না স্বাগতিক ইংল্যান্ডও। খেলার ১৩ মিনিটে হেলমুট হলার গোল করলে এগিয়ে যায় জার্মানি। কিন্তু বিরতির ঠিক আগে ইংল্যান্ডর জিওফ হার্স্ট চমৎকার হেডের মাধ্যমে গোল পরিশোধ করেন। দ্বিতীয়ার্ধে পিটারস ইংলিশদের এগিয়ে নিয়ে গেলেও খেলা শেষ হওয়ার আগে জার্মানির ওয়েবের ফ্রি কিক থেকে গোল করে খেলায় সমতা আনেন। খেলা অতিরিক্ত সময়ে গড়ায়।
কোচ স্যার আলফ রামসে তার খেলোয়াড়দের বলেন, ‘তোমরা তাদের একবার পরাস্ত করেছো এবং যাও আরেকবার করো।’
তার এই কথায় খেলোয়াড়রা উদ্দীপ্ত হয়ে ওঠে এবং হার্স্ট দুটি গোল করেন। তবে তার প্রথম গোলটি নিয়ে এখনো বিতর্ক রয়ে গেছে, সেটি ক্রসবার অতিক্রম করেছিল কিনা তা জানা যায়নি।
বেলজিয়াম বনাম রাশিয়া (৪-৩)
মেক্সিকো, ১৯৮৬
১৯৮৬ সালের মেক্সিকো বিশ্বকাপে আরো একটি ম্যাচ সেরা দশে স্থান করে নিলো। দ্বিতীয় রাউন্ডের দারুণ প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ ম্যাচে অতিরিক্তি সময়ে এক অপ্রত্যাশিত জয় পায় বেলজিয়াম। এ ম্যাচে রাশিয়ার বেলারভের হ্যাটট্টিকটি কোনো কাজেই লাগেনি। শেষ পর্যন্ত রাশিয়া বেলজিয়ামের কাছে ৪-৩ গোলে পরাজিত হয়ে টুর্নামেন্ট থেকে বিদায় নেয়।
ব্রাজিল বনাম ইটালি, (৪-১)
ফাইনাল, মেক্সিকো, ১৯৭০
১৯৮২ সালের মতো ১৯৭০-এর বিশ্বকাপেও ব্রাজিল বনাম ইটালি ফুটবলপ্রেমীদের উপহার দিয়েছিল আরেকটি উত্তেজনাময় জমজমাট ফুটবল ম্যাচ। পার্থক্য হলো, ওই ম্যাচটি ছিল গ্রুপ পর্বে জিতেছে ইটালি। আর এই ম্যাচটি হলো ফাইনাল ম্যাচ জিতেছে ব্রাজিল।
এ ফাইনাল ম্যাচটি দুই দলের কাছেই ছিল অতীব গুরুত্বপূর্ণ। কেননা দুই দলেই ইতিপূর্বে দুইবার করে জুলে রিমে ট্রফি জয় করেছে।
সুতরাং তৃতীয়বার যে দল চ্যাম্পিয়ন হবে, জুলে রিমে ট্রফিটি চিরতরে তাদের দখলে চলে যাবে। তাই জুলে রিমে ট্রফিটি চিরতরে লাভের জন্য দুই দল মরিয়া হয়ে খেলতে থাকে। কিন্তু পেলে, জোয়ার জিনহো, গার্সন ও কার্লোস আলবার্টোর নৈপুণ্যের কাছে দাঁড়াতেই পারেনি ইটালিয়ানরা। ৪-১ গোলে জয়ী হয়ে ব্রাজিল চিরতরে জুলে রিমে ট্রফিটি ঘরে তুলে নেয়।
অনেকের দৃষ্টিতে এটাই ইতিহাসের সেরা ফাইনাল।
ইংল্যান্ড বনাম ক্যামেরুন (৩-২)
ইটালি, ১৯৯০
তীব্র উত্তেজনাপূর্ণ এ ম্যাচে শেষ পর্যন্ত ইংরেজদের অসাধরণ শৈলীর কাছে হার মানতে হয় আফ্রিকান কালো সিংহদের। অতিরিক্ত সময়ে লিনেকারের অসাধারণ নৈপুণ্য কোনোক্রমে মান বাঁচাতে সক্ষম হয় ইংল্যান্ড। ক্যামেরুন পুরো সময়ে অসাধারণ খেলে ও শেষ পর্যন্ত অতিরিক্ত সময়ে গোল খেয়ে ৩-২ গোলে পরাজিত হয়ে কোয়ার্টার ফাইনাল থেকে বিদায় নেয়।
রুমানিয়া বনাম আর্জেন্টিনা, (৩-২)
দ্বিতীয় রাউন্ড, যুক্তরাষ্ট্র, ১৯৯৪
তীব্র উত্তেজনাপূর্ণ একটি ম্যাচ। একটি অপ্রত্যাশিত ফলাফল। প্যাসাডোনার রোজ বোলে ৯০ হাজার দর্শকের উপস্থিতিতে একটি ফেবারিট দলের বিদায়। ম্যাচটি ১৯৯৪ এর যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বকাপে দ্বিতীয় রাউন্ডের রুমানিয়া আর্জেন্টিনার মধ্যকার ম্যাচ। ওই ম্যাচে আর্জেন্টিনাকে ৩-২ গোলে পরাজিত করে ইতিহাস সৃষ্টি করে গিওর্গে হ্যাজির রুমানিয়া।