sliderস্থানীয়

বিলুপ্তির পথে ঐতিহ্যবাহী বাহন পালকি

এম এ কাইয়ুম চৌধুরী,শিবালয় প্রতিনিধি: ‘পালকি চলে! পালকি চলে! গগন-তলে আগুন জ্বলে। স্তব্ধ গায়ে আদুল গায়ে, যাচ্ছে কারা রৌদ্র সারা!’ কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের লেখা পালকি কবিতা বইয়ের পাতায় থাকলেও বাস্তবে নেই এই ঐতিহ্যের বাহনটি। পালকি ছিল এক সময়ে বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী ও প্রাচীন বাহন। মানুষ বহন করার কাজেই এর ব্যবহার হতো। সাধারণত ধনী গোষ্ঠী এবং সম্ভ্রান্ত বংশের লোকেরা এর মাধ্যমে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে ভ্রমণ করতেন। কিন্তু এখন তা পুরোপুরি বিলুপ্ত।

পালকির ইতিহাস
ধারণা করা হয়, প্রাচীনকালে দেব-দেবীর আরোহণ বা দেব-দেবীর মূর্তি বহনের জন্য পালকি সদৃশ বাহন ব্যবহার করা হতো। অনেক প্রাচীন মন্দিরেও পালকি দিয়ে দেবতা বহনের দৃশ্য ভাস্কর্য আকারে তুলে ধরা হয়েছে। হিন্দুদের রামায়ণেও আনুমানিক খ্রীষ্টপূর্ব ২৫০ সালের সময়ের দিকে পালকির উল্লেখ পাওয়া যায়। ব্রিটিশ শাসনামলে ইউরোপের উচ্চ শ্রেণির সম্ভ্রান্ত ব্যক্তিরা এই পালকিতে চলাচল করতেন। তবে উপমহাদেশে রেলগাড়ির প্রচলেনর পর ব্রিটিশ কর্মকর্তাদের মাঝে পালকির ব্যবহার অনেকটাই কমে আসে।ইউরোপের পালকিগুলোকে শোবার উপযোগী করে বানানো হতো। কোনো কোনো পালকি খোলা হতো আবার কোনোটি হতো বন্ধ। মিশরীয় চিত্রকর্মেও পালকির দেখা পাওয়া যায়। পারস্য রাজ্যেও পালকির অস্তিত্ব ছিল। বিখ্যাত পরিব্রাজক ইবনে বতুতা থেকে শুরু করে চতুর্দশ শতকে পর্যটক জন ম্যগনোলি ভ্রমণের জন্য পালকি ব্যবহার করতেন বলে জানা যায়। সম্রাট আকবরের শাসন আমলে এবং তারও পরবর্তি সময়ে সেনাধ্যক্ষদের যাতায়াতের জন্য প্রধান বাহন হিসেবে পালকিই ব্যবহৃত হতো। বর্তমানে পালকি ব্যবহার একেবারে নেই। বিশেষ করে ১৯৩০ সালের পর থেকে শহরাঞ্চলে রিকশার প্রচলন শুরু হলে পালকির ব্যবহার উঠে যায়।

পালকি চাকাবিহীন একটি বাহন। পালকিকে কয়েকজন ঘাড়ে ঝুলিয়ে সামনের দিকে অগ্রসর হতে থাকে। যারা পালকিকে ঘাড়ে বা কাঁধে করে বহন করতেন তাদের বলা হত পালকির বেহারা বা কাহার। পালকির ভেতরে আকারভেদে ১ বা ২ জন বসতে পারতেন, আর পালকির বেহারা হিসেবে থাকত ২ থেকে ৮ জন। কাঠ মিস্ত্রীরা সেগুন কাঠ, শিমুল কাঠ, গান কাঠসহ বিভিন্ন প্রকার কাঠ দিয়ে তৈরি করতেন পালকি। পালকির বহন করার দন্ডটিকে বলা হয় বাঁট। এই বাঁট তৈরি হত বট গাছের বড় ঝুরি দিয়ে।

আগেরকার দিনে বাংলাদেশে তিন রকমের পালকি দেখা যেতো। সাধারণ পালকি, আয়না পালকি এবং ময়ূরপঙ্খি পালকি। সাধারণ পালকি দেখতে আয়তাকার, ঢালু ছাদ এবং চারদিকে কাঠের আবরণ ছিল এর প্রধান বৈশিষ্ট্য। এর দু’দিকে দুটি দরজাও থাকতো। আয়না পালকির বৈশিষ্ট্য হলো এতে আয়না লাগানো থাকতো। ভেতরে চেয়ারের মতো দুটি বসার জায়গা এবং একটি টেবিলে রাখা হতো। তবে আয়তনের দিক থেকে বলতে গেলে ময়ূরপঙ্খি পালকি সবচেয়ে বড়।

এই পালকিটি ময়ূরের আকৃতিতে তৈরি করা হয়। এর ভেতরে দুটি চেয়ার, একটি টেবিল এবং একটি তাকও থাকতো।কিন্তু উনবিংশ শতাব্দীতে এসে সড়ক ও যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতির ফলে যাতায়াতের বাহন হিসেবে পালকির ব্যবহার প্রায় বন্ধই হয়ে যায়। বর্তমানে পালকিকে আমাদের অতীত ঐতিহ্যের নিদর্শন হিসেবেই ধরা হয়। বেহারাদের কাঁধ থেকে পালকির স্থান হয়েছে এখন বিভিন্ন জাদুঘরে। সভ্যতা এবং বাস্তবতার কথা চিন্তা করলে পালকিকে হয়তো আর ফিরিয়ে আনা সম্ভব নয়। তবে আমরা এবং আমাদের ভবিষ্যত প্রজন্ম যাতে পালকির কথা ভুলে না যাই সেদিকে আমাদের সুদৃষ্টি রাখা প্রয়োজন।

Related Articles

Leave a Reply

Back to top button