sliderছবি ঘরস্থানীয়

বিলুপ্তির পথে শিবালয়ের ঘানি শিল্প

এম এ কাইয়ুম চৌধুরী,শিবালয় প্রতিনিধি: ভোর হলে আর ঘানি ভাঙ্গার তেলের ক্যাঁচ ক্যাঁচ শব্দ শুনতে পাওয়া যায় না। দিন-দিন হারিয়ে যাচ্ছে ঘানি শিল্পো। একসময় যেখানে ক্যাঁচ ক্যাঁচ শব্দে ভোর রাতে ঘুম ভাঙ্গে যেতো স্থানীয়দের। ঘর-ঘর ঘানি শিল্পের সাথে জড়িত থাকায় এই গ্রামের নাম করণ করা হয়েছে তেলি পাড়া।

মানিকগঞ্জ জেলার শিবালয় উপজেলার উলাইল ইউনিয়নের কয়ড়া বেপাড়ীপাড়া গ্রামে, তেওতা ইউনিয়নের জাফরগ্জ বেপারীপাড়ায়,শিবালয়ের নালী ও উথলী এলাকায় গরু দিয়ে ঘানি টানে সরিষার থেকে তেল উৎপাদন করে বিক্রি-করাই ছিলো এই গ্রামের মানুষের মূল আয়ের উৎস। সেই সময় ঘানি টেনে এমন তেল বের করে তাদের সংসার চললেও বর্তমান যান্ত্রিক যুগে এদিয়ে আর চলছে না তাদের সংসার। বাধ্য হয়ে অনেকে ছাড়ছে বাপ দাদার এ পেশা। অনেকে আবার পূঁজির অভাবে অন্য কেনো পেশায় যেতে না পেরে আকড়ে ধরে আছে পূর্ব পুরুষের পেশা।

ওই গ্রামে ৫ থেকে ৬টি পরিবার ঘানি টানছে গরু দিয়ে। প্রতিবার ৫-৬ কেজি সরিষা ডালায় ভেরে গরু দিয়ে ঘানি টানে এরা। ঘানি টানার সময় গরুর চোখ বেঁধে দেয়া হয় কাপড় দিয়ে। কেউ আবার গরুর চোখ না বেঁধে ঘানি টানছে। দৃশ্যটা দেখেই মনে পড়ে গেল বইয়ে পড়া সেই ঘানিটানা শ্রম আর কলুর বলদ-এর কথা। তবে বেলকায় গরুর ঘানির সংখ্যা এখন হাতে গোনা।

শিবালয় উপজেলার আশপাশে ঘানিভাঙা তেলের চাহিদা ব্যাপক। সাধারণ মানুষ আজও খাঁটি সরিষার তেল বলতে ঘানিভাঙ্গা তেলকেই বুঝে থাকেন। ঘানিভাঙ্গা তেলের এই ব্যাপক চাহিদার পরও আধুনিক মেশিন নির্ভর শিল্প ও প্রযুক্তির প্রসারের কারণে হারিয়ে যাচ্ছে ঐতিহ্যবাহী ঘানিশিল্প। উপজেলার ঐতিহ্যবাহী নালী হাটে ১৫টি দোকানে, শিবালয়ের ১০টি দোকানে, জাফরগঞ্জের ৫টি দোকানে ও আমডালা বাজারের ৫টি দোকানে এখনও টিকে আছে ঘানি টানা সরিষার তেল।

মোঃ মোতালেব বেপারী, আজিজুর রহমান, আমডালা বাজারে মুদি দোকানে ও নইমুদ্দিন মিয়া, ভোলা মিয়া ও নজু মিয়া তেলি চিরাচরিত নিয়মে কলসে করে তেল বিক্রয় করছেন হাটে।
বাপ-দাদার পেশার ঐতিহ্য হিসেবে এখনো অনেক কষ্টে তারা টিকিয়ে রেখেছেন ঘানিগুলো। প্রতিটি ঘানিকে তেলের গাছ বলা হয়। গাছে একটি বিশেষ আকৃতির ছিদ্রের ভেতর দিয়ে ফোঁটা-ফোঁটা তেল পড়ে এবং তা একটি ছোট্র ড্রামে সংরক্ষণ করা হয়। এরপর তেল বাজার জাত করেন তারা। প্রতিটি গাছে একবারে সর্বোচ্চ ৬ কেজি সরিষা ভাঙা সম্ভব হয়। এই পরিমাণ সরিষা থেকে তেল উৎপাদন করা যায় দেড় থেকে দুই কেজির মতো। ছয় কেজি সরিষা ভাঙতে সময় লাগে প্রায় দুই ঘণ্টা। এইভাবে দিনে একটি ঘানি থেকে ৩৫ থেকে ৪০ কেজি সরিষা ভাঙা সম্ভব হয়। প্রতিকেজি তেল বাজারে বিক্রি হয় দু‘শ চল্লিশ টাকা দরে।

ঘানির মালিক নুরুল আমিন বেপারী বলেন, অন্যান্য তেলের থেকে ঘানিভাঙা তেলের দাম একটু বেশি। এই তেলের চাহিদাও বেশি। তবে ঘানি টানা তেলের জন্য বাজারে দূর দূরান্ত থেকে মানুষ এখানে ছুটে আসেন ঘানির তেল কিনতে। কারণ সবাই জানেন, এখানে বাছাই করা উত্তম সরিষা থেকে তৈরি হয় তেল। শিবালয় উপজেলার বাজার গুলোতে ঘানিতেলের ঝাঁঝ ও গন্ধ দুটোই মুগ্ধ করে। আমরা সব সময় খুচরা তেল বিক্রি করে থাকি। ৩০ কেজি তেল বিক্রিয় করলেও প্রতিকেজি তেল দু’শ চল্লিশ টাকার কম নেই। বিভিন্ন ধরনের ভর্তা ও শিশুদের (নবজাতকের) শরীরে মালিশ করার জন্য ক্রেতারা দূর দূরান্ত থেকে ছুটে আসেন ঘানির তেল কিনতে।

সরেজমিন ঘুরে দেখা যায়, ঘানিতে বিদ্যুতের কোনো ব্যবহার করা হয় না। ঘানি টানা হয় গরু দিয়ে। একটি ঘানিতে গড়ে দু’টি করে গরু প্রয়োজন। প্রতিটি গরুর বাজার মূল্য ৫৫ থেকে ৭৫ হাজার টাকা। কিন্তু গরু পালনের নানা হ্যাঁপা। এ কারণে ঘানি চালানো বড় ঝক্কির ব্যাপার। গরুর লালন পালন, খাবার যোগার করা, চিকিৎসার ব্যবস্থা করাসহ নানা রকম দেখভাল করার পেছনে অনেক শ্রম সময় ও অর্থ ব্যয় হয়। এ কারণে অনেকে ইচ্ছে থাকলেও আর ঘানি চালাতে চান না ফলে অনেকেই অন্য ব্যবসার দিকে ঝুঁকছেন।

ঘানির মালিকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, প্রতিটি ঘানি দিনে ৩০ কেজি সরিষা ভাঙ্গানো যায়। এতে দু’টি গরুর প্রয়োজন হয়। প্রতিটি গরুকে এক ঘণ্টা পরপর বিশ্রাম দেয়া হয়। তবে এখন বাজারে মেশির দিয়ে সরিষার তেল বানাচ্ছে অতি কম সময়ে। এ থেকে বাজারে ঘানি টানা তেল।

নানা কারণে বিলুপ্তির পথে গরুর ঘানি। গরুর পালন ও ঘানি চালানোর ব্যাপারটা দেখভালের জন্য দিনমজুর পাওয়া যাচ্ছে না। প্রতিটি গরুর জন্য যে উন্নত মানের খাবার দরকার তা পাওয়া যায় না আজকাল। আর পশু খাদ্যের দামও আকাশ ছোঁয়া। সেই সঙ্গে আছে গরু পালনের স্থান ও রাখালের অভাব। এছাড়া ঘানিতে দিনে খুব বেশি হলে ৩০ থেকে সবোর্চ্চ ৩৫ কেজি পর্যন্ত সরিষা ভাঙানো সম্ভব হয়।

অপরদিকে বিদ্যুৎচালিত মেশিনে পুরো এক মণ সরিষা ভাঙাতে সময় লাগে মাত্র ২ ঘণ্টা। এই কারণে অনেকে গরুর ঘানির বদলে বৈদ্যুতিক মেশিন ব্যবহার করার কথা ভাবছেন।

জাফরগঞ্জ বাজারের মনোহারি দোকান মালিক মোঃ জাহাঙ্গীর আলম মেম্বার বলেন, ঘানি সরিষার তেলের চাহিদা থাকলেও এখন উৎপাদন কম হওয়ায় বিভিন্ন কোম্পানি থেকে বোতল জাত তেল বিক্রয় করতে হচ্ছে। ঘানিতেলের চাহিদা শীতের সময়ই বেশি থাকে।

নজু মিয়া আরও বলেন, প্রতি মণ সরিষা ১৭-১৮শ টাকা দরে কিনতে হয়। সেই হিসেবে তেমন কোনো লাভ থাকে না। একই স্থানে যদি মেশিনের ঘানি দিতাম তবে এক ঘানি থেকে দিনে ৫ থেকে ৬ মণ সরিষা ভাঙ্গাতে পারতাম। কিন্তু গরুর ঘানিতে সর্বোচ্চ ৩৫ থেকে ৪০ কেজির বেশি সরিষা ভাঙানো যায় না। ফলে এই ব্যবসায় টিকে থাকা বড় কঠিন হয়ে গিয়েছে।

Related Articles

Leave a Reply

Back to top button